জাতীয়

বছরজুড়ে প্রশাসনের কাজের কেন্দ্রে ছিল করোনা

প্রশাসনের জন্য ২০২০ ছিল মহামারি করোনাভাইরাসে সঙ্কটময় চ্যালেঞ্জের এক বছর। দেশের মানুষকে সেবা দিতে সামনে থেকে চিকিৎসক, পুলিশসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা মোকাবিলা করেছেন আতঙ্কময় মহামারিকাল। অতি ক্ষুদ্র এক জীবাণুর কাছে পরাজয় বরণ করে জীবন দিয়েছেন একজন প্রতিমন্ত্রী, দু’জন সচিবসহ অনেক কর্মকর্তা। আক্রান্ত হয়েছেন এক ডজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ শীর্ষ ও মাঠ পর্যায়ের বহু কর্মকর্তা।

Advertisement

বছরের শুরু থেকে চলা মহামারিকে মোকাবিলায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ভূমিকাকে সফল বলছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। মহামারির কারণে টানা ৬৬ দিন সরকারি ছুটির রেকর্ড হয়েছে এ বছরই। এছাড়া বছরের শুরুতে ছোট আকারে হয়েছে মন্ত্রিসভার রদবদল, শেষের দিকে যুক্ত হন একজন প্রতিমন্ত্রী।

করোনার কারণে সম্ভব হয়নি জেলা প্রশাসক সম্মেলনও। তবে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ছিল আলোচনার কেন্দ্রে।

বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য আলোচিত ছিলেন কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার বিষয়টিও বছরের আরেক আলোচিত ঘটনা।

Advertisement

প্রশাসনের ২০২০ সালের কার্যক্রম মূল্যায়ন করে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সব দেশেই জনপ্রশাসন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের জনপ্রশাসনের ভূমিকা ছিল চমৎকার। কোভিডে আমাদের মাঠ প্রশাসন, চিকিৎসক, পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে এবং তারা এক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, মানুষের বাড়ি বাড়ি ত্রাণ পৌঁছে দেয়া, চিকিৎসা দেয়াসহ করোনাকালে প্রশাসনের কর্মকর্তারা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যে বলছিলাম জনমুখী জনপ্রশাসন; সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে কাজ করা- কোভিড পরিস্থিতিতে আমরা এর দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি। এসব কারণে ছোট ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশ করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে রয়েছে।’

ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘চরম আতঙ্কের মধ্যে যখন কেউ এগিয়ে আসছে না, তখন আমাদের ইউএনও, ওসি জানাজা পড়িয়েছেন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক কর্মকর্তা আক্রান্ত হন, জীবন দেন। প্রধানমন্ত্রী আমাদের মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, তিনি করোনা মোকাবিলায় যে নির্দেশনা দিয়েছেন, আমরা প্রশাসনের মাধ্যমে সেটা বাস্তবায়ন করেছি।’

প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘শুধু করোনাই নয়, এ বছরই ৬ দফা বন্যা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। সেগুলোর মোকাবিলাও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের করতে হয়েছে। আন্তরিকতা ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এত কিছুর মধ্যে আমাদের উন্নয়ন কাজ বন্ধ হয়নি। এটা আমাদের প্রশাসনের বড় সফলতা।’

Advertisement

মহামারিতে ৬৬ দিনের দীর্ঘতম ছুটি

চলতি বছরটিই ছিল টানা দীর্ঘতম ছুটির বছর। মহামারির কারণে চলতি বছর ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিন ছুটি থাকে।

করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেলে ২৩ মার্চ সচিবালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেন। পরে বন্ধ করে দেয়া হয় সব ধরনের গণপরিবহনও। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় দফায় দফায় ছুটি বাড়তে থাকে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা এবং সাধারণ মানুষের জীবিকার কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন শর্ত পালন ও নির্দেশনা মানা সাপেক্ষে আবার ৩১ মে থেকে অফিস খুলে দেয় সরকার। ধীরে ধীরে খুলে দেয়া হয় গণপরিবহনও।

করোনায় এক প্রতিমন্ত্রী, দুই সচিবের মৃত্যু

গত ১৩ জুন রাতে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ মারা যান। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেয়া হয়। সেখানেই তিনি মারা যান। পরে কোভিড-১৯ পরীক্ষায় তার ফলাফল পজিটিভ আসে।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৯ জুন প্রাণ হারান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২১ জুলাই প্রাণ হারান আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব নরেন দাস।

