আইন-আদালত

বিচার শুরু আবরার হত্যার, করোনা চিকিৎসার প্রতারকও কাঠগড়ায়

বিদায়ের একেবারে শেষ লগ্নে ২০২০ সাল। করোনা মহামারির মধ্যেও খুন, দুর্নীতি, অনিয়মসহ নানা ঘটনার মামলায় ব্যস্ত ছিল ঢাকার আদালত পাড়া। এ বছর আলোচনায় ছিল বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলা, সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে মামলা, করোনার চিকিৎসায় জালিয়াতি সংক্রান্ত মামলাসহ বিভিন্ন অপরাধের বিচার কার্যক্রম।

Advertisement

বিদায়ী বছর ঢাকার আদালত পাড়ায় যেসব আলোচিত মামলার বিচারকার্য হয়েছে, তা নিয়ে তিন পর্বের সালতামামির আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব।

বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যা মামলার বিচার শুরু২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার মামলায় ২৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়েছে গত ১৫ সেপ্টেম্বর। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ফলে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে । বর্তমানে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের অবস্থায় রয়েছে।

ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার জেরে আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ডেকে নেয় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এরপর রাত ৩টার দিকে বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরদিন ৭ অক্টোবর দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে আবরারের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।

Advertisement

ওই ঘটনায় তার বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান।

অভিযুক্ত ২৫ জনের মধ্যে এজাহারনামীয় ১৯ জন এবং তদন্তে প্রাপ্ত এজাহারবহির্ভূত ছয়জন রয়েছেন। এজাহারভুক্ত ১৯ জনের মধ্যে ১৬ জন এবং এজাহারবহির্ভূত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারদের মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আটজন। মামলার তিন আসামি এখনো পলাতক।

৪ কোটি টাকা আত্মসাতে এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিচার শুরুফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) থেকে চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলায় গত ১৩ আগস্ট সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়। অভিযোগ গঠনের ফলে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।

গত বছরের ১০ জুলাই দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকায় মামলাটি করা হয়। দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন এ মামলার বাদী। ফারমার্স ব্যাংকের দুটি হিসাব থেকে চার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে জালিয়াতির ‘প্রমাণ’ পাওয়ার তথ্য গত বছরের অক্টোবরে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।

Advertisement

ঘুষ ও অর্থপাচার মামলায় সাবেক ডিআইজি পার্থের বিচার শুরুঘুষ গ্রহণ ও অর্থপাচার আইনের মামলায় বরখাস্ত হওয়া সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজনস) পার্থ গোপাল বণিকের বিরুদ্ধে গত ৪ নভেম্বর অভিযোগ গঠন হয়। ঢাকার বিশেষ জজ-১০ এর বিচারক নজরুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ফলে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে । বর্তমানে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের অবস্থায় রয়েছে।

২০১৯ সালের ২৮ জুলাই রাজধানীর ধানমন্ডির ভূতের গলি এলাকার পার্থ গোপাল বণিকের নিজ ফ্ল্যাট থেকে ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় পরদিন ২৯ জুলাই দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ পার্থ গোপাল বণিককে আসামি করে এ মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল। ২৪ আগস্ট মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. সালাউদ্দিন এ চার্জশিট দাখিল করেন।

অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় ডিআইজি মিজানসহ চারজনের বিচার শুরুঅবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমানসহ চারজনের বিরুদ্ধে গত ২০ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার ৬ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আসিফুজ্জামান। এর ফলে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।

গত ৩০ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদ এ চার্জশিট দাখিল করেন। মিজান ছাড়া চার্জশিটভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন- ডিআইজি মিজানের স্ত্রী সোহেলিয়া আনার রত্না ওরফে রত্না রহমান, ছোট ভাই মাহবুবুর রহমান এবং ভাগনে মাহমুদুল হাসান। মাহমুদুল হাসান রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় এসআই হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

তথ্য পাচার ও ঘুষের মামলায় মিজান-বাছিরের বিচার শুরুঅবৈধভাবে তথ্য পাচার ও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় সাময়িক বরখাস্ত হওয়া পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমান ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে ১৮ মার্চ অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম। ফলে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। বর্তমানে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।

মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার থাকাকালে বিয়ে গোপন করতে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ত্রীকে গ্রেফতার করানোর অভিযোগ ওঠে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে। এছাড়া এক সংবাদ পাঠিকাকে প্রাণনাশের হুমকি ও উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে মিজানুরের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) হয়।

নারী নির্যাতনের অভিযোগে ২০১৯ সালের জানুয়ারির শুরুর দিকে তাকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদরদফতরে সংযুক্ত করা হয়। এরপর ওই বছরের ২৪ জুন সম্পদের তথ্য গোপন ও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মিজানুরের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এর অনুসন্ধান কর্মকর্তা ছিলেন দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির।

মামলার তদন্ত চলাকালে ডিআইজি মিজান অভিযোগ করেন, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে রেহাই দিতে দুদকের পরিচালক এনামুল বাছির তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। এ অভিযোগ ওঠার পর বাছিরকে সরিয়ে দুদকের আরেক পরিচালক মো. মঞ্জুর মোরশেদকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে দুদকের পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্যাকে প্রধান করে তিন সদস্যের দলকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়।

পরে ওই বছরের ১৬ জুলাই মিজান ও বাছিরের বিরুদ্ধে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এ মামলাটি করেন দুদকের পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্যা।

সাবেক ডিআইজি বজলুর বিচার শুরু তিন কোটি ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ৯০২ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় কারা অধিদফতরের সাময়িক বরখাস্ত উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বজলুর রশীদের বিরুদ্ধে ২২ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার বিশেষ জজ-৫ এর বিচারক ইকবাল হোসেন। ফলে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। এ মামলাটিও এখন সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।

২৬ আগস্ট মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মো. নাসির উদ্দীন ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে বজলুর রশীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এতে বলা হয়েছে, বজলুর রশীদ রূপায়ন হাউজিং স্টেট থেকে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী রোডের ৫৫/১ (পুরাতন) ৫৬/৫৭ (নতুন) নির্মাণাধীন স্বপ্ননিলয় প্রকল্পের ২৯৮১ বর্গফুট আয়তনের অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন। ইতোমধ্যে তিনি অ্যাপার্টমেন্টের মূল্যবাবদ তিন কোটি আট লাখ টাকা পরিশোধ করেন। এ অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়বাবদ বজলুর রশীদ যে টাকা পরিশোধ করেছেন, এর স্বপক্ষে তিনি কোনো বৈধ উৎস দেখাতে পারেননি।

এমনকি তিনি অ্যাপার্টমেন্টের ক্রয়-সংক্রান্ত কোনো তথ্য তার আয়কর নথিতে দেখাননি। পরিশোধিত তিন কোটি আট লাখ টাকা জ্ঞাত আয় উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। সব মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রায় সোয়া তিন কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ দুদক আইন ২৭ (১) ধারায় চার্জশিট দাখিল করা হয়।

সাবরিনা-আরিফসহ ৮ জনের বিচার শুরু করোনাভাইরাস পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে করা মামলায় জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী ও সিইও আরিফুল হক চৌধুরীসহ আটজনের বিরুদ্ধে গত ২০ আগস্ট অভিযোগ গঠন করেন ঢাকা মহানগর হাকিম সরাফুজ্জামান আনছারী। ফলে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। মামলাটি বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণের অবস্থায় রয়েছে।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় করোনা শনাক্তের জন্য নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করেই জেকেজি হেলথ কেয়ার ২৭ হাজার মানুষকে রিপোর্ট দেয়। এর বেশিরভাগই ভুয়া বলে ধরা পড়ে। এ অভিযোগে গত ২৩ জুন অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে দেয়া হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা করা হয় এবং দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ৫ আগস্ট ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে দুপুরে সাবরিনা ও আরিফসহ আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন ডিবি পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী। চার্জশিটে সাবরিনা ও আরিফকে প্রতারণার মূলহোতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাকিরা প্রতারণা ও জালিয়াতি করতে তাদের সহযোগিতা করেছেন।

জেএ/এমআরআর/এইচএ/এমকেএইচ