জাতীয়

করোনায় নারী-শিশু নির্যাতন : দায়ী মানসিকতা ও রাজনৈতিক প্রভাব

বাবা-মায়ের পছন্দেই পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার ধলেশ্বর গ্রামে বিয়ে হয় আমেনার। বিয়ের পর থেকে স্বামীর চাহিদামতো ধাপে ধাপে সাত থেকে আট লাখ টাকা যৌতুক দেয় মেয়ের পরিবার। তবুও প্রায়ই বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে দেয়ার জন্য আমেনাকে চাপ দিতেন স্বামী। চলত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এরই মাঝে আমেনার কোলজুড়ে আসে একটি মেয়ে শিশু। যার বয়স এখন পাঁচ বছর।

Advertisement

টাকার জন্য অব্যাহত নির্যাতন সইতে না পেরে গত বছরের শুরুর দিকে বাবার বাড়িতে চলে আসেন আমেনা। পরে গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে আবার স্বামীর বাড়িতে পাঠানো হয় তাকে। এরপর দ্বিতীয়বারের মতো গর্ভধারণ করেন তিনি। সবশেষ গত বছরের নভেম্বরে আবারও তাকে টাকার জন্য চাপ দেয় স্বামীর পরিবার।

নভেম্বরের ২ তারিখ ভোররাতে শ্বশুরবাড়ির পাশের একটি পুকুরে আমেনার মরদেহ ভেসে ওঠে। টাকার জন্যই স্বামী-শ্বশুর আমেনাকে হত্যা করেছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। প্রতিবেশীদের ভাষ্য, হঠাৎ করেই মেয়েটি যেন চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল শ্বশুরবাড়ির লোকজনের।

এ ঘটনায় নিহতের স্বামীসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এখন পর্যন্ত পলাতক আছেন মামলার অন্যতম আসামি আমেনার শ্বশুর।

Advertisement

যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে স্বামী-স্ত্রীর অভিনব প্রতিবাদ

আমেনার মতো দেশের বহু নারীকে এভাবেই বিয়ের পর টাকার (যৌতুক) দাবিতে নির্যাতন করে স্বামীর পরিবার। নির্যাতনের তীব্রতায় প্রাণ হারান অনেকেই। আবার কাউকে পরিকল্পিতভাবে হত্যাও করা হয়। ঘটনার পর ভুক্তভোগী পরিবারগুলো আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারলাভের চেষ্টা করতে থাকে। বিচারের আশায় থানা-আদালত ঘুরতে ঘুরতে দিশেহারা হয়ে পড়েন তাদের অনেকেই। কেউ কেউ কাঙ্ক্ষিত বিচার পান আবার কাউকে হতে হয় আসামি পক্ষের ক্ষমতার কাছে কোণঠাসা।

বর্তমান সময়ে ঘর থেকে শুরু করে রাস্তা, কর্মস্থল ও গণপরিবহনে নারীরা নির্যাতন, লাঞ্ছনা ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ধর্ষণ যেন পরিণত হয়েছে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায়। সমাজের সব শ্রেণি-পেশার নারীরাই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত। আবার প্রেমের প্রস্তাব কিংবা বিয়েতে রাজি না হলেও ধর্ষণ করা হচ্ছে, কুপিয়ে জখম করা হচ্ছে। কখনও কখনও অপরাধীর ছোড়া অ্যাসিড ঝলসে দিচ্ছে সুন্দর একেকটি মুখকে। প্রাপ্তবয়স্করা তো বটেই, নির্যাতনকারীদের কবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না ছোট মেয়েশিশুরাও। চলমান করোনাভাইরাস মহামারিতেও দেশে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা-নির্যাতনের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের (লিগ্যাল এইড উপপরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি) প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, সদ্যবিদায়ী বছরের নভেম্বরে সারাদেশে নির্যাতিত হয়েছে ৩৫১ জন নারী ও কন্যাশিশু। অক্টোবরে যে সংখ্যা ছিল ৪৩৬। তার আগের মাস সেপ্টেম্বরে নির্যাতনের শিকার হয় ৩৪০ জন নারী ও শিশু।

