পৃথিবীর প্রায় সব বাবা-মা ও অভিভাবকই চায়, তার সন্তান নামাজি ও সৎ চরিত্রের অধিকারী হোক। কিন্তু চাওয়ার সঙ্গে তাদের কর্মের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। নিজেরা নিয়মিত মসজিদে গেলেও নিজ সন্তানকে মসজিদে নিয়ে যেতে চান না। শিশু মসজিদে যেতে চাইলেও নানান অজুহাতে তাকে বাসায় রেখে যান।
Advertisement
বাচ্চারা ছোটবেলা থেকে মসজিদে না এলে মসজিদে আসার ব্যাপারে উৎসাহিত হবে কি করে? জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায়ের গুরুত্ব বুঝবে কি করে? এমনটি হলে কি সন্তান নামাজি হবে?
হ্যাঁ, মসজিদমুখী প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে, শিশু বয়স থেকেই তাকে সঙ্গে নিয়ে মসজিদে যেতে হবে। গড়ে তুলতে হবে মসজিদমুখী প্রজন্ম। তবেই সন্তান হবে নামাজি ও সৎ চরিত্রের অধিকারী। এ কারণেই সুন্দর ও অপরাধমুক্ত সমাজ গঠনে মসজিদমুখী প্রজন্ম গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
শিশু বয়স থেকেই সন্তানকে মসজিদমুখী প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তুলতে নিয়মিত নামাজসহ প্রত্যেক জুমআর দিন শিশুকে উত্তম পোশাক পরিয়ে মসজিদে নিয়ে যেতে হবে। শেখাতে হবে মসজিদের আদব, করণীয় ও বৈশিষ্ট্য। তবেই তারা পাবে একটি সুন্দর ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
Advertisement
মসজিদের পাশ্ববর্তী বাসা-বাড়ির শিশুরা আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মসজিদে যেতে আত্মহারা হয়ে ওঠে। অনেক অভিভাবক নিজেরা নামাজে গেলেও শিশুদের মসজিদে নিতে চান না। আবার অনেক মানুষ আছেন যারা শিশুদের মসজিদে আসাকে বিরক্ত মনে করেন।
‘না’, এমনটি হলে মসজিদমুখী প্রজন্ম গড়ে ওঠবে না। বরং শিশুর ছুটাছুটি, চেঁচামেচি ও কান্নাকাটি ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করে তাদের বুঝাতে হবে যে, মসজিদ আল্লাহর ঘর। এখানে নিরবে সুন্দর ও উত্তম পরিবেশে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করতে হয়। তবেই শিশু শিখবে মসজিদের আদব। আর এসব শিশুদের পদচারণায় আবাদ হবে মসজিদ। গঠন হবে সুন্দর ও অপরাধমুক্ত শান্তিপূর্ণ সমাজ।
শিশুদের মসজিদমুখী করা অভিভাবকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মসজিদে নিয়ে আসা থেকে বেঁচে থাকতে কোনোভাবেই শিশুর সামনে মিথ্যা অজুহাত দাঁড় করানো ঠিক নয়। কারণ একদিকে মিথ্যা অজুহাতে যেমন গোনাহ হয় আবার সন্তানও মসজিদবিমুখ হয়ে পড়ার আশংকা তৈরি হয়। বড় হওয়ার পর চাইলেও এ সন্তানের মসজিদমুখী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
মসজিদমুখী প্রজন্ম গড়ে তুলতে করণীয়- নিজ সন্তানকে সুন্দর পোশাক পরিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ জুমআর নামাজে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে।- শিশুকে বাসা থেকে বুঝাতে হবে মসজিদে এসে যেন, কাউকে বিরক্ত না করে। চিৎকার, কান্নাকাটি বা দুষ্টুমি না করে। এভাবে নিয়মিত বুঝালে একসময় শিশু মসজিদের পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।- কোনো মুসল্লি বিরক্ত হলে তাকে বুঝাতে হবে।- শিশুরা মসজিদে দুষ্টুমি করলে, তার সঙ্গে খারাপ আচরণ না করে তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে।- নিজ নিজ সন্তানকে নিজের সঙ্গে রাখতে হবে।- শিশুদের কাতারের মধ্য থেকে বের করে পেছনে পাঠানো যাবে না। কারণ পেছনে সব শিশু একত্র হলে চিৎকার কিংবা শোরগোল বেড়ে যাবে। আর তাতে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে ওঠবে।- মসজিদে আদব সম্পর্কে শিশুকে ধীরে ধীরে শেখাতে হবে।- সম্ভব হলে মসজিদেও শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে।- মসজিদে ইমাম-মুয়াজ্জিন কিংবা কমিটির সদস্যরা শিশুদের জন্য একটি আলাদা ভুবন তৈরি করতে পারেন।
Advertisement
মনে রাখতে হবেমসজিদমুখী প্রজন্ম গড়ে তুলতে, শিশুদের পদচারণায় মসজিদ মুখরিত রাখতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবন থেকেই মুসলিম উম্মাহকে শিক্ষা নিতে হবে। তিনি মসজিদে শিশুদের নিয়ে আসতেন।
নামাজ পড়াকালীন সময়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিশুদের সঙ্গে কেমন আচরণ করেছেন তাও জানতে হবে। কেননা এসব বিষয় জানার মধ্যেই রয়েছে মসজিদমুখী প্রজন্ম গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা।
হাদিসের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রিয় নাতি হজরত ইমাম হাসান ও হুসাইন নামাজ চলাকালীন সময়ে প্রিয় নবির সঙ্গে কী করতেন?রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সেজদায় যেতেন, তখন তাঁরা প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাধে চড়তেন। যে কারণে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক সময় সেজদায় দীর্ঘ সময় ব্যয় করতেন। এ কারণে কখনও তিনি নাতিদের সঙ্গে রাগ বা খারাপ আচরণ করেননি।
সম্প্রতি সময়ে শিশু-কিশোরদের মসজিদমুখী করতে দেশে কিংবা দেশের বাইরে নানা আয়োজনের খবর পাওয়া যায়। যদি ছোট্ট বয়স থেকে শিশুকে মসজিদমুখী করা যায়। শিশুদের পদচারণায় মসিজদ আবাদ করা যায় তবে কোনো কিশোর কিংবা যুবককে মসজিদমুখী করতে অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রয়োজন হতো না।
আফসোসের বিষয়!পাড়া, মহল্লা, উপজেলা, জেলা কিংবা বিভাগীয় শহরসহ অনেক স্থানে দৃষ্টিনন্দন মসজিদ প্রতিষ্ঠা হলেও শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনই মুসল্লি শূন্য থাকে এসব মসজিদ। যে কারণে নানা পুরস্কার কিংবা অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়ে শিশু-কিশোরদের মসজিদমুখী করার আয়োজন করার প্রয়োজন হয়।
ছোট্ট বয়স থেকে শিশুদের পদচারণায় মসজিদ আবাদ হলে এমনিতেই মসজিদমুখী প্রজন্ম গড়ে ওঠবে। সুন্দর ও অপরাধমুক্ত সমাজ তৈরি হবে। সমাজে অশান্তি ও অন্যায় কমে যাবে। মাদকের ছোবল, হত্যা, ধর্ষণের মতো মারাত্মক জঘন্য অপরাধ থেকে মুক্ত হবে সমাজ।
মানসিকতা হোক এমনশিশুদের জন্য মসজিদ শুধু নামাজের স্থানই নয়, বরং তারা মসিজদে খেলাধুলা করবে, দৌড়াদৌড়ি করবে, আনন্দ করবে। আর নামাজের সময় হলে ইমামের সঙ্গে জামাআতে অংশগ্রহণ করবে। পাড়া কিংবা মহল্লা সব শিশু মসজিদে এলে পরস্পরের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হবে। মুরব্বিরা পাবে যথাযথ সম্মান। সুন্দর সামাজিক সুসম্পর্ক তৈরি হবে। পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে আজকের শিশু। যারা হবে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।
