সাহিত্য

ময়না

নূরেম মাহ্পারা

Advertisement

একসময়ের প্রতাপশালী শেখ বংশের শেষ ভিটাটুকু আঁকড়ে আছেন মাসুদ আলী শেখ। শেখ উপাধি ছাড়া আর বলার মতো কিছুই নেই। না আছে আভিজাত্যের বাহার, না সেই জৌলুস। বারোঘড়িয়া গ্রামে ঈশান কোণে একটা ছোট্ট মাটির ঘরে সপরিবারে তার বাস। হঠাৎ দেখলে অবশ্য ঘর খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন! জিন কলার গাছ, দেবদারু আর পূর্বপুরুষদের লাগিয়ে যাওয়া তিনটি সুপারি আর চারটি নারকেল গাছ যেন শেখ বংশের করুণ হাল যত্নে লুকিয়ে রেখেছে।

মাসুদের স্ত্রীকে দেখলে মনে হবে তার নির্বাণ লাভ হয়েছে। জাগতিক সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে আরিফা। অন্যদিকে মাসুদের পেশাই স্বপ্নের চাষাবাদ করা। পাথরের মতো শক্ত মাটি চষে, নিজে হাতে বীজতলা পুঁতে অপেক্ষা করতে হয় কখন সোনালি ফসলে ভরে উঠবে মাঠ। স্বভাবতই মাসুদ একটা আশা কখনো বাদ দেয়নি। একটা ছেলে হলে ঠিক তার দিন ফিরে যাবে।

ঈশ্বরের ভাবনা হয়তো ভিন্ন কিছু ছিল। মাসুদের ঘরে পরপর চার মেয়ের জন্ম হয়। তিন মেয়েকে স্বামীর ঘরে পার করতে আরও বেশি দরিদ্র হয়ে পড়ে মাসুদ। আরিফার ভাবনা আরও সহজ হয়ে আসে। ছোট মেয়েকে কোনো রকম পাত্রস্থ করতে পারলে আর কী ভাবনা! আল্লাহর দিন ঠিকই এক হালে কেটে যাবে। না খাওয়ার স্বভাব তার অনেক আগেই হয়ে গেছে। আর যা কিছু শখ-আহ্লাদ ছিল, সেসব না পাওয়া আগেই সয়ে গেছে। যতদিন দৃষ্টি আছে, সেলাই করে দু’বেলার ভাত ঠিক জুটে যাবে।

Advertisement

বছর দশেক আগেও বারোঘড়িয়া গ্রামের চেহারা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন আর ঠিক গ্রাম বলা ঠিক হবে না। শহুরে বাতাস লেগেছে। ঘরে ঘরে প্রবাসী সন্তান। বিদেশি টাকায় উঠেছে দালান।

একসময় শেখ বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন সালামের মা। সালাম তখনো বসতে শেখেনি। মরিয়ম বেওয়া চটের বস্তার ওপরে সালামকে রেখে উঠান ঝাড়ু দেওয়া, কাপড় ধোয়া—আরও নানা কাজ করতেন। বাকি সময় চানাচুর বিক্রি করে বেড়াতেন পাড়ায় পাড়ায়। সেই সালাম এখন লক্ষাধিক টাকা দামের মোটরসাইকেল চড়ে। তার যোগাযোগেই অধিকাংশ মানুষ গেছে বিদেশে।

সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে বসে সালামকে দেখে সেসব স্মৃতি মাসুদের চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল। সালাম চায়ের দোকানেই আসছিল।: বড় ভাই, কেমন আছেন?: এই তো চলে যাচ্ছে। একটা ছেলে থাকলে বুড়ো বয়সটা নিশ্চিন্তে কাটাতে পারতাম।: ছেলে নাই তো কী হয়েছে! আপনার তো একটা মেয়ে আছে! সরকার এখন সুযোগ দিয়েছে, মেয়েরাও বিদেশে গিয়ে ভালো কাজ করে দেশে টাকা পাঠাতে পারে। কত জনকে পাঠালাম আমি!: তাই না-কি? কী করতে হয়? কী ধরনের কাজ?: খুব সহজ ভাই। আপনি যদি রাজি হন, আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।: কিন্তু আমার মেয়ে তো ছোট।: আপনার মেয়ে, তার আর ছোট কী! লক্ষ্মী মেয়ে, ঘরের কাজ সব জানবে নিশ্চয়ই। আপনার ঘরে থেকে এসব ঠিকই শিখে যাবে।: হ্যাঁ, তা তো জানেই। ওর মাকে খুব সাহায্য করে। সব কাজ জানে।: তাহলে আর কী! বাকি দায়িত্ব আমার।: খরচ কেমন লাগবে?: আপনি সুদের ওপর এক লাখ টাকা নেন। আমি চৌধুরীকে বলে দেব। বাকি দায়িত্ব আমার। ছয় মাসে আপনার টাকা শোধ হয়ে যাবে। তারপর যা আসবে, আপনার আর কিছু ভাবতে হবে না। পাঁচ বছর থেকে চলে আসবে, তারপর ভালো পাত্র দেখে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিলেন।এ কথোপকথনের পর মাসুদের মনে হয়, আল্লাহ নিজে সালামকে তার কাছে পাঠিয়েছেন। মাসুদ ফিরে আরিফাকে সব কথা জানায়। আরিফার সাহস হয় না। আবার শক্ত করে না বলতেও আটকায়।

