মতামত

ভাস্কর্যবিরোধী আস্ফালনের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

ফারাবি বিন জহির

Advertisement

‘ভাস্কর্য’ এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে আলোচিত একটি শব্দ। এই ভাস্কর্য ঘিরে পানি কম ঘোলা হয়নি। দেশে ভাস্কর্যের পক্ষে বিপক্ষে সমাবেশ হয়েছে। আমার দেখেছি এই ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক শক্তির উগ্র আস্ফালন। উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি চেয়েছে এই ভাস্কর্য ঘিরে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে। তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার এক ঘৃণ্য চক্রান্তে মেতে উঠেছিল।

এ ঘৃণ্য চক্রান্তের শুরুটা হয়েছিল ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে। এই ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তাদের বিরোধিতা শুরু করে। তাদের স্পর্ধার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তারা ধর্মকে ঢাল বানিয়ে দেশে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরির ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। দেশের আপামর জনসাধারণ তাদের এ চক্রান্তের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। দেশের সব স্থান থেকে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে এ ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত লেজ গুটিয়ে পিছু হাটতে বাধ্য হয় এ ধর্মান্ধ সম্প্রদায়।

তার পরও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে এ উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি কীভাবে জাতির জনকের ভাস্কর্য নিয়ে ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস পেল? কীভাবে তারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে উঠলো? যেই ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে ধৃষ্টতা দেখাল সেই ধর্ম আসলে ভাস্কর্য সম্পর্কে কি বলে? এই ধর্ম ব্যবসায়ীরা যাদের অনুসারী তাদের সেই পূর্বপুরুষদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নের প্রশ্নে অবস্থান কি ছিল?

Advertisement

সময় এসেছে এই প্রশ্নগুলোর বিষয়ে আলোকপাত করার। প্রথমেই আলোকপাত করা যাক এই উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি কীভাবে জাতির জনকের ভাস্কর্য নিয়ে ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস পেল? কীভাবে তারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে উঠলো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের তাকাতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এরা এই উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বেশ বেকায়দায় ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের রাজনীতি ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর স্বাধীন বাংলাদেশে এই উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটে। এ কথা অস্বীকারের জো নেই যে ’৭৫-পরবর্তী প্রায় প্রতিটি সরকার তাদের ভোটের এবং জোটের রাজনীতির হিসাব কষে প্রতক্ষ্য বা অপ্রত্যক্ষ ভাবে এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর প্রতি একধরনের নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেছে। সরকারগুলোর এই নমনীয় মনোভাবের সুযোগ নিয়ে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দিন দিন ফুলে ফেঁপে ওঠে। তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ডালপালা ভয়াবহ ভাবে বিস্তার লাভ করেছে। সরকারগুলোর নমনীয়তার সুযোগ নিয়ে তারা সমাজের প্রতিটি স্তরে তাদের উগ্র মতবাদ পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়। ভোটের রাজনীতির ম্যারপ্যাঁচের কারণে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এই সাম্প্রদায়িক শক্তি জেঁকে বসার সুযোগ পায়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেই ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে ধৃষ্টতা দেখাল সেই ধর্ম আসলে ভাস্কর্য সম্পর্কে কি বলে? এক উগ্রপন্থী নেতা তো বলেই বসলেন যে গত ১৪০০ বছরে নাকি কেউ ভাস্কর্যের পক্ষে ফতোয়া দেয়নি। বিষয়টি যে কত বড় সত্যের অপলাপ তা দেখার জন্য শুধু মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের ভাস্কর্য সম্পর্কিত ফতোয়াটি দেখলেই বোঝা যাবে। ভাস্কর্য বিষয়ক ফতোয়াটির লিংক এবং আরবি ফতোয়াটির বাংলা অর্থ পাঠকদের সুবিধার্থে দেয়া হলো। বাংলা অর্থঃ ফতোয়া বোর্ড নিম্নোক্ত ঘোষণা করছে যে, ইসলাম অর্থবহ শিল্পের সাথে সাংঘর্ষিক না, বরং অর্থবহ শিল্পের প্রতি আহ্বান ও উৎসাহিত করে। কেননা প্রকৃতপক্ষে শিল্প হচ্ছে এক নান্দনিক আবিষ্কার, ইসলাম যার বিরোধিতা করে না। ভাস্কর্য ও চিত্রাঙ্কন শিল্পেরই একটা অংশ, সুতরাং ইসলাম ভাস্কর্য ও চিত্রাঙ্কনকে হারাম বলে না আবার একই সাথে নিরঙ্কুশ ভাবে বৈধও বলে না। বরং দুটি শর্ত সাপেক্ষে ভাস্কর্য ও চিত্রাঙ্কনকে বৈধতা দেয়।