Advertisement

সাভারে যৌতুক না পেয়ে গৃহবধূকে ধারালো ব্লেড দিয়ে জখমের অভিযোগ

এসব তথ্যই জানিয়ে দিচ্ছে, করোনা মহামারির মধ্যেও নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। সবমিলিয়ে গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে মোট তিন হাজার ৬২ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যার মধ্যে অক্টোবরে সর্বোচ্চ ৪৩৬টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। নির্যাতিতদের অর্ধেকেরও বেশি (২২৫ জন) শিশু।

এদিকে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার ২২১টি।

নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ’ (সিডও) গৃহীত হয়। এই সনদে ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ।

এসব নির্যাতন বন্ধে সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন, যৌতুক নিরোধ আইন ও অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন প্রণয়ন করেছে। কিন্তু কঠোর বিধিমালা সত্ত্বেও নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা থেমে নেই বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সহিংসতা, নির্যাতনের ধরন পাল্টে ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

শুধু শারীরিকভাবেই নয় ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়তই নারী ও শিশুরা মানসিক নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছেন। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের পাশাপাশি প্রত্যেকের মাঝে নারী ও শিশুর প্রতি ক্ষমতা প্রদর্শনের সব ধরনের নেতিবাচক মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট নারীনেত্রী ও সংগঠকরা। একইসঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মত দেন তারা।

বাল্যবিয়ে ও নির্যাতনের শিকার বৃষ্টি এখন হাঁটতে পারে না

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতন, সহিংসতার ধরন পরিবর্তিত হচ্ছে। আমাদের নারীরা বাইরে নিরাপদ না, ঘরে নিরাপদ না। তারা আজ কোথাও নিরাপদ না। এর পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। সে জায়গা থেকে নির্যাতন প্রতিরোধে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশেষ করে যারা দেশ চালাচ্ছে তাদের এমপি থেকে শুরু করে স্থানীয় চেয়ারম্যানকে সমানভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।’

নারী নির্যাতন মামলাগুলোর দ্রুত বিচার ও আধুনিক ফরেনসিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তদন্তসহ নির্দিষ্ট সময়ে মামলাগুলো নিষ্পত্তির জন্য আলাদা আদালত প্রয়োজন বলে মনে করেন এই নারী সংগঠক।

নারী ও শিশু নির্যাতনের কারণ হিসেবে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফাওজিয়া মোসলেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুরুষের ক্ষমতা প্রদর্শন ও নারীর নীরব থাকার মানসিকতা এসব নির্যাতনের প্রধান কারণ বলে মনে করি। এছাড়া রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের জায়গা থেকেও নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা হয়ে থাকে।’

‘আমরা অনেকসময় দেখেছি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত থাকেন। এর পেছনের কারণ হচ্ছে, আমাদের জনপ্রতিনিধিরা জবাবদিহিতার মানসিকতা ধারণ করেন না। আর নারীর যে নীরব থাকার মনোভাব এখানেও আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। তবে নির্যাতনের শিকার ২০ শতাংশের মতো নারী এই নীরব থাকার প্রথা ভেঙে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন।’

নির্যাতন প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে এই নারীনেত্রী ও সংগঠক বলেন, ‘প্রথমেই আমাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের মানসিকতা পরিহার করতে হবে। আর যেহেতু আমাদের জনপ্রতিনিধিরা জবাবদিহিতার মুখোমুখি হন না তাই তাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এ জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে আইনের যে বিধান রয়েছে তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করতে হবে। আর যেহেতু এই ধর্ষণ, নির্যাতন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে সে জন্য আমাদের সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমাদের কিছু পুরুষ ভাই নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন, এর কারণ হচ্ছে সামাজিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা এখনও টিকে আছে। সে জায়গা থেকে নির্যাতন প্রতিরোধে পুরুষের ক্ষমতা প্রদর্শনের মানসিকতা পরিবর্তন, আইনের বাস্তবায়ন ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন।’

এওয়াইএইচ/এসএস/বিএ/এমএস