পরদিনই মাসুদ চড়া সুদে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে সালামকে দেয়। সালামের আন্তরিকতায় মুগ্ধ না হয়ে থাকা যায় না। অবশ্য সালাম না থাকলে ময়নার বিদেশ যাওয়া অসম্ভব! ১৪ বছর বয়স লুকিয়ে ২২ বছর লিখিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করার জ্ঞান মাসুদের থাকলে তার এ দশা হতো না। সালাম ছিল বলেই সম্ভব হয়েছে। ভিসাও হয়ে গেল অল্প দিনেই। তিন মাসের মাথায় ময়না চলে গেল সৌদি আরব।

Advertisement

হিসাবে একটু সমস্যা ছিল। সুদের ঋণ শোধ হতে আট মাস সময় লাগে। দুই বছরে সত্যিই মাসুদের দিন ফিরে যায়। কিন্তু এরপর ময়না আর টাকা পাঠাতে পারেনি। ফোনে যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় তিন মাস এভাবে কাটে। আরিফার মনে সারাদিন কু ডেকে যায়। দেবদারু গাছের মাথায় কাকগুলোর ‘কা কা কা’ ডাক শুনলেই বুকের ভেতরে মুচড়ে ওঠে। মেয়ের জন্য মনটা হাহাকার করে।

ময়না সাজতে খুব পছন্দ করতো। মাসুদ মমিনপুর হাটে গেলে চুড়ি, ফিতা, মালা, টিপ কত কী যে এনে দিত! বাঁশের খুঁটির সঙ্গে ময়নার পছন্দের আয়নাটা এখনো ওভাবেই ঝুলছে। যতবার তাকায় আরিফার চোখ ভিজে যায়।

এক রাতে মাসুদের মোবাইলে ফোন আসে। বিদেশি নম্বর।: মাসুদ?: জ্বী।: সৌদি পুলিশ। আপনার মেয়েকে আহত অবস্থায় পাওয়া গেছে। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।মাসুদের পৃথিবী তখন থেমে গেছে। মাসুদ কোনো কথা বলতে পারে না।: আপনার মেয়ের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তার দুই পা, দুই হাত ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এক চোখ নষ্ট হয়ে গেছে।সালাম এ সংবাদ আগেই জেনেছিল। তাই বেশ কিছুদিন হলো তাকে গ্রামে দেখা যাচ্ছে না। মাসুদ জানে না কীভাবে সৌদি আরব যেতে হয়। কোথায় থাকে তার ময়না? কী করে ময়নার দিন কাটে? ময়না কী খায়? ময়নার কি বাড়ির জন্য মন কেমন করে?

আরিফা কখনো তার মেয়েদের সঙ্গে উঁচু স্বরে কথা বলেনি। ছেলে চাইলেও চার মেয়ে ছিল মাসুদের প্রাণ। প্রায় এক মাস চিকিৎসাধীন থাকার পরে ময়না মারা যায়। লাশ দেশে আসতে আরও সাত দিন কেটে যায়। মেয়ের লাশ নিয়ে যেতে দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় আসে মাসুদ। আরিফা এবারই প্রথম।

ময়না বাড়ি ছাড়ার পরে আরিফার মনে যে কথাটা সব সময় ঘুরপাক খেতো, অ্যাম্বুলেন্সে মেয়ের লাশ নিয়ে যেতে যেতে সেই কথাটা মুখে চলে এলো—কেন সেদিন বলিনি আমার মেয়ে কোথাও যাবে না, আমার কাছেই থাকবে!

পরদিন কাগজে ছাপা হয়, ‘গৃহকর্তার কুৎসিত প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সৌদি প্রবাসী কিশোরীকে নির্মমভাবে হত্যা।’

এসইউ/এমএস