ফিচার

নিপা ভাইরাস এড়িয়ে খেজুর রস খাওয়ার উপায়

শেখ আনোয়ার

Advertisement

ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। প্রতিবছর ঋতু পরিক্রমায় আসে শীত। এ মৌসুমে মানুষের রসনা তৃপ্তির জোগান দেয় খেজুর গাছ। গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক খেজুর গাছ। বলা হয়, ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’। খেজুর গাছকে বলা হয় মধুবৃক্ষ।

শীতের আগমনী বার্তা শুরু হলেই মধুবৃক্ষের ডালপালা কেটে পরিষ্কার করার পর দফায় দফায় গাছ কাটে গাছিরা। ধারালো দা হাতে মোটা দড়ি কোমরে বেঁধে পাখির মতো গাছি ঝোলেন গাছে। এরপর গাছ কেটে তাতে মাটির ভাড় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে বসানো হয় কঞ্চির নল। যা দিয়ে খেজুর গাছ থেকে সুমিষ্ট রস গড়িয়ে পড়ে ঝুলিয়ে রাখা মাটির পাত্রে।

খেজুর রস খুবই সুস্বাদু এক পানীয়। শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে রসের মগে চুমুক দেওয়ার স্বাদ অনবদ্য। বাংলাদেশের মানুষের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে খেজুর রস। পুরো শীতজুড়ে গ্রামীণ জীবনের প্রাত্যহিক এ উৎসব চলে আসছে আবহমান কাল ধরে।

Advertisement

শীতকালে শহর থেকে মানুষ দলে দলে গ্রামে ছুটে যায় খেজুরের রস খেতে। খেজুর রসের বিশেষত্ব হচ্ছে- যত শীত তত মিষ্টি। শীতকালে কাঁচা খেজুরের রস পান করতে এখন অনেকেই ভয় পান। কারণ নিপা ভাইরাস।

গাছ থেকে নামানো কাঁচা খেজুর রস পান করে বিগত কয়েক বছরে টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, যশোরসহ বিভিন্ন স্থানে মানুষ মারা গেছে। এমনকি অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

খেজুরের রস খেয়ে মানুষ মরে কেন?গবেষকরা কাঁচা খেজুরের রসে নিপা ভাইরাস থাকার সম্ভাবনার কথা বলেছেন। নিপা ভাইরাস বাদুড়ের মুখের লালা থেকে খেজুরের রসে আসে। এ ভাইরাস বহনকৃত বাদুড় খেজুর গাছে বাঁধা হাঁড়ি থেকে রাতে রস পান করার সময় তাদের জিহ্বা থেকে লালা ফেলে। ওই রস যখন কাচা খাওয়া হয়; তখনই নিপা ভাইরাসে সংক্রমিত হয় মানুষ।

বাদুড়ে খাওয়া কাঁঠাল বা অন্য ফলেও নিপা ভাইরাস স্থানান্তরিত হতে পারে। গবেষকদের মতে, এই নিপা ভাইরাস মিশ্রিত খেজুরের কাঁচা রস পান করলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কিংবা গুরুতর অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

Advertisement

নিপা ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ- ১. জ্বর২. মাথাব্যথা৩. সর্দি-কাশি৫. বমি৬. খিচুঁনি৭. অচেতন হওয়া ইত্যাদি।

আইসিডিডিআর’বি এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। প্রতিষ্ঠানটি আক্রান্ত এলাকা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে নিশ্চিত হয় যে, বাদুড়ই খেজুরের রস পান করার সময় নিপা ভাইরাস খেজুরের রসে ছড়ায়। খেজুরের রসের হাঁড়িতেও বাদুড়ের মল লেগে থাকতে দেখা যায়।

নিপা ভাইরাস সংক্রমিত রোগীর তেমন কোনো চিকিৎসা নেই। এ ভাইরাস তাপে মারা যায়। এজন্য রস আগুনে ৭০-৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপে উত্তপ্ত করে পান করা নিরাপদ। কাঁচা রস পান করা মোটেও নিরাপদ নয়।

শহরে খাঁটি খেজুর রস পাওয়া যায় না। রস খাঁটি কি-না তা নিয়ে সন্দেহ সব সময়ই রয়ে যায়। কারণ এক শ্রেণির রস বিক্রেতা খাঁটি রসের সঙ্গে পানিসহ অন্যান্য তরল মিশিয়ে এর পরিমাণ ও স্বাদ বাড়ানোর অপচেষ্টা করে। তাই খেজুর রস পান করার সময় এর স্বাদ ও খাঁটি কি-না তা পরীক্ষা করা দরকার।

তবে খেজুরের গুড় খেতে কোনো সমস্যা নেই। যদি সেটি হয় খাঁটি গুড়। শীত এলে বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি গ্রামের বাড়িতে রস জালিয়ে ভেজানো পিঠা ও পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। রস থেকে গ্রামে গ্রামে তৈরি হওয়া খেজুরের গুড় ও পাটালি সবচেয়ে উপাদেয়।

ভেজাল কিংবা চিনি মিশানো গুড়ও রয়েছে বাজারে। তবে দানাদার, ঝোলা ও নলেন গুড়ের স্বাদ ও ঘ্রাণ সবচেয়ে জনপ্রিয়। রসনা তৃপ্তিতে এর জুড়ি মেলা ভার। আগেই বলা হয়েছে, যত শীত তত মিষ্টি হয় খেজুরের রস। অসময়ে হাজারো চেষ্টা করেও শীত মৌসুমের আসল রস ও গুড় পাওয়া যাবে না। তাই শীত মৌসুমে সবাই খেজুরের রস, গুড় ও পাটালি সংগ্রহের জন্য একবছর অপেক্ষা করে থাকেন।

খেজুরের রস, গুড় ও পাটালির কদর প্রতিবছরই বাড়ছে। গ্রামাঞ্চলে বাড়ির আঙিনায় ও মাঠের জমির আইলে কিংবা বাগানে অযত্ন-অবহেলায় ও সম্পূর্ণ বিনা খরচে বেড়ে ওঠা মধুবৃক্ষ বা খেজুর গাছ টাকা রোজগারেরও উৎস হতে পারে।

প্রতি বছরে ৫ মাস খেজুর গাছ থেকে মিষ্টি রস সংগ্রহ করা হয়। খেজুর গাছ ৮ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত রস দেয়। এটাই তার বৈশিষ্ট্য। এর জন্য বাড়তি খরচ কিংবা আবাদি জমি নষ্ট করার প্রয়োজন পড়ে না।

সড়ক পথ, রেলপথ, জমির আইল, পতিত জমি ও বাড়ির আঙিনায় কোটি কোটি খেজুর গাছ লাগানো সম্ভব। খেজুর গাছ অন্যান্য ফসলেরও কোনো প্রকার ক্ষতি করে না। আমাদের সবার উচিত, তালগাছের মতো বেশি করে খেজুর গাছ লাগানো এবং তা যত্নসহকারে বড় করা।

খেজুর রসে লুকিয়ে রয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক বিরাট সম্ভাবনা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগ নেওয়া হলে দেশের চাহিদা পূরণ ছাড়াও প্রতিবছর বিদেশে গুড় ও পাটালি রফতানি করে অর্থ আয় করা সম্ভব বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

জেএমএস/এসইউ/এমকেএইচ