শর্ত দুটি হলো

Advertisement

১. ভাস্কর্য দ্বারা পূজার উপসনা বা ইচ্ছা করা যাবে না।২। ভাস্কর্য বা চিত্রকলা আল্লাহর সৃষ্টির সাদৃশ্য এমন ভাস্কর্য তৈরি করা যাবে না যেই ভাস্কর্যের উদ্দেশ্য থাকে আল্লাহর সৃষ্টি ক্ষমতা এবং মহিমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং এই মতবাদ প্রতিষ্ঠা করা যে ভাস্কর আল্লাহর সৃষ্টির ন্যায় সৃষ্টি করতে পারে ।

যখন এই দুটি শর্ত নিশ্চিত হবে তখন ভাস্কর্য বৈধ, তাতে কোনো সমস্যা নেই। এই ফতোয়ার সপক্ষে দলিল হলো পবিত্র কোরআনের বাণীঃ “সুলায়মান যা চাইত, তারা তার জন্য তা বানিয়ে দিত উঁচু উঁচু ইমারত, ভাস্কর্য, হাউজের মতো বড় বড় পাত্র (সুরা সাবাঃ আয়াত ১৩)।

সুতরাং আল্লাহ তায়ালা পবিত্র এই আয়াতে সুলায়মান (আ.) এর ওপর ভাস্কর্য নির্মাণের অনুগ্রহ প্রকাশ করেছেন; অতএব ভাস্কর্য নির্মাণ এই প্রমাণ বহন করে যে ভাস্কর্যটি উপাসনার উদ্দেশ্যে ছিল না। কারণ মহান আল্লাহ বস্তু শিরক তার ওপর অনুগ্রহ প্রকাশ করবেন না। আর আমাদের পূর্ববর্তী শরিয়ত আমাদের জন্য ও শরিয়ত, মহান আল্লাহ বলেন, ‘(হে নবী!) এই (নবী-রাসূলরা) ছিলেন এমন ব্যক্তি যাঁদের আল্লাহ পথ প্রদর্শন করেছিলেন। অতএব, আপনিও তাঁদের পথ অনুসরণ করুন।’ (সূরা আন'আমঃ আয়াত ৯০)

একটি বিষয় পরিষ্কার যে, ভাস্কর্য শর্তসাপেক্ষে হালালের ফতোয়া আছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য উপরের দুটি শর্ত যথাযথ ভাবে পূরণ করে। একজন মুফতি যখন ফতোয়া দেবেন তখন বিপরীত অভিমতগুলো সামনে রেখে ফতোয়া দিতে হবে। নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করতে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া কোনো ভাবেই বৈধ নয়। অথচ ভাস্কর্যবিষয়ক আল আজহারের এই ফতোয়াকে বেমালুম চেপে যাওয়া হয়েছে। কার স্বার্থে এবং কি কারণে চেপে যাওয়া হয়েছে তা তদন্তের দাবি রাখে।

শুধু যে আল আজহার তা কিন্তু নয় আরও অনেক ইসলামি চিন্তাবিদ ভাস্কর্য হারাম প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময় ভিন্নমত পোষণ করেছেন, যাদের মধ্যে আল্লামা ইস্তাখরী, প্যানইসলামিজমের ধারণার প্রতিষ্ঠাতা শাইখ মুহাম্মাদ আব্দুহু, শায়েখ আব্দুল ফাত্তাহ আবুগুদ্দাহর ছাত্র ডক্টর আলি জুমআ, বিশিষ্ট আরবি সাহিত্যিক সিরিয়ার শাইখ আলী তানতাভী, তিউনিসিয়ার মালেকী মাযহাবের প্রখ্যাত আলেম শাইখ কায়েস আল খিয়ারী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

