সাহিত্য

পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা: জীবন ও জগতের করুণ সুর

সাম্প্রতিক কবিতা নিয়ে অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেন। তবে আমি হতাশদের দলে নই। আমি আশার আলো খুঁজে বের করি। এ সময়ে বেশ কয়েক তরুণ কবিতাচর্চায় সগৌরবে এগিয়ে যাচ্ছেন। সৌম্য সালেক সময়ের আলোচিত সেসব তরুণ কবির মধ্যে একজন। অতি আধুনিকতার বেড়াজালেও কাব্যভূমি চষে বেড়ায় তার পৌরাণিক মন। ইতিহাস-বাস্তবতা ধরা দেয় কবিতার চরণে। ঘটনা এবং অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার নিরীক্ষায়। যতই দিন যায়, ততই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার কাব্য ভাবনা। বিষয়-বৈচিত্রে নতুনত্বের ছোয়া লক্ষ্য করা যায়। আবেগ ও মননে পরিণত হয়ে ওঠে চেতনা।

Advertisement

তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’। বইটিতে ৪৮টি কবিতা স্থান পেয়েছে। বইটির কবিতাগুলো কিছু অনালোকিত ঘটনা ও অনুভূতির নিবিড় গ্রন্থনা। এর আগে তার দুটি কবিতার বই প্রকাশ হয়েছে। বই দুটি হচ্ছে- ‘ঊষা ও গামিনি’ ও ‘আত্মখুনের স্কেচ’ । আগের বই দুটিও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া একটি প্রবন্ধের বই ‘শব্দচিত্র মত ও মতবাদ’তাকে প্রাবন্ধিক হিসেবেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তবুও কবি হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত। কবির ভাষায়ই বলতে হয়, ‘লোকটি কবি হতে চেয়েছিল’ (কবি)।

সৌম্য সালেকের কবিতার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- সহজবোধ্যতা ও গীতিময়তা। সমাজ, রাজনীতি ও সময়ের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং সচেতনতা তার কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ। বইয়ের বেশ কয়েকটি কবিতায় এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে। কবি তাই বলে ওঠেন-‘রক্ত জেগেছে আজ বিভেদের- পাষাণ রোধিতেআগুন লেগেছে তাই প্রাঙ্গণের উদাম বেদীতে!আমার ভায়েরা আছে রাজপথে ঈশানে নিশানেতাদের বোনেরা হাঁকে উদ্দাম রুদ্র-বিষাণে…’(গণায়ন)মানুষ সৌম্য সালেক এখানে জনতার প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভুত হন। মানুষের সারিতে দাঁড়িয়ে মানুষের অধিকারের কথা বলেন।

এ ছাড়া কয়েকটি কবিতাকে সার্থক স্যাটায়ার বললেও অত্যুক্তি হবে না। কারণ কাঙ্ক্ষিত দুঃখের সাথে ইথারে-পাথারে আজও তার কবিতার শব্দেরা ভেসে বেড়ায়। কবি যখন বলেন-‘নৈঃশব্দ্যের চেয়ে কিছু বেশিখসে পড়ে হিম অনুপাতেইথারের সুমধুর তানে ছড়ায় মাধুরীঘাসে ঘাসে, জল ও মাটির কিনারে মনোহর...’(পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা)তার অপ্রকাশিত আকাঙ্ক্ষা, চেপে থাকা দুঃখবোধ নৈঃশব্দের চেয়েও বেশি কিছু হয়ে ধরা দেয়।

Advertisement

তার কবিতায় বিষণ্নতা, ঘটনার অন্তরালের অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। এমনকি প্রকৃতি, প্রেম, মানবতা যেন সহোদরের মতো সম্পর্ক স্থাপন করে। কবিতা যে চিরকাল মানুষের কথা বলে, তা আবার তার কবিতা পড়ে বোধগম্য হয়। এমনকি উপমার যথার্থ ব্যবহার তার কবিতাকে ঋদ্ধ করেছে। যেমন-‘সে ঘুমের উদ্গার হতেবেড়ে গেছে ঝিঁঝিঁদের জ্বালাভুল ও বিষাদ কেটে ক্লান্ত হয়েছে মনতবু এসে রৌদ্র ঝাঁজালো;হিমের বিতান খুলে নীল সোঁতা-নিশার অশেষ তোলোউড়ে যায় সোনার মেঘেরা…’(ঘুম)

