ধর্ম

মুসলিম বিশ্বে আলোচিত-সমালোচিত যেসব ঘটনা

দুঃখ বেদনা ও মহামারির বছর ২০২০। বছরজুড়ে নানা কারণে বছরটি ছিল আলোচিত। মহামারির করোনার কারণে বহুল আলোচিত ঘটনার জন্য যুগের পর যুগ মানুষ বিদায়ী বছর ২০২০ সালকে স্মরণ করবে। করোনা আক্রান্ত বছরজুড়ে ইসলাম ও মুসলিমদের বহুল আলোচিত-সমালোচিত ঘটনাও ঘটেছে।

Advertisement

- মসজিদে আজানে পরিবর্তনমধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতের ধর্ম মন্ত্রণালয় মহামারি করোনার কারণে প্রথম মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বাসায় নামাজ পড়ার ঘোষণা দেন। দীর্ঘদিন পর হাদিসের অনুসরণে আজানের শব্দ পরিবর্তন করা হয়। আজানে ‘হাইয়া আলাস সালাহ’ (নামাজে আসো) এর স্থলে মুয়াজ্জিন বলছেন- ‘আল-সালাতু ফি বুয়ুতিকুম’। অর্থাৎ ‘আপনারা বাড়িতে নামাজ পড়ুন।’

তারপর আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ অনেক দেশেও আজানের শব্দ পরিবর্তন করে ঘোষণা করা হয়। পবিত্র নগরী মক্কায়ও আজানের শব্দ ‘হাইয়্যা আলাস-সালাহ’ পরিবর্তন করে তদস্থলে ‘সাল্লু ফি রিহালিকুম’ অর্থাৎ ‘তোমরা আবাস স্থলেই (বাড়িতে) নামাজ আদায় করে নাও’ বলে আহ্বান করা হয়।

- মসজিদে নামাজ স্থগিতমহামারি করোনার কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী মসজিদে নামাজ পড়া স্থগিত করা হয়। বাংলাদেশে ২৬ মার্চ থেকে পুরোপুরি লকডাউন শুরু হয় সারা দেশে। জনসমাগম এড়াতে দেশের সব মসজিদে জুমআ ও ওয়াক্তিয়া নামাজ সীমিত আকারে আদায়ের নির্দেশনা জারি করা হয়। আরববিশ্বসহ অনেকে দেশের মসজিদে নামাজ স্থগিত থাকে।

Advertisement

- বন্ধ থাকা মসজিদে পুনরায় আজান চালুমহামারি করোনার সময় যখন বিশ্বের অনেক মসজিদে নামাজ স্থগিত কিংবা সীমিত আকারে নামাজের নির্দেশনা দেয়া হয়, তখন বিশ্বের এমন অনেক দেশের মসজিদে মাইকে উচ্চ আওয়াজে আজান দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে, যেখানে এমনিতেই আজান দেয়া নিষিদ্ধ। এ তালিকায় রয়েছে- স্পেন, জার্মানি, কানাডা, নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশ।

- ওমরাহ স্থগিতমহামারি, আক্রমণ ও ষড়যন্ত্রের কারণে পবিত্র নগরী মক্কায় ৪০ বারেরও বেশি বন্ধ ছিল হজ। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় ৮ মাস ওমরাহ বন্ধ থাকার ঘটনার সাক্ষী ২০২০ সাল। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ থেকে ওমরাহ বন্ধ করা হয়।

মহামারি করোনার ভাইরাস থেকে কাবা শরিফ ও মসজিদে হারামকে মুক্ত রাখতে নেয়া হয় কঠোর পদক্ষপ। কাবা শরিফের চার পাশে নিরাপত্তা দেয়াল দেয়া হয়। বন্ধ রাখা হয় কাবা শরিফ স্পর্শ ও হাজরে আসওয়াদে চুম্বন। যা এখনও চলছে।

প্রায় ৮ মাস পর ৪ অক্টোবর ওমরাহ শুরু হলেও নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যেই রয়েছে পবিত্র কাবা শরিফ ও হাজরে আসওয়াদ। এখনও কারো জন্য কাবা শরিফ স্পর্শ করার সুযোগ হয়নি।

Advertisement

- মুসলিম দেশের হজে না যাওয়ার সিদ্ধান্তমহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে সবচেয়ে বেশি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশই হজে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এ তালিকায় প্রায় ১০টির বেশি দেশ হজে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। তারা হলো- ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, লন্ডনসহ আরো অনেক দেশ। অবশেষে সৌদি আরব বহিঃবিশ্বের লোকদের হজে অংশগ্রহণ সুযোগ রাখেনি।

- সীমিত আকারে হজবহু জল্পনা-কল্পনা ও সংকার মাঝে অভিনব পদ্ধতিতে কঠোর নিরাপত্তায় সীমিত আকারে অনুষ্ঠিত হয়েছে হজ। তবে বহিঃবিশ্বের কেউ হজে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। সর্বাধিক ১০ হাজার হাজির অংশগ্রহণে হজ অনুষ্ঠিত হয়। তবে অনেকে হজে অংশগ্রহণকারী সংখ্যার ব্যাপারে একাধিক মতামত উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন ১০০০ (একহাজার) ব্যক্তি হজে অংশগ্রহণ করেছেন।

- জুমআ ও জামাআত নিয়ন্ত্রণপ্রায় সব দেশের মসজিদে দীর্ঘ প্রায় কয়েক মাস যাবত মসজিদে জুমআ ও বড় জামাআত অনুষ্ঠিত হয়নি। সবদেশের ইসলামিক পন্ডিতদের মতানুসারে কঠোর নিরাপত্তায় সমীতি পরিসরে নামাজের সিদ্ধান্ত হলেও অনেক দেশের মসজিদে দীর্ঘ স্থগিত ছিল নামাজ ও জামাআত।

বাংলাদেশের আলেম-ওলামাদের পরামর্শক্রমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন মসজিদে জুমআ ও জামাআতের ব্যাপারে ৫ থেকে সর্বাধিক ১০ জনের অনুমতি দেয়।

- কাবা শরিফ ও মদিনায় জামাআত, তারাবিহ ও তাহাজ্জুদে ছাড়পবিত্র কাবা শরিফ ও মদিনার মসজিদে নববিতে দীর্ঘদিন দায়িত্বশীল, স্বেচ্ছাসেবক, নির্ধারিত ইমাম-মুয়াজ্জিন ও আইনশৃঙ্ক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়া কেউ জুমআ ও জামাআতে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। অন্যান্য বছরের ন্যয় তারাবিহ ও তাহাজ্জুদ ২০ রাকাআত অনুষ্ঠিত হয়নি। ইমামদের নামাজ পড়ানোর সময়সূচিতেও আনা হয়েছে পরিবর্তন।

- রমজানে খতম তারাবিহ বন্ধমহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরুতে লকডাউনের সময় দরজায় কড়া নাড়ে রহমত বরকত মাগফেরাত ও নামাজের মাস রমজান। মুমিন মুসলমানের বহুল প্রতিক্ষীত খতম তারাবিহ অনুষ্ঠিত হয়নি কোনো মসজিদে। ঘরোয়াভাবে খতম তারাবিহ ছাড়া আনুষ্ঠানিকভাবে উল্লেখ করার মতো কোনো মসজিদেই এ বছর খতম তরাবিহ অনুষ্ঠিত না হওয়ার নজিরবিহীন ঘটনার বছর ২০২০ সাল।

- ঈদের জামাআতে নিয়ন্ত্রণরমজান পরবর্তী ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা কোনোটি সেভাবে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আনন্দঘন পরিবেশে উদযাপিত হয়নি। কঠোর নিরাপত্তা ও ব্যাপক স্বাস্থ্যবিধি মেনেই বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয় এ দুই অনুষ্ঠান।

