সানজিদা সামরিন
Advertisement
নতুন বছরের প্রথম দিনেই জনপ্রিয় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান তার ভেরিফাইড ফেসবুক অফিসিয়াল ফ্যান পেজে একটি ছবি আপলোড করেন। ছবিতে স্ত্রী উম্মে আহমেদ শিশিরের বেবি বাম্পে চুমু খাচ্ছেন তিনি। অসম্ভব সুন্দর এই ছবি ও উপরের ক্যাপশন দেখেই বোধগম্য হয় এই সেলিব্রেটি দম্পতির ঘরে আসছে নতুন আরও এক অতিথি।
এই ছবিতে শুধু রিয়েক্ট ও শুভ কামনা জানিয়ে কমেন্ট করেই স্ক্রল করতে পারতাম। কিন্তু না, ক্লিক করে আরও অনেকগুলো কমেন্ট পড়লাম। শুধু তাই নয়, ভালো কমেন্টের পাশাপাশি যা যা দেখবো বলে আশঙ্কা বা ধারণা করেছিলাম মোটামুটি সবগুলোই পেয়ে গেলাম। নারীর গর্ভধারণ ও গর্ভকাল নিয়ে সরাসরি কথাবার্তার সময় যে দেশে প্রসঙ্গ পাল্টানোর প্রস্তাব চলে সেখানে গর্ভকালে একজন নারীর বেবিবাম্পসহ ছবি পোস্ট হবে আর তা লোকলজ্জায় জর্জরিত জনগণ এমনিতেই হজম করবে তা কী করে হয়?
সাকিব ফলোয়ারদের সেসব কমেন্টগুলোকে যদি দুই তিন লাইনে সারাংশ করি তাহলে লিখতে হবে- গর্ভধারণের বিষয়টি আসলে স্বামী-স্ত্রীর বদ্ধঘরের মধ্যকার বিষয়। এমন ছবি প্রকাশ অশ্লীলতার চেয়ে কম নয়। কেউ উপদেশ দিয়ে লিখেছেন, এভাবে ছবি দেয়া চরম নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার বহিঃপ্রকাশ। এতে মাতৃত্বের পবিত্রতাকে অপমান করা হলো। একান্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়টাকে জনসম্মুখে তুলে ধরাটা কোনভাবেই সমীচীন হয়নি।
Advertisement
এখানে শুধু সাকিব আল হাসানের পোস্টের কথা বললেও যদি দেশীয় মডেল, অভিনেত্রী যারা এই মুহূর্তে গর্ভকাল পার করছেন তাদের মাতৃত্বের ছবির নিচের মন্তব্যগুলোও দেখি শিউরে উঠি। দুঃখজনক হলেও বলতে হবে, এদেশে ২০২১ সালে এসেও একজন নারীর গর্ভধারণকে মানে- একটি শিশু একজন নারীর শরীরকে আশ্রয় করে দশ মাস সময় নিয়ে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হবে ব্যাপারটিকে লুকায়িত, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক মনে করা হয়। এখানেই শেষ নয়, গর্ভধারণ বিষয়ে স্বামী বা স্ত্রী উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলে বা বিষয়টি সাবলীলভাবে প্রকাশ্য জানান দিলে সেটাকে অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার কাতারে ফেলে দিতে দ্বিধা করা হয় না। এই ধারণা যারা বহন করেন তাদের একটা বড় অংশ কিন্তু শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই পড়ে।
যাই হোক, এসব কমেন্ট পড়ে একটু হোঁচট খেলেও অবাক হইনি। একজন নারী যখন গর্ভধারণ করেন তখন তার মাথার ওপর যেন পেতে দেয়া হয় অদৃশ্য তবে অভেদ্য কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণার এক চাদর। এই চাদরের চার কোণা ধরে রাখেন পরিবার ও সমাজের শিক্ষিত, অশিক্ষিত, উচ্চপদস্থ, সম্ভ্রান্ত, নিম্নশ্রেণির সব সত্ত্বারা। এর তল দিয়েই দশ মাসের পথ হেঁটে চলেন গর্ভধারিণী।
