আগে দরদাম না করেই এক কেজি আঙুর কিনে বিপাকে পড়েছেন এলিজা হাসান। এ নিয়ে দোকানির সঙ্গে তার এক ধরনের বাকবিতণ্ডাও শুরু হয়। বাকবিতণ্ডার কারণ, এক কেজি আঙুরের দাম ৪২০ টাকা চাইছেন দোকানি।
Advertisement
দাম শুনে এলিজা বারবার বলছিলেন, ‘কিছুদিন আগে ২৪০ টাকাই কিনেছি এ আঙুর। কয় দিনে কি দ্বিগুণ হয়ে গেল? আপনি আমাকে ঠকাচ্ছেন।আপনি এটা (আঙুর) ফেরত নেন।’
দোকানি ইনিয়ে-বিনিয়ে ১০-২০ টাকা কমানোর কথা বললেও একপর্যায়ে আঙুরের ব্যাগটি রেখে দোকান থেকে বেড়িয়ে গেলেন এলিজা। এরপর রাজধানীর রামপুরা বাজারের ওই ফল দোকানি মোবারকের সঙ্গে জাগো নিউজের কথা হয়।
তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করেই আঙুর, নাশপাতি ও আনারের দাম খুব বেড়ে গেছে। আপেলের দামও এখন কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেশি। পাইকারি বাজারে কিনতে গেছে চড়া দামে কিনতে হচ্ছে।’
Advertisement
ওই দোকানে শুধু নয়, এরপর বেশ কয়েকটি এলাকার দোকান ঘুরে মোবারকের কথার সত্যতা মেলে। কারণ কয়েকদিনের ব্যবধানে বাজারে প্রতিকেজি আপেলের দাম ১২০ টাকা থেকে বেড়ে ১৪০ টাকা, আঙুরের দাম ২৪০ থেকে বেড়ে ৪০০ থেকে ৪৪০ টাকা, নাশপাতির দাম ২০০ থেকে বেড়ে ২৬০ টাকা এবং আনারের দাম ২৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৩২০ টাকাই উঠেছে। তবে কমলা ও অন্যান্য ফলের দাম খুব একটা বাড়েনি।
দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে ফলের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার পুরান ঢাকার বাদামতলীর ব্যবসায়ীরা ফল আমদানিকারকদের দ্বায়ী করেন। তারা বলেন, ‘হঠাৎ করেই বিদেশি কয়েক পদের ফলের দাম বাড়িয়েছেন আমদানিকারকরা। এ সময় ওইসব ফলের সরবরাহও বেশ কম।’
অন্যদিকে দাম বৃদ্ধির দুটি কারণ দেখিয়েছেন আমদানিকারকরা। তারা বলছেন, প্রথমত ভারত ও চীনে ফলের মৌসুম শেষ হওয়ার কারণে বাড়তি দামে আমদানি করতে হচ্ছে। অন্যদিকে বন্দরে কনটেনিয়ার সমস্যার কারণে ফল আমদানি কমেছে, যার প্রভাব পড়েছে বাজারে। তবে শিগগিরই এ সমস্যা কেটে যাবে বলে জানান কয়েকজন আমদানিকারক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফল আমদানিকারদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, চীন ও ভারতে শীত মৌসুমে ফল উৎপাদন কম হয়। তাই বিদেশি ফল আমদানি কমে গেছে। একই অবস্থা দেশেও। যখন দেশি ফল বাজারে আসে, তখন বিদেশি ফল আমদানি করা হয় না। কিন্তু এখন দেশি ফলও এখন মৌসুমের কারণে কম। তাই বিদেশি ফলের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমায় দাম বেশি।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, আমদানি যা হচ্ছে তাতেও কনটেনিয়ার সমস্যা হচ্ছে। করোনাভাইরাসের কারণে বিভিন্ন দেশে জাহাজ ও কনটেনিয়ার আটকা রয়েছে। তাই ফল আমদানির জন্য কনটেনিয়ার পাওয়া যাচ্ছে না।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি ফলের বাজার বাদামতলী এখন পুরোপুরি বিদেশি ফলনির্ভর হয়ে পড়েছে। ফল আমদানিকারকেরা বলছেন, শীতের মৌসমে দেশি ফল উৎপাদন কম হওয়ায় বিদেশি ফলই একমাত্র ভরসা। এছাড়া ফলের বাজারে করোনার একটি প্রভাব রয়েছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এ সময় ফল বেশি খাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা আতঙ্কে ফলের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। এখন ধীরে ধীরে এ আতঙ্ক কমে যাচ্ছে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এখনও ফলের চাহিদা বেশি।
বাদামতলীর মায়ের দোয়া ফল ভান্ডারের জসিম উদ্দিন বলেন, ‘বিক্রি ভালো। তবে দাম যদি কম হতো তবে খুব বেশি ভাল বিক্রি হতো। কমলা ছাড়া অন্যান্য ফলের দাম বেশি। শুধু কমলা ১০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে।’
তবে ফলের সরবরাহ কমার কোনো চিহ্ন নেই বাদামতলী ফলের আড়তগুলোকে। কারণ সব দোকানেই বিদেশি ফলের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন দোকানিরা। এসব ফলের মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের আপেল, কমলা, ডালিম, আনার, আঙুর, নাশপাতি, ড্রাগন, কেনু, থাই পেয়ারা, থাই পেঁপে এমনকি বিদেশি আমও। খুচরা বাজারের ক্রেতারাও দাম বেশি হওয়ার কারণে এই পাইকারি বাজারে এসে দরদাম করে এসব ফল কিনছেন। তবে ফলের পাইকারি বাজার ঘুরে দেশীয় কোনো ফল দেখা যায়নি। কয়েকটি দোকানে দেশীয় উৎপাদিত মাল্টা, পেঁপে ও কলা দেখা গেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ বিদেশি ফল চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়। বাকি ৩০ শতাংশ আমদানি হয় ভারত থেকে স্থলপথে, যা সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বুড়িমারী ও হিলির স্থলবন্দর দিয়ে আসে।
অন্যদিকে বিদেশি ফলের চাহিদা বাড়ায় দেশেও এখন মাল্টা, ড্রাগন, স্ট্রবেরিসহ অনেক বিদেশি ফলের আবাদ শুরু হয়েছে। আবার আপেলের বিকল্প বড় আকারের কুল (বরই), থাই পেঁপে ও পেয়ারা উৎপাদনও বাড়ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশে বছরে সোয়া এক কোটি টন ফল উৎপাদন হয়। দেশে প্রায় ১৩০ রকমের ফলের সন্ধান রয়েছে, তার মধ্যে প্রচলিত ও অপ্রচলিত প্রায় ৭২টি ফলের চাষাবাদ হয়। মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় নাম রয়েছে বাংলাদেশের।
এনএইচ/এমএসএইচ/এমকেএইচ