কোনো স্ত্রী যদি স্বামীর প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করে কিন্তু তাকে কোনো কারণে ভালো না বাসে তবে এটা কি স্ত্রীর কোনো অপরাধ? কিংবা এতে কি স্ত্রীর গোনাহ হবে? এ সম্পর্কে ইসলাম কী বলে?
Advertisement
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ভালোবাসা প্রাকৃতিক। আল্লাহ তাআলা তাদের উভয়ের মাঝে এ ভালোবাসা তৈরি করে দিয়েছেন। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা এ ভালোবাসা ইঙ্গিত এভাবে তুলে ধরেছেন-وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَআর (আল্লাহর) এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই চিন্তাশীলদের জন্য এতে নিদর্শনাবলী রয়েছে।’ (সুরা রূম : আয়াত ২১)
এ আয়াতের আলোকে বুঝা যায়, স্বামী-স্ত্রী পরস্পর একে অপরকে ভালোবাসবে এটাই প্রাকৃতিক। এ ভালোবাসা একান্ত পারিবারিক। এ ভালোবাসা মহান আল্লাহ তাআলার দেয়া নেয়ামতসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি। প্রত্যেক স্বামী-স্ত্রীই এ ভালোবাসা কামনা করে।
না, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর এ ভালোবাসা না থাকলে গোনাহ হবে বা এটি না থাকলে সংসার চলবে। বিষয়টি এমন নয়। কেননা শুধুমাত্র ভালোবাসার উপর নির্ভর করেই কি সংসার টিকে থাকে? ভালোবাসা না থাকলে কি সংসার টিকে না?
Advertisement
মহান আল্লাহ তাআলা স্বামী-স্ত্রীকে কিভাবে জীবন পরিচালনা করতে হবে কিংবা কেউ কাউকে পছন্দ না করলে কী করণীয়? তাও বলে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ يَحِلُّ لَكُمْ أَن تَرِثُواْ النِّسَاء كَرْهًا وَلاَ تَعْضُلُوهُنَّ لِتَذْهَبُواْ بِبَعْضِ مَا آتَيْتُمُوهُنَّ إِلاَّ أَن يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُّبَيِّنَةٍ وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ فَإِن كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَى أَن تَكْرَهُواْ شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيراً‘হে ঈমাণদারগণ! জোরপূর্বক নারীদের উত্তরাধিকার গ্রহণ করা তোমাদের জন্যে বৈধ নয় এবং তাদেরকে আটক রেখো না যাতে তোমরা তাদেরকে যা (মোহর) প্রদান করেছ তার কিয়দংশ নিয়ে নাও; কিন্তু তারা যদি কোনো প্রকাশ্য অশ্লীলতা করে! নারীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন কর। অতপর যদি তাদেরকে (কোনো কারণে) অপছন্দ কর, তবে হয়ত তোমরা (স্ত্রীদের) এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ অনেক কল্যাণ রেখেছেন।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১৯)
স্বামী-স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা না থাকার বিষয়টি সম্পর্কে হজরত ওমরা রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময়ের একটি ঘটনার প্রতি দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে। তাহলো-একবার এক ব্যক্তি হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে এসে বললেন, হে আমিরুল মুমিনিন! আমি আমার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাই।হজরত ওমর জানতে চাইলেন, কেন?ওই ব্যক্তি বলল, ‘আমি তাকে ভালোবাসি না।’হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন অসাধারণ একটি নসিহত পেশ করলেন-‘সব পরিবার তথা পারিবারিক বন্ধনগুলো কি শুধুমাত্র ভালোবাসার উপর নির্ভরশীল? তাহলে পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব কিংবা অনুগ্রহ কোথায় গেল? অর্থাৎ ভালো না বাসলেই যে তালাক দিতে হবে কিংবা সংসার করা যাবে না বিষয়টি কিন্তু এমন নয়।
কেননা কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তাআলা একে অপরের প্রতি অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করেছেন। তাই স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা থাকতেই হবে তা আবশ্যক হয়ে দাঁড়াবে না। বরং স্বামী-স্ত্রীর কোনো একজন বা কেউ কাউকে ভালো না বাসলেও তাদের একের প্রতি অপরের যে দায়িত্ববোধ বা অনুগ্রহ রয়েছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
পশ্চিমা সংস্কৃতির ভালোবাসার কথা ইসলাম বলে না বা সমর্থন করে না। যে ভালোবাসা সাময়িক তথা দুদিনের। ভালোবাসার বা যৌন উম্মাদনের সময় শেষ তো পারিবারিক দাম্পত্য জীবন শেষ। ইসলাম এটিকে সমর্থন করে না। বরং পারিবারিক জীবনে ভালোবাসা থাকবে এবং দায়িত্ব-অনুগ্রহও থাকবে। যদি ভালোবাসা নাও থাকে দায়িত্ব ও অনুগ্রহের কারণে পারিবারিক জীবনের বন্ধন অটুট থাকবে।
Advertisement
দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসা থাকবে না কেন?স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে ভালোবাসবে না কেন? এর পেছনে কি কারণ থাকতে পারে? স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা তো একটি অধিকার। যদি স্বামীর প্রতি ভালোবাসা না থাকে তবে বুঝতে হবে এখানে অধিকারের ওপর কোনো হস্তক্ষেপ আছে।
কোনো ব্যক্তি যদি তার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা না থাকে তবে তো স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব ও অনুগ্রহ কোনোটিই যথাযথভাবে আদায় হবে না। যখনই দায়িত্ব পালন যথাযথ হবে না তখনই স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা কমে যাবে।
সুতরাং স্বামী যেমন স্ত্রীকে ভালোবাসবে; স্ত্রীও স্বামীকে ভালোবাসবে এটাই একান্ত আবশ্যক।
মনে রাখতে হবেপরিবারিক জীবনে কম-বেশ ঝগড়া বিবাদ হয়েই থাকে। মন খারাপ কিংবা মনোমালিন্য হতেই পারে। তবে তাও হবে না; যদি কেউ হজরত আহমাদ ইবনে হাম্বাল রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতো পারিবারিক জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। তাহলো-
হজরত আহমাদ ইবনে হাম্বাল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি স্ত্রীর সঙ্গে ৩০ বছর সংসার করেছিলেন। এ ৩০ বছরে তাদের একদিনও মনোমালিন্য হয়নি। যা সত্যিই বিস্ময়কর। যা জানা গেছে তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর। তিনি স্ত্রীর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তার জন্য এভাবে দোয়া করেছিলেন-‘হে উম্মে আব্দুল্লাহ! তোমার কবর শান্তিময় হোক। তুমি আমার সঙ্গে ৩০ বছর কাটিয়ছ; তুমি কখনো আমাকে কষ্ট দাওনি আর আমিও তোমাকে কখনো কষ্ট দেইনি। আমরা পরস্পর কখনো ঝগড়ায় জড়িয়ে যাইনি।’উপস্থিত ছাত্ররা এ কথা শুনে বললেন- এটি কী করে সম্ভব?তিনি বললেন- ‘না, আমাদের কখনোই ঝগড়া-বিবাদ হয়নি। কারণ, আমার স্ত্রী যখন রাগ করেছে, তখন আমি শান্ত থেকেছি, চুপ থেকেছি। আর আমি যখন রাগ করেছি, তখন আমার স্ত্রী শান্ত ছিল, চুপ থেকেছিল। এ কারণে আমাদের কখনো ঝগড়া-বিবাদ হয়নি।
বাস্তবেই দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মিল যদি এমন হয় তবে, ভালোবাসা যেমন অটুট থাকবে; তেমনি দায়িত্ব এবং অনুগ্রহও অটুট থাকবে। কোনো কারণে ভালোবাসা না থাকলেও দাম্পত্য জীবনে দায়িত্ব ও অনুগ্রহে কমতি হবে না।
কেননা স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক বন্ধ কখনো সামঞ্জস্য, কখনো মেনে নেয়া, কখনো ভালোবাসা- এ সবগুলোর সমন্বয়ের নাম। উম্মাদনা আর যৌনতার উপর নির্ভর করা ভালোবাসা নয়।
সুতরাং কোনো কারণে স্বামীর প্রতি ভালোবাসা না থাকলেই স্ত্রীর গোনাহ হবে বিষয়টি এমন নয়। যদি স্ত্রী তার স্বামী প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করে এবং তার প্রতি অনুগ্রহ দেখায় তবে স্ত্রী গোনাহগার হবে না।
চূড়ান্ত কথা হলো-আল্লাহ তাআলার ঘোষণা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করাই শ্রেয়। আর এর মাঝেই রয়েছে কল্যাণ ও শান্তি। যেভাবে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন-يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ يَحِلُّ لَكُمْ أَن تَرِثُواْ النِّسَاء كَرْهًا وَلاَ تَعْضُلُوهُنَّ لِتَذْهَبُواْ بِبَعْضِ مَا آتَيْتُمُوهُنَّ إِلاَّ أَن يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُّبَيِّنَةٍ وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ فَإِن كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَى أَن تَكْرَهُواْ شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيراً‘হে ঈমাণদারগণ! জোরপূর্বক নারীদের উত্তরাধিকার গ্রহণ করা তোমাদের জন্যে বৈধ নয় এবং তাদেরকে আটক রেখো না যাতে তোমরা তাদেরকে যা (মোহর) প্রদান করেছ তার কিয়দংশ নিয়ে নাও; কিন্তু তারা যদি কোনো প্রকাশ্য অশ্লীলতা করে! নারীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন কর। অতপর যদি তাদেরকে (কোনো কারণে) অপছন্দ কর, তবে হয়ত তোমরা (স্ত্রীদের) এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ অনেক কল্যাণ রেখেছেন।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১৯)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো একজন মুমিন পুরুষ কোনো একজন মুমিন নারীকে (স্ত্রীকে) অপছন্দ করবে না। হতে পারে তিনি যাকে অপছন্দ করছেন, তার মধ্য আল্লাহ অনেক কল্যাণ রেখেছেন।‘ (মুসলিম)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সব স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পরের প্রতি যথাযথ ভালোবাসা, দায়িত্ব পালন ও অনুগ্রহ দেখানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমকেএইচ