আজ সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে কালেরগর্ভে হারিয়ে যাবে আরো একটি বছর। শুক্রবার সূর্যোদয়ের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব বরণ করবে নতুন বছর ২০২১ সালকে। পুরোনো জীর্ণতা, শোক আর ব্যর্থতা মুছে নতুন দিগন্তের আশায় নতুন বছর শুরু করবে মানবজাতি।
Advertisement
শেষ দিনে হিসাব মেলানোর পালা- কি পেলাম বিদায়ী বছর ২০২০ সালে? কি অপূর্ণতা থাকলো। হারালামই বা কি? ২০২০ সালের মতো ভয়ংকর বছর মানুষ অতীতে দেখেনি কখনো সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
করোনাভাইরাস নামক মহামারি কাঁপিয়ে দিয়েছে বিশ্ব, এখনো কাঁপাচ্ছে। একটি অদৃশ্য ভাইরাস এভাবে মানব সভ্যতার নাভিঃশ্বাস উঠিয়ে ছাড়বে সেটা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ধারণারও বাইরে।
করোনাভাইরাস এখনো দাপটে বিশ্ব শাসন করছে। এর ভবিতব্য কি সেটা অনুমেয় নয়। বিদায়ী বছরটা করোনার কারণেই মানুষের মনে ক্ষত রেখে যাবে দীর্ঘদিন। মানুষ আগামী প্রজন্মের কাছে এই ভয়াবহতার গল্পটি শোনাবে দীর্ঘদিন।
Advertisement
এই ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে অসংখ্য মানুষের প্রাণ। এখনো নিচ্ছে। এর শেষ কোথায় সেটা অজানা। বিজ্ঞান তার সর্বোচ্চ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে। এর মধ্যেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে বয়ে গেছে মৃত্যুর মিছিল।
বিদায়ী বছরে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনও হারিয়েছে অনেক তারকা। তাদের কারো প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করোনা, কারো মৃত্যু অন্য কোনো কারণে। ২০২০ সালে বাংলাদেশও হারিয়েছে ক্রীড়াঙ্গনের একঝাঁক তারকা। যারা যে যার খেলায় ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কারো কারো নামের সঙ্গে যোগ হয়েছিল ‘কিংবদন্তী’ শব্দটিও।
ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, ভলিবলসহ বেশ কয়েটি খেলার অনেক সাবেক তারকা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন বিদায়ী বছরে। যাদের মধ্যে সবার আগে আসবে বাদল রায়, এহতেশাম সুলতান ও নওশেরুজ্জামানের নাম।
মে মাসে ফুটবল অঙ্গনে পরপর দুইদিন দুঃসংবাদ হয়ে আসে দুই সাবেক খেলোয়াড়ের মৃত্যু। কয়েক বছর রোগভোগের পর ৩০ মে মারা যান জাতীয় দল ও আবাহনীর সাবেক খেলোয়াড় গোলাম রব্বানী হেলাল। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত আবাহনীতে খেলা এ ফরোয়ার্ড মারা যান ৬৩ বছর বয়সে।
Advertisement
পরের দিনই মৃত্যু সংবাদ হয়ে আসেন জাতীয় দলের আরেক সাবেক ফুটবলার এসএম সালাউদ্দিন। নারায়নগঞ্জের এ ফুটবলার মোহামেডান, ফরাশগঞ্জ, ওয়ান্ডারার্স, বিজেএমসি ও আদমজীতে খেলেছেন আশির দশকে। প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে লাল দলের এবং ৯০-এ বেইজিং এশিয়ান গেমস ফুটবলে বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন সালাউদ্দিন।
১৪ জুন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান নব্বইয়ের দশকের মাঝমাঠের কৃতি ফুটবলার নুরুল হক মানিক। ১৯৮৫ সালে আরামবাগের জার্সিতে শুরু করে ইয়ংমেন্স, ব্রাদার্স ও মোহামেডানে খেলেছেন মানিক। জাতীয় দলে খেলেছেন দীর্ঘ ১০ বছর। করোনার সময়ে জ্বর, ঠান্ডা ও গলাব্যাথা হলে করোনা পরীক্ষা করিয়েছিলেন মানিক। ফলাফল পাওয়ার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
বিদায়ী বছরে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের দুইজন সদস্য ইন্তেকাল করেছেন। একজন লুৎফর রহমান ও অন্যজন নওশেরুজ্জামান। লুৎফর রহমান ২০১৮ সালে মস্তিষ্কে রক্ষণ হওয়ার পর অনেক দিন ভুগেছিলেন পক্ষাঘাতে। তার চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩০ লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছিলেন। ২৯ জুন মারা যান তিনি।
করোনাক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে আইসিউতে থেকে ২১ সেপ্টেম্বর মারা যান স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের আরেক সদস্য নওশেরুজ্জামান। তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তিনি কেবল ফুটবলার হিসেবেই পরিচিত ছিলেন না, দীর্ঘদিন ক্রিকেট খেলেছেন জাতীয় পর্যায়েও।
