বিশেষ প্রতিবেদন

ঢাকায় মাটির কেজি ৩ টাকা!

প্রয়োজনে দু-চার মুঠো মাটিও শহরে কিনতে হয়, তা জানেন কি? হ্যাঁ, এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে যারা শহরের গাছপ্রেমী তাদের। গাছ লাগানোর জন্য নার্সারি থেকে তাদের মাটি কিনতে হয়, তাও চড়া দামে।

Advertisement

মাটির দেশে বিক্রি হওয়া মাটির দাম প্রতি বস্তা ১২০ টাকা। সেই বস্তায় সর্বোচ্চ ৪০ কেজি মাটি থাকে। অর্থাৎ কেজি হিসেবে দেখলে প্রতি কেজির দাম পড়ছে তিন টাকা। তাতে যদি সামান্য গোবর অথবা সার মেশানো থাকে তার জন্যও গুনতে হবে এক-দুই টাকা।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনের নার্সারিতে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় রফিক রাজ নামে এক গাছপ্রেমীর। তিনি বলেন, ‘হলের রুমে দু-একটা ক্যাকটাসের গাছ রাখব ভেবে এখানে কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু গাছ লাগানোর জন্য মাটির আলাদা দাম দিতে হচ্ছে। টাকা দিয়ে মাটি কিনতে হবে ভেবে খুবই অবাক লাগছে। একটি ছোট টবে দুই মুঠো মাটি ভরে দিয়ে আলাদা ২০ টাকা নিচ্ছে।’

কার্জন হলের সামনে ৩২টি নার্সারি রয়েছে। কথা হয় নার্সারির মাটি বিক্রেতাদের সঙ্গে। তারা জানান, রাজধানীতে মাটি সংগ্রহের কোনো উপায় নেই। বেশ চড়া দামে তারাও কিনছেন রাজধানীর বাইরে থেকে। এর মধ্যে সাভারের মাটি দোঁ-আশ বলে সবচেয়ে বেশি আসে সেখান থেকে।

Advertisement

আশপাশে কোথাও থেকে এনে বিক্রি করা যায় না? এমন প্রশ্নে ইস্টার্ন নার্সারির স্বত্বাধিকারী আবুল বাশার বেশ ক্ষিপ্তই হলেন। নিজেকে সামলিয়ে বললেন, ‘ঢাকায় কই পাবেন? কে দেবে আপনাকে? এখানে সবই তো কংক্রিটের ধুলাবালি। ওসবে গাছ হয় না।’

তিনি যোগ করেন, ঢাকার মাটির মান গাছ লাগানোর জন্য উপযুক্ত নয়। কনস্ট্রাকশনের সাইডে যেটুকু মাটি বের হয় সেগুলো বেশির ভাগ লালমাটি। ওসব গাছের জন্য কেউ নেবে না।’

পাশ থেকে এগিয়ে এসে ফয়সাল নামের আরেক বিক্রেতা বলেন, ‘প্রতি ট্রাক মাটি মানভেদে আট হাজার টাকায় কিনে আনি। এছাড়া লেবার খরচ আছে দুই দফা। এ টাকায় চাইলে এক ট্রাক ফল-ফুলও কেনা যাবে এদেশে। গ্রামে যান মাটি ফ্রিতে নিতে পারবেন। কিন্তু ঢাকায় মাটি বহু দামি।’

আসলেই তাই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল তেমনটা। ছোট্ট এক পিকআপে সর্বোচ্চ ৪০ বস্তা মাটি থাকে। যার দাম আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। বড় এক ট্রাকে প্রায় একশ বস্তা মাটি নেয়া যায়। তার জন্য গুনতে হবে এলাকাভেদে ছয় থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত।

Advertisement

ঢাকার এসব দোকানে প্রতিদিন মাটির কাটতিও কিন্তু কম নয়। অভিজাত এলাকায় আরও বেশি। উত্তরার গ্রিন ইউনিভার্স নার্সারি প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুই হাজার টাকার শুধু মাটি বিক্রি করে। গাছ লাগানোর মৌসুমে বিক্রি আরও বেড়ে যায়। কারণ ওই সময় চাহিদা বেশি থাকে।

ওই নার্সারির স্বত্বাধিকারী হাসান জানান, তিনি অনলাইনেও মাটি বিক্রি করছেন দেড়-দুই বছর ধরে। নার্সারির ফেসবুক পেজের অর্ডারের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে সাপ্লাই দেয় তার প্রতিষ্ঠান। তার জন্য ডেলিভারির আলাদা চার্জ দিতে হয় ক্রেতাকে।

ঢাকার মধ্যে আগারগাঁও এলাকায় রয়েছে বেশকিছু পুরোনো নার্সারি। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাটির সবচেয়ে বড় ক্রেতা এখন ছাদ কৃষকরা। গত সাত-আট বছরে ছাদবাগানের সবজি ও ফলের চাষ খুবই বেড়েছে। সুনির্দিষ্ট সংখ্যা না থাকলেও সরকারি হিসাবে গত বছর পর্যন্ত নগরে ছাদবাগানের সংখ্যা সাড়ে ছয় হাজারের বেশি। তাদের জন্যই এ বাজার অনলাইন-অফলাইনে জমজমাট।

সেখানে এনামউদ্দিন নামের এক ছাদ কৃষক জানান, তার এক হাজার ৬০০ স্কয়ার ফুটের বাগানের জন্য মাটির পেছনে ব্যয় হয়েছে ২৮ হাজার টাকা। নিজে ঢাকার বাইরে গিয়ে গুণগত মানসম্পন্ন মাটি সংগ্রহ করেন।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বাবুল চন্দ্র সরকার দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ছাদকৃষি নিয়ে। এসব বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।

তিনি বলেন, গাছের জন্য মাটি একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মাটি থেকে গাছ ১৬ ধরনের খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে। এর মধ্যে ছয়টি প্রাকৃতিক ও সারের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হলেও বাকি ১০টি উপাদান মাটিতে না থাকলে কোনো ধরনের ফলন হবে না।

বাবুল চন্দ্র সরকার বলেন, শহরে লেড-ক্যাডমিয়ামের মতো বিষাক্ত উপাদান মাটিতে মিশে থাকতে পারে, যা গাছের ক্ষতি করে। এসব বিবেচনায় গাছের জন্য গুণগত মাটির বাজারের বড় চাহিদা তৈরি হয়েছে।

এনএইচ/বিএ/এমকেএইচ