মতামত

বগুড়ায় শেখ হাসিনা : জামায়াত-বিএনপির অটল দুর্গে ফাটল

গত বৃহস্পতিবার ১২ নভেম্বর, ২০১৫ বগুড়া শহরের আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠে জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হলো। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন দলীয় প্রধান এবং সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দীর্ঘদিন পর বগুড়ায় তাঁর এ যাওয়া। তিনি অবশ্য বেশ কিছু প্রকল্পের উদ্বোধন করতে বগুড়ায় গিয়েছিলেন। সেগুলোর উদ্বোধন শেষে বিকেলে উক্ত জনসভায় যোগ দেন। বগুড়ায় শেখ হাসিনার যাওয়া, বিভিন্ন  প্রকল্পের উদ্বোধন এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণাসহ জনসভায় অংশ নেওয়ার রাজনৈতিক তাৎপর্য অন্য যে কোনো জেলায় তাঁর যাওয়া থেকে বেশ ভিন্ন গুরুত্ব বহন করে। বগুড়ার জনসভায়  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা বলেছেন তার গুরুত্ব এক ধরনের। বগুড়ায় যারা বসবাস করেন তাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে নিজের নানা প্রশ্নের উত্তর নেওয়ার চেষ্টা করেছি। তা থেকেই বিষয়টি মূল্যায়ন করা। বগুড়ায় জনসভার স্থানের সীমানা ছাড়িয়ে দর্শক ও শ্রোতারা বেশ দূর পর্যন্ত  শেখ হাসিনার বক্তৃতা শুনেছেন। উক্ত সভায় চার ধরনের শ্রোতার উপস্থিতি ঘটেছিল। এক, আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মী-যা সব দলের ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। অন্যত্র যেভাবে আসে, এখানেও তারা সেভাবেই এসেছেন, গেছেনও। এদের অংশগ্রহণ এবং উপস্থিতি নিয়ে জনসভায় সাফল্য বা ব্যর্থতা মূল্যায়নের তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। বগুড়ার জনসভায় আশপাশের উপজেলা ও জেলা থেকে বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মীর উপস্থিতি ছিল। দুই, আওয়ামী লীগ করেন না- তবে রাজনীতি এক সময় করতেন- এখন সেসব ছেড়েছুড়ে দিয়ে এটা-সেটা করেন, কিন্তু দেশ নিয়ে ভাবেন- এমন অনেকেই শেখ হাসিনার জনসভায় গেছেন, নেতৃবৃন্দের কথা শুনেছেন, সব কিছু পর্যবেক্ষণ করেছেন। বগুড়ার জনসভায় এমন শ্রোতা-দর্শকের উপস্থিতি বেশ উল্লেখ করার মতো ছিল। জনসভার গুরুত্ব বোঝার ক্ষেত্রে এটি  একটি বড় উপাদান। তিন, সাধারণ মানুষ যারা কোনো বিশেষ দলের বলে ধরা যায় না। বগুড়ায় এদের ভোটের সুবিধা এতোকাল বিএনপিই বেশি লাভ করে এসেছে। শেখ হাসিনার এই জনসভায় তাদের উপস্থিতিও বেশ ঘটেছিল। চার, বিএনপি বা ২০ দলীয় জোট করেন এমন দর্শক শ্রোতাও এখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনলেন। তারা শুনেছেন মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী বলছেন। বগুড়ায় বিএনটির শক্ত ঘাঁটির পেছনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের স্থানীয় পরিচিতি মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে। বগুড়ায় বিএনপির যতো উত্থান  ঘটেছে আওয়ামী লীগ সেখানে তত দুর্বল হয়েছে। এক সময় সারা দেশের মতো বগুড়াতেও আওয়ামী লীগের শক্তিশালী সাংগঠনিক অবস্থা ছিল, জনসমর্থন তো ছিলোই। কিন্তু প্রথমবার ১৯৭৮-৮১ সালে, দ্বিতীয়বার- ১৯৯১- উত্তর-কালে বগুড়ায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের পারিবারিক পরিচিতি সুবিধা এবং নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে বিএনপির শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তবে বিএনপির ছায়াতলে থেকে বগুড়ায় জামায়াত এতোটাই শক্তি অর্জন করেছে যে ভবিষ্যতে এখানকার রাজনৈতিক সমীকরণে জামায়াতের অবস্থান বিএনপিকে ছাড়িয়ে গেলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না। জামায়াত গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত জানা-অজানা পরিচিতির সাংগঠনিক জালের বিস্তার ঘটিয়েছে, নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের নানা প্রতিষ্ঠানে টেনে এনেছে, নানা এনজিও, দাতব্য, শিক্ষা, সেবা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে বগুড়া অঞ্চলে জামায়াত নিজেদের অবস্থান অনেকটাই সংহত করতে পেরেছে। এক সময় এরা বিএনপির ভোট ব্যাংক ছিল, এখন পরিস্থিতি উল্টে যাচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে কোথাও কোথাও জামায়াতকে নিয়ন্ত্রক শক্তি বলে ধরে নিতে হচ্ছে। ২০১২-১৩ সালে সে ধরনের শক্তি প্রয়োগই ঘটতে দেখা গেছে। বর্তমানে যে বিষয়টি বগুড়াতেও লক্ষণীয় তা হচ্ছে, বিএনপির ভোট ব্যাংক, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী- অনেকেই বিএনপির রাজনীতির ওপর আগের মতো ভরসা রেখে স্থির থাকতে পারছেন না। তাদের একটি অংশ জামায়াতের দিকে ঝুঁকে আছে, নানা ধরনের সুবিধা নেওয়ার টোপ গিলছে। অন্য অংশটি হতাশায় আছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের একটি অংশের কারণে না-আওয়ামী লীগ- না বিএনপিতে থাকা জনসমর্থকদের বড় অংশটি আওয়ামী লীগের কাছাকাছি ভিড়ছে না। বিএনপির প্রতি হতাশ এবং কিছু নতুন উপলব্ধির জায়গা থেকে যারা সরে আসার মতো-তাদেরকে কাছে টানার কোনো উদ্যোগ নেই। এদের অনেকেই বৃহস্পতিবারের জনসভায় শ্রোতা দর্শক হিসেবে উপস্থিত থেকেছেন। বক্তাদের বক্তৃতার সব কথায় তারা সায় দিয়েছেন এমন নয়। শুনেছেন, শোনা শেষে বাড়ি চলে গেছেন। এই শ্রোতাদের আকৃষ্ট করার উপাদান রাজনীতিবিদদের বক্তৃতায় মনে হয় খুব বেশি থাকে না। মাঠের অভ্যন্তরে যারা হাততালি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন তারা একেবারেই দলীয়। তারা নানা কথায় মজা পায়, উল্লসিত হয়। তবে এদের ওপর ভরসার জায়গাটি এক ধরনের। কিন্তু এদের বাইরে যে বিশাল দর্শক শ্রোতা থাকেন তারা বক্তৃতার মর্মার্থ  উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধু ষাটের দশকে যে সব জনসভায় যোগদান করেছেন- তিনি তাঁর বক্তৃতায় তাদের জন্যে রাজনৈতিক চিন্তার খোরাক  রেখে আসতেন প্রচুর। ফলে সভা শেষে মানুষগুলো বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কথা নিয়ে আলোচনা করতে করতে বাড়ি যেতেন, বাড়িতে গিয়ে অন্যদের বুঝিয়ে বলতেন জনসভায় শেখ সাহেব কী বলেছেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর এক একটি জনসভার প্রভাব কতোটা সুদূরপ্রসারী হতো তা আজ বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবতে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া দল এখনও যদি সেই বিষয়গুলো গভীরভাবে ভাবনা চিন্তা করে দলগতভাবে এবং জাতীয়ভাবে সকলেই বর্তমান পরিস্থিতিতে উপকৃত হবেই- এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সংগঠনকে গভীরভাবে ভাবতে হবে দলের মেধাবী, আদর্শবান ও ত্যাগীদের কথা। বগুড়া অঞ্চলে সে রকম অনেকেই আছেন। তাদের যদি সংগঠনের বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়, কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়- তাহলে বগুড়া অঞ্চলে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়ানোর যথেষ্ট বাস্তবতা রয়েছে। আবার কিছু কিছু নেতা রয়েছেন- যাদের কারণে বগুড়ায় সংগঠন যেমন বিকশিত হচ্ছে না, জনসমর্থনও সেখানে সেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এ মুহূর্ত বগুড়ায় বিএনপিতে চরম হতাশা বিরাজ করছে- সেই মুহূর্তে জনসভায় শেখ হাসিনার উপস্থিতি, তাঁর বক্তৃতা আওয়ামী লীগের জন্যে একটি সম্ভাবনা সৃষ্টির সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে বিশাল জনসভা শেষে জনগণের কাছে দলকে নিয়ে যাওয়া না হলে, রাজনীতির মতাদর্শের বিষয়গুলো তুলে ধরা না হলে, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিস্তার রোধ না করতে পারলে, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটাতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ বিপদ রাজনীতিতে হানা দিতে পারে। শেখ হাসিনা দেশজুড়ে গণসচেতনতার পরিকল্পনা নিয়ে গণসংযোগ করলে রাজনীতিতে মোড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। সেটিই এই মুহূর্তে অনেক বেশি প্রত্যাশিত এবং জরুরি। এইচআর/এমএস

Advertisement