হাসপাতাল থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে শহরের বাইরে সুনসান জঙ্গলের মাঝে অবস্থান ঠাকুরগাঁও জেলার একমাত্র মর্গটির। ভেতরে নেই পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা। নেই আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি। সেকেলে পদ্ধতিতে হাতুড়ি, বাটাল, করাত আর ছেনি ব্যবহার করে কাটা হয় মরদেহ। ঝোপঝাড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা মর্গটির অবস্থাও যেন কাঁটা-ছেড়া করা মরদেহের মতোই করুণ। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে একবারও সংস্কার করা হয়নি ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের অধীন এই মর্গটির।
Advertisement
সেখানে নেই কোনো পরিচ্ছন্নতাকর্মী। নোংরা ও দুর্গন্ধের কারণে মর্গের আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকাও অসম্ভব প্রায়।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৮ সালে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের যাত্রা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মর্গটিও নির্মাণ করা হয়। পরে হাসপাতালটি কয়েক দফায় সংস্কার করে আধুনিকায়ন করা হলেও মর্গটি কোনো ধরনের সংস্কারের ছোঁয়া পায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৫টি উপজেলা থেকে আসা মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয় এই একটি মাত্র মর্গে। কিন্তু এখানে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের জন্য নেই কোনো আধুনিক ব্যবস্থা। প্লাস্টিকের কৌটায় নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হয় যত্রতত্র। মর্গের জন্য কোনো স্থায়ী কর্মী না থাকায় এসব সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।
Advertisement
এছাড়াও, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা না থাকায় নিহতের কারণ চিহ্নিত করতে হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসকদের। মর্গের নিজস্ব কোনো ল্যাবরেটরি না থাকায় মরদেহের ভিসেরা পরীক্ষার জন্য রাজধানীর মহাখালী জনস্বাস্থ্য কেন্দ্রে পাঠিয়ে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয় ফলাফলের জন্য। আর সেজন্য অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট তাৎক্ষণিক দেয়ার নিয়ম থাকলেও রিপোর্ট পেতে দেরি হয়।
এছাড়া, লিঙ্গভেদে ময়নাতদন্তের জন্য পুরুষ ও নারী ডোম রাখার নিয়ম থাকলেও ঠাকুরগাঁওয়ের মর্গে শুধু মাত্র একজন পুরুষ ডোমই কর্মরত।
মর্গের ডোম সুকুমার দাস অভিযোগ করে বলেন, ‘এখানে নলকূপের অভাবে নদী থেকে পানি আনতে হয়। এতে করে ময়লা পানি দিয়ে লাশকে পরিষ্কার করতে হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আধুনিক মর্গ স্থাপন করা হয়েছে। আধুনিকায়ন না হওয়ায় মর্গে নিয়ম মোতাবেক ময়নাতদন্ত করা সম্ভব হয় না। এভাবে মরদেহের শরীর থেকে বিভিন্ন আলামত নষ্ট হয়ে যায়।’
তিনি জানান, ঠাকুরগাঁও হাসপাতালের মর্গে কোনো জেনারেটর নেই। বাইরে থেকে একটি তার টাঙিয়ে কোনো রকম বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ কারণে ময়নাতদন্তের সময় বিদ্যুৎ চলে গেলে বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। এছাড়াও পানির ব্যবস্থা না থাকায় লাশ কাটার পরে নদী থেকে পানি এনে পরিষ্কার করতে হয়। মর্গে আলামত রক্ষাকারী বক্স না থাকায় তা যত্রতত্র রেখে সংরক্ষণ করা হয়।
Advertisement
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক রকিবুল আলম বলেন, ‘হাসপাতালে জনস্বার্থে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান আছে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।’
মর্গে আলোক স্বল্পতার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় অর্ধগলিত মরদেহ বা পানিতে পচে যাওয়া দেহের ময়নাতদন্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমন হলে মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করা দুষ্কর। তাই সময় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মরদেহের প্রতিবেদন দেয়া হয়।’
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের সিভিল সার্জন ডা. মাহাফুজুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে মর্গ যে বেহাল অবস্থায় আছে তা বিবেচনা করে এটি সংস্কার ও আধুনিকায়নের জন্য আবেদন পাঠানো হয়েছে। সংস্কার করা হলে আরও লোকবল নিয়োগের ব্যবস্থাও করা হবে। আমরা আশা করছি দ্রুত এটি সংস্কার ও আধুনিকায়ন করার বাজেট পাশ হবে।’
তানভীর হাসান তানু/এসএস/জেআইএম