বিশেষ প্রতিবেদন

সংশোধিত ড্যাপ বাস্তবায়ন হলে ঢাকা হবে পূর্ণাঙ্গ মেগাসিটি

 

শত শত বছরের পুরোনো রাজধানী ঢাকাকে বসবাস উপযোগী, দৃষ্টিনন্দন ও নাগরিক সুবিধার আধারে পরিণত করতে ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান (১৯৯৫-২০১৫) বা ২০ বছর মেয়াদি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু নানা অসঙ্গতি থাকায় পরে ড্যাপ সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ কারণে বাস্তব কোনো চেহারা পায়নি পুরোনো সেই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিকল্পনা। বর্তমানে সংশোধিত ড্যাপ (২০১৫-৩৫) প্রণয়নের কাজ রয়েছে শেষ পর্যায়ে। সংশোধিত ড্যাপ নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুল হক মিঠু।

Advertisement

জাগো নিউজ: আগের (১৯৯৫-২০১৫) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপের পর সংশোধিত ড্যাপের (২০১৫-২০৩৫) যৌক্তিকতা কতটুকু?

মো. আশরাফুল ইসলাম: সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে আগের ড্যাপে কিছু অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়। সেটিতে এলাকাভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়নি। যেমন আশুলিয়া ও গাজীপুরে অনুমোদনহীনভাবে গার্মেন্টস শিল্প গড়ে উঠেছে। পরিকল্পনাহীনভাবে হওয়ায় সেখানে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটেছে, দুর্ঘটনাও ঘটছে। সংশোধিত ড্যাপে এলাকাভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

এছাড়া আগের ড্যাপে কৃষিজমি কিংবা জলাশয় সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ ছিল না। এবার টিডিআর পলিসির (ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইটস) প্রস্তাব করেছি। শুধু জলাশয় বা কৃষিজমি নয়, ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহ সংরক্ষণের সুপারিশ সংশোধিত ড্যাপে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি এতে বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মতামত নেয়া হয়েছে।

Advertisement

রাজউকের সংশোধিত ড্যাপ বাস্তবায়ন হলে ঢাকা নগরী মেগাসিটিতে রূপ নেবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা

জাগো নিউজ: সংশোধিত ড্যাপে নতুন কী থাকছে?

মো. আশরাফুল ইসলাম: এবার আমরা ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করছি। এতে মানুষ তার নিজের ও আশপাশের ভূমির ব্যবহার এবংপরিকল্পনা সম্পর্কে মুহূর্তেই জানতে পারবে। স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল ওয়ার্ডভিত্তিক করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। মানুষের হাঁটার জায়গা নির্মাণ করার সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দেয়া হয়েছে সংশোধিত ড্যাপে। ঢাকার ভেতরে ৫৬৬ কিলোমিটার নদীপথ নতুন করে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা প্রস্তাব ছাড়াও সিএস এবং আরএস রেকর্ড অনুযায়ী খালগুলোকে পুনরুদ্ধার করে ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করার কৌশল আছে এবারের ড্যাপে।

এছাড়া মেট্রোরেলকে কেন্দ্র করে টিওডি জোন বা ট্রানজিট অরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট জোন করার প্রস্তাব দিয়েছি। পুকুরগুলোকে পুনরুদ্ধার করে জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রস্তাবের পাশাপাশি ঢাকার আশপাশে বয়ে চলা নদীর তীরে ওয়াকওয়ে নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রশস্ত সড়ক, প্রশস্ত ফুটপাত নির্মাণ করে সেগুলোর পাশে গাছ লাগিয়ে নাগরিকদের পূর্ণাঙ্গ আরবান লাইফলাইনে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

Advertisement

ব্লকভিত্তিক নগরায়নের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সংশোধিত ড্যাপে

জাগো নিউজ: ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কী ধরনের পরিকল্পনা আছে?

মো. আশরাফুল ইসলাম: সংশোধিত ড্যাপে সড়ক, নৌ ও রেলপথকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ট্রাফিক কমানোর জন্য ঢাকার চারপাশে তিনটি রিং রোডের প্রস্তাব করা আছে। যেগুলো আন্তঃনগর টার্মিনাল ও আন্তঃজেলা টার্মিনালের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে। আমরা সদরঘাটকে ব্যবহার করতে চাচ্ছি। এজন্য সদরঘাটকে এমআরটি লাইন-২ করিডোরের আওতায় আনার পরিকল্পনা নিয়েছি। যেন সদরঘাটে নেমেই মানুষ সেন্ট্রাল ঢাকায় দ্রুত প্রবেশ করতে পারে।

জাগো নিউজ: শিশু-কিশোরদের জন্য কী সুবিধা থাকছে সংশোধিত ড্যাপে?

মো. আশরাফুল ইসলাম: আমরা ব্লকভিত্তিক নগরায়নের প্রস্তাব দিয়েছি। ৩ কাঠা ও ৫ কাঠায় কোনো ভবন তৈরি না করে ছোট ছোট ব্লক আকারে ভবন নির্মাণ করার সুপারিশ দেয়া হয়েছে। যেন সেই ব্লকের অভ্যন্তরে একটি বড় খেলার মাঠ তৈরি হয়। এবং সেখানে ওই কমিউনিটির লোকজনের ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করতে পারে।

ঢাকার ভেতরে ৫৬৬ কিলোমিটার নদীপথকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব রয়েছে সংশোধিত ড্যাপে

জাগো নিউজ: পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা?

