শস্যভান্ডার খ্যাত উত্তরের জেলা নওগাঁয় এক সময় ছোট চালকলগুলো (হাসকিং মিল) প্রাণবন্ত ছিল। কিন্তু অটোরাইস মিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে সেগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। অনেক চালকল মালিক ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন, আবার অনেকে টিকতে না পেরে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। কেউ কেউ চাতালগুলোতে চালের পরিবর্তে ধানের চিটা থেকে গুড়া তৈরি করছেন। আর শ্রমিকরা জীবিকার তাগিদে বদলেছেন পেশা।
Advertisement
ধানকেন্দ্রিক জেলা হওয়ায় এক সময় প্রচুর ছোট ছোট চালকল গড়ে ওঠে নওগাঁয়। জেলা শহর থেকে মহাদেবপুর যাওয়ার পথে নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের দুইপাশে চোখে পড়বে হাসকিং মিলগুলো। কয়েক বছর আগেও এ জেলায় প্রায় ১২০০ হাসকিং মিল ছিল। যেখানে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান ছিল। বর্তমানে এসব হাসকিং মিলের পাশাপাশি ৫৫টি অটো রাইস মিল চালু হয়েছে। অটোরাইস মিলগুলো পুরোদমে চালু থাকলেও হাসকিং মিলগুলোর প্রায় অর্ধেকই এখন বন্ধ। আর যেসব মিল টিকে রয়েছে সেগুলোর অবস্থাও নাজুক।
নারী শ্রমিক কোহিনুর বেগম জানান, একটি চালকলে ছয়জন কাজ করছেন। চাতালে ২শ মন ধান ভিজানো ও শুকানো থেকে শুরু করে ভাঙানো পর্যন্ত পারিশ্রমিক হিসেবে ৬০০ টাকা এবং ৪৫ কেজি চাল দেয়া হতো। জনপ্রতি ভাগে ১শ টাকা ও সাড়ে ৭ কেজি করে চাল পাওয়া যায়। মাসে ৩-৪ টা চাতাল উঠে। পরিশ্রম বেশি হয়; কিন্তু সে তুলনায় পারিশ্রমিক পাই না। যে টাকা পাই তা দিয়ে সংসার চলা কষ্টকর হয়ে ওঠে। এক সময় অনেক মানুষ কাজ করতো। অনেক চালকল বন্ধ হয়ে গেছে। তারা এখন কৃষিকাজ, ভ্যান চালানো কেউ বা ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করছে। আমরা অন্য কোনো কাজে অভ্যস্ত না হওয়ায় চাতালেই পড়ে আছি।
সদর উপজেলার হাঁপানিয়া এলাকার কফিল উদ্দিন চালকলের মালিক কফিল উদ্দিন বলেন, প্রায় ৩০ বছরের অধিক সময় ধরে চাতালের সঙ্গে জড়িত। সে সময় মিলে ১৫-১৮ জন শ্রমিক কাজ করতো। গত ছয় বছর থেকে চাতাল বন্ধ রয়েছে। চাল উৎপাদনের পরিবর্তে তিনি এখন ধানের চিটা সংগ্রহ করে গুড়া ভাঙানোর কাজে মিল ব্যবহার করছেন।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, অটোরাইস মিলে বেশি ধানের প্রয়োজন হওয়ায় তারা বেশি দামে ধান কেনে। আমাদের ছোট চালকলে ধান কম লাগলেও বেশি দামে কিনতে হয়। শ্রমিক খরচ ও চাল উৎপাদন করতে গিয়ে খরচটা বেশি হয়। সে কারণে বেশ লোকসানে পড়তে হয়েছিল। যার কারণে মিল বন্ধ করে দিয়েছি। হাসকিং মিলগুলো আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব না।
অনেক হাসকিং মিলই এখন পরিত্যক্ত
সামিয়া চালকলের মালিক মোতালেব হোসেন বলেন, ধান কিনে চাল উৎপাদন করতে প্রায় ৭-১২ দিন সময় লেগে যায়। আর অটোরাইস মিলে ১-২ দিনের মধ্যে চাল উৎপাদন করে বাজারজাত করে এবং তারা দাম পায়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়না। অটোরাইসের কারণে আমরা টিকতে পারছি না। কোনো মতে হাসকিং মিল টিকিয়ে রেখেছি।
তিনি বলেন, বড় ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কোথাও থেকে কোনো ধরনের সুবিধা পাই না। সরকার একটা উদ্যোগ নিয়েছে- ধারণক্ষমতা অনুযায়ী মিলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ধান মজুদ রাখতে পারবে। এ ধারা চলমান থাকলে আমরা কিছুটা উপকৃত হবো।
Advertisement
নওগাঁ জেলা অটো সাটার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, অনেক চালকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকরা অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। গত ১০-১৫ বছর আগে যে পারিশ্রমিক দেয়া হতো; এখনো সেই মজুরি দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। পারিশ্রমিক বাড়াতে মালিকদের সঙ্গে কয়েকবার বৈঠক হয়েছে। তারা প্রতিশ্রুতি দেয়ার দুই বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা অবহেলিত হতেই আছি।
মেসার্স ফারিহা রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী শেখ ফরিদ উদ্দিন বলেন, অটোরাইস মিলে ধারণক্ষমতা অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টায় ১০ জন শ্রমিক ৩০ মেট্রিকটন চাল উৎপাদন করতে পারে। সেখানে হাসকিং মিলে এক সপ্তাহে প্রায় ১৫ জন শ্রমিক ৩০ মেট্রিকটন চাল উৎপাদন করতে পারে। এক সময় প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হতো। অটোরাইস মিল আসার পর মানুষ বেকার হয়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। মানুষের দৈন্যতা বেড়েছে। কিছু হাসকিং মিল অনেক কষ্টে এখনো টিকে আছে।
নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে। অটোরাইস মিলে চাল উৎপাদন করতে বেশি গরম করতে হয়। ওই চালের ভাত রান্নার পর দীর্ঘ সময় ভাল থাকে। কিন্তু হাসকিং মিলের চালের ভাত পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ ও সুস্বাদু হলেও দীর্ঘ সময় ভাল থাকে না। সরকারেরও কিছু বৈষম্য রয়েছে। ছোট মিলের জন্য সরকার কম পরিমাণ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। এখান থেকে উত্তরণের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে। যেন হাসকিং মিল মালিকরা সরকারের সঙ্গে কাজ করতে পারে।
আব্বাস আলী/এমএইচআর/জেআইএম