ছোটবেলায় বোনের বিয়ের পর যখন জানতে পারলাম আমার বোনটি সন্তানসম্ভবা তখন থেকেই আশপাশের অনেকের সুবাদে আরও জানলাম- বোনের গর্ভধারণের কথা যেন কাউকে না জানাই। টেলিভিশনে সেকালে কেবল বিটিভি চলতো। স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠানগুলোয় যখন গর্ভধারণ, গর্ভকাল, প্রসব ও স্তন্যপান নিয়ে কথাবার্তা হতো তখন বয়োজ্যেষ্ঠরা ইতস্তত করে ভলিউম কমিয়ে দিতেন বা রিমোট টিপে বন্ধই করে দিতেন টেলিভিশন।
আশপাশে আরও দেখতাম, পাশের বাসার ভাবি বা আপাকে বলতে- চারমাস অব্দি ঠিকঠাকই চলাফেলা করতে পারি। এরপর এলাকা বেড়ানো বন্ধ। বেবি বাম্প উঠে গেলে কি আর মানুষের সামনে আসা যায়? একবার একজনকে প্রশ্নই করে ফেলেছিলাম- কেন আসা যাবে না? কথা শুনে সে হেসেই গড়াগড়ি খেলো। শুধু তিনি নয় আরও অনেকের কাছ থেকেই জেনেছি, বেবি বাম্প নিয়ে বাইরে বের হওয়া লজ্জার বিষয়।
Advertisement
পরিবারের কোনো নারী একটি নতুন প্রাণকে পৃথিবীর আলো দেখাতে যাচ্ছেন এই বিষয়টি ধারণ করার থেকে বা এ ব্যাপারটিকে আলোয় না রেখে বরং কীভাবে তাকে একটা নির্দিষ্ট সময় অব্দি আড়ালে রাখা যায় তারই একটা অন্ধ অনুশীলন চলতো। এখনো চলে না তা নয়। যে সময়ের কথা বলাম সেটা ২০০০ সালের আগের কথা। এরপর অনেকটাই পাল্টেছে। বাইরে কাজ করার সুবাদে ম্যাটারনিটি লিভ পাওয়ার আগ অব্দি নারীরা বেবি বাম্প নিয়েই অফিস করছেন, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করছেন, নিমন্ত্রণে যাচ্ছেন সাবলীলভাবে।
আমাদের নারীদের সেটুকু লজ্জা ভেঙেছে বলে সাধুবাদ। এবার একটু তাদের কথা বলা প্রয়োজন বোধ করছি যাদের অন্ধকার একেবারেই ছুঁতে পারেনি। যারা মাতৃত্ব বা গর্ভকালের প্রতিটি মুহূর্ত দারুণভাবে উপভোগ করেন ও করতে চান। যাদের কাছে গর্ভকারণ লুকোছাপার নয় বরং এটি একটি প্রকাশ্য সত্য ও গর্বের বিষয়। পরিবারের নতুন অতিথির আগমন যাদের কাছের আশির্বাদ ও ব্যাপারটি নিয়ে তারা দারুণভাবে উচ্ছসিত। যারা মা হওয়ার সুসংবাদটি নিজমুখে জানাতে সম্মানবোধ করেন। নিজের গর্ভকালের ছবি সোশ্যাল হ্যান্ডেলে প্রকাশ করাতেও বিন্দুমাত্র কিন্তুবোধ করেন না।
শুধু যদি প্রেগন্যান্ট সেলিব্রেটিদের কথাই বলি তাহলে আমি তাদের পোস্ট করা বেবিবাম্পসহ ছবিগুলোয় দেখতে পাই শক্তি, সম্মান, জাগরণ, গর্ব, আনন্দ, মমতা আরও অনেক কিছু। কিন্তু দুঃখবোধ হয় তাদের জন্য যারা নারীর মাতৃত্বের ছবি দেখে শিউরে ওঠেন। পরম মমতা জড়ানো সেসব ছবি তাদের নিকট অশ্লীলতা বা বেহায়াপনা। তারা কেমন মানুষ, তারা কেমন শিক্ষায় শিক্ষিত যারা মাতৃত্বকে অশ্লীলতা বলে চালিয়ে দেয়। এও কি সম্ভব? তবে মুষড়ে পড়ি না, এখনো আমার প্রদীপ জ্বেলে রেখেছি-নারীর এই সৃষ্টিসত্ত্বাকে সম্মান করতে পারবে তারা, আনন্দিত-উচ্ছ্বসিত হবে তাদের সঙ্গে যারা পৃথিবীতে নতুন প্রাণের জন্ম দিতে যাচ্ছেন। অনাগত সন্তানের অপেক্ষায় রয়েছেন এমন সব মায়েদের জন্য শুভ কামনা।
এইচআর/জেআইএম