- ঐতিহাসিক আয়া-সোফিয়া মসজিদে রূপান্তরমহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই দীর্ঘ ৮৬ বছর আপন পরিচয়ে ফিরেছে তুরস্কের ঐতিহাসিক আয়া সোফিয়া মসজিদ। তুরস্কের সর্বোচ্চ আদালত এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে এটিকে পুনরায় জাদুঘর থেকে মসজিদ হিসেবে প্রত্যাবর্তনের অনুমোদন দেয়া। মহামারি করোনার মধ্য দিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানসহ অনেকেই ২৪ জুলাই ২০২০ জুমআয় অংশগ্রহণ করেন।

- দখলদার ইসরাইলের সঙ্গে আরবদেশের সম্পর্ক স্থাপনমজলুম মুসলিম জনপদ ফিলিস্তিনের ওপর জুলুম নির্যাতন ইস্যুতে ইসরাইলের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে আরব ও মুসলিম বিশ্ব সরব ও নিরব প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। সরব ও নিরব প্রতিবাদের বেড়াজাল থেকে বিষে ভরা ২০২০-এ এসে কিছু আরব রাষ্ট্র ইসরাইলের সঙ্গে চুক্তি ও সুসম্পর্ক স্থাপনে সাড়া দেয়। আরব আমিরাত এ প্রক্রিয়া শুরু করার পর তাতে সাড়া দেয়, বাহরাইন ও মরক্কো। মুসলিম বিশ্বের জন্য এটি একটি কলংকজনক অধ্যায়।

- বিশ্বনবিকে অবমাননামহামারি করোনার এ সময়ে যখন বিশ্বজুড়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী মহামারি প্রতিরোধে ব্যস্ত সব দেশ ও জনপদ। ঠিক সেই সময়টিতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট অ্যামানুয়েল ম্যাক্রো বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে তুলে ধরে ধৃষ্টতাপূর্ণ ঘৃণ্য বক্তব্য। মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যঙ্গচিত্র অঙ্গন ও তা দেশটির রাষ্ট্রীয়ভবনসহ দেয়ালে দেয়ালে লাগানোর বিষয়টি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়। আর এতে নিজ দেশসহ বিশ্ববাপী চরম নিন্দিত ও ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয় ম্যাক্রোঁ।

- ফরাসি পণ্য বয়কটবিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবমাননার ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের পর বিশ্বজুড়ে ফরাসি পণ্য বয়কটের আহ্বানে এগিয়ে আসে পুরো বিশ্ব। ফরাসি পণ্য বয়কটের এ ডাকে শুধু মুসলিমরাই নয়, বহু ইয়াহুদি, খ্রিস্টান এবং ভিন্নধর্মী লোকেরাও অংশ নেয়। পণ্য বয়কটের ফলে দেশটির অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। অবশেষে ৩১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে নিজের বিদ্বেষী মন্তব্য থেকে পিছু হটতে বাধ্য হন ফরাসি প্রেসিডেন্ট অ্যামানুয়েল ম্যাক্রোঁ।

- করোনায় মৃতদের জানাজামহামারি করোনার সময়ে মৃতব্যক্তির জানাজা নিয়ে ব্যাপক হয়রানির শিকার হয় মানুষ। করোনায় মৃত সন্দেহে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে মানুষের লাশ। ভয়ে কেউ দাফন কিংবা সৎকার করতে এগিয়ে আসার সাহসও পায়নি। বিশেষ পোশাক পরে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সতর্কতার সঙ্গে মৃতব্যক্তির গোসল, জানাজা, দাফন কিংবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সৎকার কাজের বিষয়গুলোও ছিল আধুনিক যুগে বিরল ঘটনা।

স্মরণকালের সাক্ষী হয়ে থাকবে ২০২০ সালের এসব ঘটনা। যেখানে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পর্যায়ে এসব কাজগুলো করতে হয়েছে। যা সমকালীন ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

এমএমএস/এমএস