আক্রান্ত হয়েছেন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা

করোনা আক্রান্ত হয়েছেন- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন।

এছাড়া নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও করোনায় আক্রান্ত হন।

সম্ভব হল না ডিসি সম্মেলন

সরকারের নীতিনির্ধারক ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে সরাসরি মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেয়ার জন্য প্রতিবছর জুলাইয়ে ডিসি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। কিন্তু এবার তা সম্ভব হয়নি। মহামারি পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালের ডিসি সম্মেলনের জন্য ২০২১ সালের ৫ থেকে ৭ জানুয়ারি দিন ধার্য করা হয়েছিল। তবে পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় সেটিও আর সম্ভব হচ্ছে না। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১৪ থেকে ১৮ জুলাই জেলা প্রশাসক সম্মেলন হয়।

মন্ত্রিসভার রদবদল, নতুন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী

চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর দফতর বদল করা হয়। এর মধ্যে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে দফতর পরিবর্তন করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ পান গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব। আর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরুকে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী করা হয়।

ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ মারা যাওয়ার পর গত ২৫ নভেম্বর নতুন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান জামালপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. ফরিদুল হক খান দুলাল। এর আগে ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তিনি।

কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানাকে নিয়ে বিতর্ক

চলতি বছর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য মাঠ প্রশাসনে কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোছা. সুলতানা পারভীন আলোচিত ছিলেন। ১৩ মার্চ মধ্যরাতে স্থানীয় সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের বাড়িতে হানা দেন। এরপর তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এক বছরের কারাদণ্ড দেয় জেলা প্রশাসন। তখন ঘরে কোনো তল্লাশি চালানো না হলেও পরে ডিসির কার্যালয়ে নেয়ার পর তারা দাবি করেন, আরিফুলের বাসায় আধা বোতল মদ ও দেড়শ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে।

অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে সুলতানা পারভীনের নির্দেশে এসব ঘটেছে বলে আরিফুলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। এই ঘটনা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। পরে সুলতানা পারভীনকে সরিয়ে দেয়া হয়। ১৬ মার্চ সুলতানাকে পরবর্তী পদায়নের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করে আদেশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে একইসঙ্গে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের তিন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়। উপসচিব সুলতানা পারভীন ও জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত এখনও চলছে।

পদোন্নতি

চলতি বছর মহামারির মধ্যেও অতিরিক্ত ও যুগ্ম সচিব পদে দুটি বড় ধরনের পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে গত ৫ জুন ১২৩ উপসচিবকে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্ম সচিব করা হয়। এরপর ২৬ সেপ্টেম্বর ৯৮ জন যুগ্ম সচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। যদিও দুটি স্তরেই স্থায়ী পদের চেয়ে আগে থেকেই অতিরিক্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। এছাড়া চলতি বছরই ২৬ জন কর্মকর্তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।

ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন সংশোধন

ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০’ সংশোধন করা হয় ২০২০ সালেই। ৪ অক্টোবর নোয়াখালীতে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এরপর দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। জড়িতদের অধিকাংশকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধেও সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

আন্দোলনকারীরা ধর্ষণকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবি জানায়। এ সময় অন্যান্য স্থানেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। দেশজুড়ে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলন এবং ধর্ষণকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবির মধ্যে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার।

গত ১২ অক্টোবর ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০০০’ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। পরে সংসদের অধিবেশন বসলে অধ্যাদেশটি আইনে পরিণত করতে সংসদে বিল আকারে পাস হয়।

ইউএনওর ওপর হামলা

গত ২ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের সরকারি বাসভবনে সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরুতর আহত হন ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা ওমর আলী। ওয়াহিদা খানমের মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে ৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হসপিটালে ভর্তি করা হয়। প্রায় এক মাসের চিকিৎসা শেষে সুস্থ হওয়ার পর ১ অক্টোবর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান তিনি। তবে এর মাঝেই ১৬ সেপ্টেম্বর ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে ঢাকায় আনতে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়।

এক প্ল্যাটফর্মে সব ক্যাডারের কর্মকর্তারা

কুষ্টিয়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে গত ১২ ডিসেম্বর সারাদেশে সরকারি কর্মচারীরা ‘জাতির পিতার সম্মান রাখবো মোরা’ স্লোগান সামনে রেখে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সরকারি কর্মকর্তা ফোরাম এই সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে সরকারি শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অংশ নেন।

আরএমএম/এমএইচআর/জেএইচ/এমএস