ফিকাহ শাস্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী, যখন ইসলামী চিন্তাবিদদের মতের ভিন্নতা দেখা দেয় তখন নিষেধাজ্ঞা অনেকটা শিথিল হয়ে যায়। কাজেই যারা হারাম বলছেন তারা শুধু তাদের মতটি প্রচার করছেন কিন্তু তারা বিপরীত মতকে প্রচার এবং খণ্ডন তো দূরে থাক বরং সম্পূর্ণ চেপে যাচ্ছেন। ফতোয়া প্রদান করতে গিয়ে বিপরীত মতকে চেপে গিয়ে শুধু একপাক্ষিক মত প্রচার করে দেয়া ফতোয়া কতটুকু সহীহ সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

আমরা যদি মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখবো উটের ভাস্কর্য রয়েছে সৌদি আরবে, সুলতান সালাদিনের ভাস্কর্য রয়েছে সিরিয়ায়, মহাকবি ফেরদৌসির ভাস্কর্য রয়েছে ইরানে, আল-বিরুনি ও ওমর খৈয়ামের ভাস্কর্য রয়েছে ইরানে, ন্যাশনাল মনুমেন্ট ভাস্কর্য রয়েছে মালয়েশিয়ায়, কামাল আতাতুর্ক ভাস্কর্য রয়েছে তুরস্কে, হাম্মুরাবি ভাস্কর্য রয়েছে ইরাকে, ক্রাইস্ট ব্লেসিংয়ের ভাস্কর্য রয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাস্কর্য রয়েছে পাকিস্তানে।

সর্বশেষ যে প্রশ্নটি নিয়ে আলোকপাত প্রয়োজন তা হলো এ ধর্ম ব্যবসায়ীরা যাদের অনুসারী তাদের সেই পুর্বপুরুষদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে অবস্থান কি ছিল? এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষদের অবস্থান ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। এই উগ্র গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষরা পদে পদে পাকিস্তানিদের পদলেহন করেছেন। তাদের পূর্বপুরুষরা পাকিস্তান আমলে শহীদ মিনারকে, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফাকে ইসলামবিরোধী বলেছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিরোধিতা করেছেন। এই উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির পূর্বপুরুষরাও ছিলেন মনে প্রাণে পাকিস্তানি।

তারা প্রকাশ্যে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের কথা পরে গণমাধ্যম বিচিত্রায় প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে তাদের নিজের বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। যারা এক সময় বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ঠেকানোর জন্য ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে তাদের উত্তরসূরিরাই আজকে ধর্মকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা কায়েমের স্বপ্ন দেখে। পূর্বসূরিদের পেয়ারা পাকিস্তানের হেরে যাওয়ার জ্বালা তাদের উত্তরসূরিরা আজও বহন করে চলছে। কারণ, তারা ভালোবাসেন চাঁদ তারাকে, লাল সবুজের বাংলাদেশটাকে নয়। একটি বিষয় পরিষ্কার যে, ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে আস্ফালনে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি হাসিল করার। আজকে যারা ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে উগ্র আস্ফালন দেখাচ্ছে তাদের পূর্বপুরুষরা যখন ক্ষমতায় ছিল তখন কিন্তু তারা এবং তাদের পূর্বপুরুষরা ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র শব্দ করেননি। কিন্তু যখনই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের সময় এসেছে তখনই তাদের মুখে খই ফুটেছে।

এই কথা অনস্বীকার্য যে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ একে অপরের পরিপূরক। বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষদের সব ষড়যন্ত্রের বাধা অতিক্রম করে পাকিস্তানিদের দীর্ঘদিনের শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল। সেই পূর্বপুরুষদের পরাজয়ের শোক ভুলতে না পেয়ে এই উগ্র গোষ্ঠী অবস্থান নিয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে। তাই জাতি হিসেবে আমাদের উচিত হবে এই উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা। কারণ আমাদের সম্মিলিত প্রতিরোধই পারবে এই উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে।

লেখক : অ্যাকটিভিস্ট।

এইচআর/এমকেএইচ