সুতরাং মসজিদে কোনো ছোট্ট শিশু আসলে তাকে অসহযোগিতা নয়, বরং উৎসাহ দিতে হবে। শিশুদের বিরক্তি ও বিভিন্ন বিষয়গুলো সহ্য করতে হবে।
মসজিদমুখী প্রজন্ম গড়তে নোয়াখালীর এক ইমামের ঘোষণাকে আমরা নিজেদের জন্য উপদেশ হিসেবে নিতে পারি। তিনি মসজিদে ঘোষণা করেছিলেন-’১২ বছরের নিচে যত বাচ্চা মসজিদে আসবে প্রত্যেক ওয়াক্তে তাদের জন্য থাকবে ২টি করে চকলেট। আবার যারা নিয়মিত আসবে তাদের জন্য থাকবে সপ্তাহিক পুরস্কার। যা প্রতি বৃহস্পতিবার বাদ ইশা ঘোষণা করা হবে।’
তার ভাষায়, ‘বাচ্চাদের মসজিদমুখী করে নামাজি ও অপরাধমুক্ত সুন্দর জীবন গঠনে এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। যদিও ভেবেছিলাম হয়তো এ আহ্বানে তেমন সাড়া পাবো না।
কিন্তু আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া যে, এ ঘোষণায় এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই মসজিদে শিশুদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি চকলেট (৫৮) পাওয়া ৮ বছরের শিশু সালেহকে সাপ্তাহিক পুরস্কার হিসেবে জ্যামিতি বক্স প্রদান করি।
বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে মসজিদে ইমাম আরও ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘শুধু নামাজ পড়ার জন্যই নয়, বরং মসজিদে নামাজ পড়ার পর তারা খেলবে, দৌড়াদৌড়ি করবে, আনন্দ করবে।’
ইমামের এমন ঘোষণায় স্থানীয় কিছু মুসল্লি রেগে যায়। আবার কেউ কেউ মারাত্মক বিরক্তি প্রকাশ করলে মসজিদের ইমাম সরাসরি এসব মুসল্লিদের বলেন-‘যারা মসজিদে শিশুদের আসা-যাওয়া সহ্য করতে পারবে না, তারা চাইলে অন্য মসজিদে চলে যেতে পারেন। শিশুদের আসা-যাওয়ার কারণে যেসব মুসল্লি বিরক্তি কিংবা রেগে যাবেন আমি তাদের ইমামতি করব না। বরং যারা ধৈর্যশীল মুসল্লি, আমি শুধু তাদের ও শিশুদের ইমামতি করবো।’
কারণ শিশুরা ছোট থেকে নামাজে অভ্যস্ত হলে মসজিদ কখনো মুসল্লি শূন্য হবে না। যারা এখন শিশু, কম-বেশি দুষ্টুমি করলেও বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। তাদের বুঝানো এবং নামাজে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে সব মুসল্লির নৈতিক দায়িত্ব ও বুদ্ধিমানের কাজ।
মসজিদে ইমামের এ ঘোষণা ফলে শুধু ছেলে শিশুরাই নয়, মেয়ে শিশুরাও বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে মসজিদে আসা শুরু করে। এরই মধ্যে ৬ বছরের এক মেয়ে শিশু সবচেয়ে বেশি মসজিদে এসে চকলেটসহ সপ্তাহিক পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন অ্যালার্ম ঘড়ি।
দেশের প্রতিটি মসজিদে শিশুদের অংশগ্রহণ বাড়লে, শিশুদের পদচারণায় মসজিদ মুখরিত হলে, নিয়মিত নামাজে শিশুদের অংশগ্রহণে মসজিদ আবাদ হলে কমে যাবে অপরাধ প্রবণতা। কুরআনের আলোয় আলোকিত হবে ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও দেশ।
আসুন, মসজিদমুখী প্রজন্ম গড়ে তুলি। প্রতিদিনের নামাজসহ সাপ্তাহিক জুমআর নামাজে শিশুদের নিয়ে মসজিদে উপস্থিত হই। শিশুদের পদচারণায় মুখরিত হোক মসজিদ। সুন্দর শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের কার্যক্রমে অশংগ্রহণ করি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস