ভ্রমণ

বিজয়পুর মৃৎশিল্প কারখানায় একদিন

শাহ জাহান আল সাদাফ

Advertisement

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ানোর মজাটাই অন্যরকম। আর সেটি যদি হয় সেমিস্টার ফাইনালের শেষে, তাহলে তো কথাই নেই। তখন সবেমাত্র আমাদের তৃতীয় সেমিস্টার শেষ হয়েছিল। যেদিন পরীক্ষা শেষ হলো; সেই রাতে আমাদের ব্যাচের কয়েক বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিলো, কালই তারা বিজয়পুর মৃৎশিল্প কারখানায় ঘুরতে যাবে। ছোটবেলা থেকে কোথাও ভ্রমণের কথা বললে আমি সবার আগে আগ্রহ দেখাতাম। এবারও তার ব্যতিক্রম হতে যাবে কেন? তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম বিজয়পুর মৃৎশিল্প কারখানা দেখতে যাব।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) ভর্তির পর থেকে ভ্রমণের প্রতি আগ্রহ দিগুণ বেড়ে গেল। কারণ কুবি ক্যাম্পাসের আশেপাশে অনেক পর্যটনস্পট থাকায় ভ্রমণপিপাসুদের আনাগোনা থাকে। ক্যাম্পাসে যাওয়া-আসার পথে প্রতিদিন শতশত মানুষ শালবন বিহার ঘুরতে আসার দৃশ্য দেখলে নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারতাম না। সব সময় চাইতাম, একটু কোথাও ঘুরে আসি। কখনো বন্ধুদের নিয়ে চলে যেতাম বার্ডে। কখনোবা বন্ধুদের নিয়ে মজার আড্ডার আসর বসাতাম ইটাখোলা মুড়াই। এরমধ্যে যখন বন্ধুরা বলল, কাল বিজয়পুর মৃৎশিল্প কারখানা দেখতে যাবে। তখন মনের মধ্যে কৌতূহল একটু বেড়েই গেল। শুনলাম, সেখানে মাটি দিয়ে বিভিন্ন রকম জিনিস তৈরি করা হয়।

রাতেই বন্ধু আরিফ ব্যাচের ফেসবুক গ্রুপে বলে দিয়েছিল, যারা বিজয়পুর মৃৎশিল্প কারখানা দেখতে চান; তারা যেন সকালে ক্যাম্পাসের কাঁঠালতলায় চলে আসেন। রাতে যেন ঘুমই আসছে না। একদিকে পরীক্ষা শেষে হওয়ায় প্যারামুক্ত; অন্যদিকে সকালে ঘুরতে যাব।

Advertisement

পরদিন সকালে বন্ধু আরিফের কথামত সবাই কাঁঠালতলায় আসতে শুরু করল। আমিও যথাসময়ে ক্যাম্পাসের কাঁঠালতলায় চলে এলাম। গিয়ে দেখি সবাই কাঁঠালতলায় জড়ো হয়েছে। বিজয়পুর মৃৎশিল্প কারখানা আমাদের ক্যাম্পাস থেকে বেশি দূরে ছিল না। তাই আটো গাড়িতে করে সবাই বিজয়পুর চলে গেলাম। ক্যাম্পাস থেকে বিজয়পুর যাওয়ার রাস্তা ছিল অনেক সুন্দর। চারপাশে সবুজ অরণ্য। লাল পাহাড়ের মাঝে আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে কোন সময় বিজয়পুর চলে এলাম বুঝে উঠতে পারিনি।

বিজয়পুর নামার পর এলাকার মানুষ থেকে জিজ্ঞেস করে চলে গেলাম মৃৎশিল্প কারখানায়। কয়েকজন ভেতরে ঢুকে সবাই ঘুরে দেখার জন্য অনুমতি নিয়ে এলো। তারপর এক এক করে সবাই ঢুকে পড়লাম বিজয়পুর মৃৎশিল্প কারখানায়। মৃৎশিল্প কারখানার বড় গেট পার হতে না হতে চোখে পড়লো সারি সারি শুকাতে দেওয়া মাটির বিভিন্ন রকমের তৈজসপত্র। আমার মানুষ বেশি হওয়ায় কয়েক গ্রুপে ভাগ হয়ে ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। শুকাতে দেওয়া মাটির বিভিন্ন রকমের জিনিসের মাঝখানে হেঁটে হেঁটে চলে গেলাম প্রদর্শনী কক্ষে।

প্রদর্শনী কক্ষে ঢুকে দেখি শিল্পীদের মাটির শিল্পগুলো থরেথরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। চকচকে রং করা মসৃণ মাটির এসব শৈল্পিক পণ্য দেখে বিশ্বাসই করতে পরছিলাম না, এগুলো মাটির তৈরি। অনেক মাটির তৈরি জিনিস নিজ হাতে ধরে ধরে দেখলাম। তারমধ্যে ছিল মৃৎশিল্পীদের হাতের তৈরি মাটির হাঁড়ি, পাতিল, বাটি, প্রদীপ, ছাইদানি, ফুলদানি, জলাবিড়া, জটধুসি, জলকান্দা, দুধ সানার পাত্র, দুধের হাঁড়ি, তবলার বায়া, খেলনাসহ অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন জিনিসপত্র।

সবাই সবার মত ঘুরে ঘুরে দেখতে। কেউ কেউ ছবি তুলছে। কেউ আবার প্রদর্শনী কক্ষে থাকা স্টাফ থেকে মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিসের নাম জিজ্ঞেস করছে। যে কৌতূহল নিয়ে বিজয়পুর আসা, তা এখনো দেখা হলো না। শিল্পীরা কিভাবে মাটি দিয়ে এত সুন্দর কারুকার্য করে, তা দেখাই ছিল সবার আগ্রহ। প্রদর্শনী কক্ষ পেরিয়ে চলে গেলাম কারখানায়। কারখানায় ঢুকে দেখি অনেক নারী-পুরুষ একসাথে কাজ করছে। কেউ কাঁদা মাটি দিয়ে মন্ড বানায় আবার কেউ কেউ মন্ড করা মাটি দিয়ে হরেক রকমের পণ্য বানায়।

Advertisement

হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম, যেখানে মাটির জিনিসগুলো শুকানোর পর পোড়ানো হয়। বড়বড় তিনটি গ্যাসের চুলায় অনেক মাটির পাত্র পোড়ানো হচ্ছিল। মৃৎশিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় ফুটে ওঠা এমন জাদুকরী সব মাটির পণ্য পোড়াতে দেখে সবাই বিমোহিত।

কখন যে ঘুরতে ঘুরতে দুপুর হয়ে গেল, আন্দাজ করতে পারিনি। অবশেষে কারখানা থেকে বেরিয়ে চলে এলাম। কারখানা থেকে বের হতে না হতে চোখে পড়লো কুমিল্লা-চাঁদপুর রেললাইন। সবাই রেললাইনে অনেকক্ষণ ছবি তুলে রওনা দিলাম ক্যাম্পাসের দিকে। তাতেই শেষ নয়। ক্যাম্পাসে এসে সবাই একসাথে খাওয়া-দাওয়া করলাম। এককথায় বিজয়পুর মৃৎশিল্প কারখানা দেখতে যাওয়ার দিনটি ছিল আনন্দময়।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/এমএস