কোনো কোনো কবিতায় ফুটে উঠেছে বিশ্বজনীন মানবতাবাদ। তাতে বিশ্ব মানবতার প্রতি দরদ প্রকাশ পেয়েছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে উঠেছে বিশ্বজনীন। প্রকৃতি চেতনাও উজ্জীবিত হয়েছে মাঝে মাঝে। কখনো কখনো বিদ্রোহ, বিপ্লব ধরা দেয় কলমে। সমকালীন প্রেক্ষাপট, নারী নির্যাতন, ধর্ষণও কবিকে ব্যাপকভাবে আহত করে। কবি তাই তো বলেন-‘দেখলাম, ওদের ষষ্ঠজন দমে গিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে আর বাকীরা মাংসের নগ্ন-প্রকোপ থেকে এতটুকু না সরে এসে, কর্ণপাতহীন মেতে রইলো…’ (বস্ত্রহরণ)

সৌম্য সালেকের কোনো কোনো কবিতাকে আবার আকারে ছোট গল্প মনে হয়। কবিতার শরীরে তিনি গল্পের রূপ-সৌন্দর্য প্রতিস্থাপন করেন। তবে তার সে গদ্য কবিতা আলাদা বৈচিত্র এনেছে। এরমধ্যে ‘নিম্নগামী রেলের যাত্রী’, ‘মৃতের শরণি’, ‘সোনাবরু’, ‘সংযোজিত সংলাপ’, ‘জুয়েল গার্ডেনের লাল গালিচায় প্রিয় লেবানিজ’, ‘শৈল-জলের গান’ উল্লেখযোগ্য। একেকটি কবিতাকে একেকটি আখ্যান মনে হতে পারে। এসব আখ্যানে বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের মশালও জ্বেলে দেন কবি অনায়াসে।

তার কবিতায় কখনো কখনো জীবনানন্দের ছায়া লক্ষ্য করা যায়। কবি জীবনানন্দ দাশ আর কবি সৌম্য সালেক মিলেমিশে একাকার হয়ে যান। প্রকৃতি, সবুজ মাঠ, পরিবেশ, বিশাল নিঃসর্গ তার কবিতাকে ভিন্নরূপে প্রকাশ করে। তার ছন্দজ্ঞানও কবিতাকে গতিময় করে তোলে। যেমন-‘শ্রমের ঘোরে রক্ত নাচে কতকার খেয়ালে অঙ্গহানি লুটএকি আমার ভগ্ন স্বপন জ্বালারসের কালে মন নিয়েছে ছুট।’(পথের গান)

Advertisement

আবার কবিতায় প্রেম, যৌবন, কাম, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ছলনা-জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে ধরা দেয়। তার ‘সোনাবরু’ আখ্যানটি পাঠকের হৃদয়কে নাড়া দেয়। কবিতায় কৃষাণ বা চাষি মহৎ হয়ে ধরা দেয়। কেননা কখনো কখনো শোকগাথা প্রকাশ করেছেন কবিতার আদলে। কবি বলেন-‘আচাই ধরেছে শস্য রোয়ার গানগরাইয়ের দল তান বাঁধে এক সাথেপাহাড়ের নাথ বর যদি দিয়ে যানবাড়বে ফলন- বসবে চাঁদের হাট।’(শৈল-জলের গান)

কবিতার প্রচলিত ছন্দেও সৌম্য সালেক বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন। মাত্রা, তাল, লয় তার বেশ কয়েকটি কবিতায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বইয়ের শেষদিকে ‘শৈল-জলের গানে’বাইশটি অণুকবিতা সন্নিবেশিত হয়েছে। অন্য কবিতা থেকে তার বিষয়-বৈশিষ্ট্য আলাদা। যার বৈচিত্র্যও চোখে পড়ার মতো। এই কবিতাগুচ্ছ বইটিকে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, সময় সচেতন কবি সৌম্য সালেক মানব জীবন, সুখ-দুঃখ, প্রেম-অপ্রেম, আবেগ-অনুভূতি, সারল্য, বীরত্ব, জীবনাচরণ, ঐতিহ্য, উপকথা, পুরাণ, রূপকথা, সংস্কৃতি, বাক্য, খাদ্যাভ্যাস, পাহাড়, পাহাড়ি জনপদ ফুটিয়ে তুলেছেন। তার কবিতার অনুষঙ্গ, শব্দচয়ন, বর্ণনা, মাত্রা, উপমা খুবই প্রাসঙ্গিক ও যথার্থ হয়েছে।

তাই অকপটেই বলা যায়,‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’য় পাঠক এক সুবোধ সচেতন কবিকে চিনতে পারবেন। চিনতে পারবেন সাম্প্রতিক কবিতার গতি-প্রকৃতি। কবিতাবিমুখ পাঠক এখানে কবিতার প্রকৃত স্বাদ পাবেন। আমি তার বইটির বহুল পাঠ কামনা করছি।

বই: পাতাঝরার অর্কেস্ট্রাকবি: সৌম্য সালেকপ্রকাশনী: সময় প্রকাশন প্রচ্ছদ: মোমিন উদ্দীন খালেদ মূল্য: ১৬০ টাকা।

এসইউ/জেআইএম