মো. আশরাফুল ইসলাম: নগরে ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স তৈরি করতে ড্যাপে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রাস্তা ও ফুটপাতের চারপাশে বিভিন্ন ধরনের প্লান্টেশনের প্রস্তাব দেয়া আছে। খাল, বিল, নদীর চারপাশে কিছু গাছপালা রোপণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। জলাশয়গুলো প্রয়োজন হলে অধিগ্রহণ করে হলেও সেখানে একটা সুন্দর পরিবেশ তৈরির সুপারিশ দেয়া হয়েছে।

জাগো নিউজ: দখলকৃত খাল, নদী, ফুটপাত কিংবা রাস্তা দখলমুক্ত করা কি সম্ভব? দখলমুক্ত করতে আপনারা কী ধরনের ব্যবস্থা নেবেন?

মো. আশরাফুল ইসলাম: সিএস বা আরএস রেকর্ডভুক্ত যে খাল বা জলাধার রয়েছে সেগুলোর মালিক সরকার। সরকারি জায়গা দখলমুক্ত করা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। রাজউকের আওতাধীন প্রকল্পে যদি দখলি কিছু থাকে তাহলে রাজউক তা উচ্ছেদ করবে। অন্যগুলো সিটি করপোরেশন ও অন্য সংস্থার সমন্বয়ে রাজউক সেই উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

জাগো নিউজ: যানজট নিরসনে কী পরিকল্পনা?

মো. আশরাফুল ইসলাম: স্বল্পগতির যানবাহন যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ। আমরা গণপরিবহনকে শহরে প্রাধান্য দিচ্ছি। বাসরুট রেশনালাইজেশনের কাজ চলছে। ঢাকার ভেতরে পাঁচটি মেট্রো লাইন ও দুটো বিআরটি লাইনের প্রস্তাব দিয়েছি। তিনটি রিং রোডের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে ঢাকার যানজট নিরসনে। এছাড়া ঢাকার খালগুলো পুনরুদ্ধার করে সেগুলো দিয়ে যাতায়াত ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

ঢাকার যানজট নিরসনে নানামুখী প্রস্তাব করা হয়েছে সংশোধিত ড্যাপে

জাগো নিউজ: জলাবদ্ধতা কাটাতে সংশোধিত ড্যাপে কী থাকছে?

মো. আশরাফুল ইসলাম: ঢাকার পুকুরগুলো পুনরুদ্ধারের প্রস্তাব দিয়েছি। সিএস বা আরএস রেকর্ডে যে খাল বা জলাধার রয়েছে সেইগুলো পুনরুদ্ধারের প্রস্তাব দিয়েছি। এগুলো পুনরুদ্ধার হলে নগরবাসী জলাবদ্ধতার হাত থেকে মুক্তি পাবে বলে মনে করি।

জাগো নিউজ: নগরের বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে কোনো ধরনের পরিকল্পনা আছে কি?

মো. আশরাফুল ইসলাম: আমরা বলছি সবখানেই সুষম উন্নয়ন করতে হবে। তাহলেই ঢাকায় মানুষের চাপ কমবে। সেন্ট্রাল ঢাকায় মানুষের চাপ হ্রাস করার জন্য রাজধানীর আশপাশে ছয়টি রিজিওনাল সেন্টার তৈরি করার প্রস্তাব আমরা দিয়েছি। যেমন পূর্বাচল, ঝিলমিল, গাজীপুর, সাভার, কেরানীগঞ্জ- এগুলো আমাদের রিজিওনাল সেন্টার হবে। আবার প্রতিটি রিজিওনাল সেন্টারকে কেন্দ্র করে ইউনিয়ন পরিষদ অন্তর্ভুক্ত এলাকার উন্নয়নে আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। যেন ঢাকার অভ্যন্তরে মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়। আবার সেন্ট্রাল ঢাকায় যারা কাজ করতে আসবেন, তারা যেন দ্রুত রিজিওনাল সেন্টারে চলে যেতে পারে, সেজন্য মেট্রোলাইন-৫ এর করিডোর হেমায়েতপুরে দেয়া হয়েছে সাভার এলাকার মানুষের জন্য। তেমনি এমআরটি লাইন-১ আমরা পূর্বাচল পর্যন্ত নিয়েছি।

জাগো নিউজ: ড্যাপ বাস্তবায়ন হলে রাজধানীর কী ধরনের উন্নতি হবে?

মো. আশরাফুল ইসলাম: আমরা নাগরিকদের শুধু স্লিপিং স্পেস (ঘুমানোর জায়গা) দিতে চাই না। তাদের একটা স্বাস্থ্যকর, নাগরিক সুবিধাসম্পন্ন শহর উপহার দিতে চাই। সংশোধিত ড্যাপে সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকা একটি পূর্ণাঙ্গ মেগাসিটির রূপ পাবে।

জাগো নিউজ: আপনাকে ধন্যবাদ।

মো. আশরাফুল ইসলাম: জাগো নিউজকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।

এসএম/এইচএ/জিকেএস