ফুটবল অঙ্গনের অতি প্রিয়মুখ বাদল রায় মারা যান ২২ নভেম্বর। মাঠ কাঁপানো জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এ তারকা ফুটবলারের ২০১৭ সালে মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হলে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা করিয়ে আনা হয়েছিল। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তার লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে। তার আগে তিনি করোনায়ও আক্রান্ত হয়েছিলেন।
১৯৭৭ সালে মোহামেডানের জার্সিতে ঢাকার ফুটবলে অভিষেক হয়েছিল বাদল রায়ের। দীর্ঘ এক যুগ সাদা-কালো জার্সিতে খেলেছেন। জাতীয় দলে খেলেছেন টানা ৫ বছর। খেলা ছেড়ে তিনি সংগঠক হয়ে দীর্ঘদিন ফুটবল উন্নয়নে কাজ করেছেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটির কোষাধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেছেন।
১২ জুন মারা গেছেন দেশের ফুটবলের একমাত্র ট্রিপল হ্যাটট্রিকম্যান ওয়াহিদুজ্জামান ময়না। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে ইন্তেকাল করেছেন তিনি। ১৯৭৫ সালে আউটার স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় বিভাগ লিগে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ৯-০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ স্পোর্টিং ক্লাবকে। ওই ম্যাচে ৯টি গোলই করেছিলেন তিনি।
এ বছরই ফুটবল হারিয়েছে দেশের অভিজ্ঞ, জনপ্রিয় ও আলোচিত রেফারি আবদুল আজীজকে। ফিফার সাবেক এ রেফারি প্রথমে হৃদরোগ ও পরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৬৮ বছর বয়সে মারা যান ২৭ অক্টোবর।
১৯৭৪ সালে সহকারী রেফারি হিসেবে প্রথম ফুটবল ম্যাচ চালিয়েছিলেন আবদুল আজীজ। ২৮ বছর বয়সে তিনি ফিফা ব্যাজ পান। ১৯৮১ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত তিনি ফিফা রেফারি হিসেবে ২৮টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেন। ঘরোয়া ফুটবলে তিনি পাঁচশ’র বেশি ম্যাচে রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ বছর দুইজন কিংবদন্তি ক্রিকেটারেরও মৃত্যু হয়েছে। একজন দেশের প্রথম বাঁ-হাতি স্পিনার রামচাঁদ গোয়ালা, অন্যজন এএসএম ফারুক। রামচাঁদ গোয়ালা মারা যান ১৯ জুন। সাবেক এই বাঁ-হাতি স্পিনার এবং বাঁহাতি ব্যাটসম্যান তার পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ময়মনসিংহের পন্ডিতপাড়া ক্লাবের হয়ে। পরে ঢাকার ক্রিকেটে ২০ বছর দাপটের সঙ্গে খেলেছেন । এর মধ্যে ১২ বছর খেলেছেন আবাহনী ক্রীড়া চক্রে।
১৮ সেপ্টেম্বর ৭৫ বছর বয়সে মারা যান সাবেক ক্রিকেটার ও জাতীয় দলের সাবেক ম্যানেজার এএসএম ফারুক। সত্তর দশকের শেষ দিকে খেলোয়াড়ী জীবনের ইতি টানার পর বিসিবির সদস্য ও ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে সুনাম ছিল তার।
দেশের হকির অন্যতম সেরা তারকা জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত এহতেশাম সুলতান মারা গেছেন ১৭ আগস্ট। ১৯৬৮ থেকে ৭০ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হকি টেস্ট সিরিজে খেলেছেন। অবসরের পর দীর্ঘদিন জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া হকি ফেডারেশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেও দেখা গেছে তাকে।
সত্তর দশকে ট্র্যাক মাতানো অ্যাথলেট কাজী জাহেদা আলী মারা যান ৩০ এপ্রিল। ১৯৭৯ সালে অ্যাথলেটিকসে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি।
২৬ মে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন কারাতে জাতীয় দলের কোচ হুমায়ুন কবীর জুয়েল। দেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনার রেকর্ড ছিল তার।
বিদায়ী বছরে ক্রীড়াঙ্গন আরো যাদের হারিয়েছেন তারা হলেন- জাতীয় ভলিবল কোচ গোলাম রসুল মেহেদী, সংগঠক ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক সচিব এএইচএম সামসুল ইসলাম, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেডের সাবেক সভাপতি আব্দুল মোনেম খান, কাবাডি ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লা, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মবিনুল ইসলাম, ক্রীড়া সাংবাদিক আবদুল হান্নান খান, মাহমুদুল হাকিম অপু ও মোস্তাক আহমেদ খান।
আরআই/আইএইচএস/এমকেএইচ