বাংলাদেশে বসে পৃথিবীর অনেক টিভি দেখা যায়; তবে ক্যাবল টিভির মাধ্যমে আমরা বেশি দেখতে পাই ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো। ভারতে বাংলাদেশের কোনো প্রাইভেট চ্যানেল সম্প্রচারের ব্যবস্থা না থাকলেও ভারতীয় সরকারি-বেসরকারি প্রায় প্রতিটি চ্যানেলই এখানে দেখা যায়। পারিবারিক কলহে ভরপুর ড্রামা সিরিয়ালের পাশাপাশি ক্রাইম পরিকল্পনা শোগুলো এখানে খুব জনপ্রিয় এবং তার প্রতিক্রিয়ায় পরিবারে কলহ, তরুণদের ক্রাইম প্যাট্রল দেখে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সংবাদও মিডিয়ায় আসে।
Advertisement
এত গেল বিনোদন টিভির সংবাদ কিন্তু এর বাইরে সংবাদ প্রচারের জন্য রয়েছে তাদের অনেক চ্যানেল। তার মধ্যে জি নিউজ, এনডিটিভি, রিপাবলিক টিভি, আজতক ও দূরদর্শনসহ কলকাতার অনেক বাংলা চ্যানেল ঢাকায় দেখা যায়। এনডিটিভি ছাড়া ভারতীয় একটি চ্যানেলও অসাম্প্রদায়িক নয়, যেগুলো বাংলাদেশে সম্প্রচারিত হয়। সিংহভাগ মোদি সরকারের গুণগান আর সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারে ব্যস্ত। করোনার জন্য তাবলিগকে দায়ী করা বা দিল্লি দাঙ্গার রিপোর্টিং, শাহীনবাগের অবস্থান কর্মসূচি- সর্বত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা ছড়ানো, তাদের দেশদ্রোহি, সন্ত্রাসী বানানোই হচ্ছে এসব মিডিয়ার টার্গেট, যাদের ভারতের প্রগতিশীল মানুষরা নাম দিয়েছে ‘গোদি মিডিয়া’।
এসব চ্যানেলের মধ্যে জি নিউজ, আজতক, রিপাবলিক টিভি, ইন্ডিয়া টিভি প্রতিনিয়ত প্রচার করছে সংবাদের নামে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প এবং ঘৃণার কনটেন্ট। এদের প্রধান টার্গেট মুসলমান ও পাকিস্তান। সময় সময় বাংলাদেশ। যেমন সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে যখন দুর্নীতির দায়ে সহকর্মীরা বর্জন করেছিল এবং সরকারের সঙ্গে তার বিরোধ চরমে- তখন জি নিউজ এবং তাদের ইংরেজি চ্যানেল সিনহার একটি টেলিফোন সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করে। সেখানে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র এবং সিনহা হিন্দু ধর্মের সে কারণে সরকার তাকে বন্দি করে রেখেছে বলে প্রচার করে তারা।
সবচেয়ে আপত্তিকর ছিল সিনহার সঙ্গে ভারতীয় হাইকমিশনার দেখা করতে পারছে না- এই সংবাদ প্রচার। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করাটা ভারতীয় হাইকমিশনারের কোন দায়িত্বের মধ্যে পড়ে সেটা আজও আমার কাছে অমীমাংসিত প্রশ্ন। নাকি হিন্দু হলেই তার সঙ্গে দেখা করা ভারতীয় হাইকমিশনের অধিকারের মধ্যে পড়ে!
Advertisement
জি নিউজের দেখাদেখি অন্য টিভি ও নিউজ পোর্টাল সাম্প্রদায়িকতার রঙ ছড়িয়ে এটা নিয়ে সংবাদ প্রচার করেছিল। তবে বাংলাদেশ সরকার এটা নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দিয়েছে কিনা আমার চোখে পড়েনি। চলতি বছর ভারত-চীন দ্বন্দ্বের মধ্যে বাংলাদেশ কেন ভারতের পক্ষ নিচ্ছে না, কেন নিরপেক্ষ- সেটা নিয়েও ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচারে লিপ্ত ছিল।
গতকাল ২৩ ডিসেম্বর ২০২০, ভারতীয় মিডিয়ার একটি খবর আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ব্রিটেনের সম্প্রচার ও যোগাযোগ নিয়ন্ত্রক, অফিস অব কমিউনিকেশনস বা অফকম, দেশটির সম্প্রচার বিধিমালা মেনে চলতে ব্যর্থ হওয়ায় ‘রিপাবলিক ভারত’র সেবাদানকারী ওয়ার্ল্ডভিউ মিডিয়া নেটওয়ার্ক লিমিটেডকে ২০ হাজার পাউন্ড জরিমানা করেছে। ওয়ার্ল্ডভিউ মিডিয়া নেটওয়ার্ক লিমিটেড গত বছর হিন্দিতে সংবাদ এবং সাম্প্রতিক বিষয় সম্প্রচারের জন্য রিপাবলিক ভারতের লাইসেন্স পায়। রিপাবলিক টিভিকে জরিমানা করা হয়েছে ঘৃণা প্রচারের জন্য।
যে অনুষ্ঠানটির জন্য জরিমানা করা হয় সেটির উপস্থাপক ছিলেন রিপাবলিক টিভির এডিটর ইন চিফ অর্ণব গোস্বামী। ‘পুঁছতা হে ভারত’ নামের বিতর্ক অনুষ্ঠানটি ছিল ২২ জুলাই ২০১৯ সালে, ভারতের চন্দ্রায়ণ-২ মহাকাশযানটি চাঁদে প্রেরণে ভারতের প্রচেষ্টা নিয়ে। এটি যুক্তরাজ্যে প্রচারিত হয়েছিল ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে। অফকমের মতে, গোস্বামী এবং অতিথিরা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং পাকিস্তানের তুলনায় ভারতের মহাকাশ অনুসন্ধানের রেকর্ড এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চলমান বিরোধ এবং পাকিস্তানের সন্ত্রাসে জড়িত থাকার অভিযোগ আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করেন।
অফকম কয়েকটি উদাহরণ উদ্ধৃত করে বলেছে যে, দেখে মনে হয়েছিল যে সব পাকিস্তানিই সন্ত্রাসী। ‘তাদের বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, তাদের নেতা, রাজনীতিবিদ সবাই সন্ত্রাসী। এমনকি তাদের ক্রীড়াবিদরা, সেখানকার প্রতিটি শিশুই সন্ত্রাসী।’ এক অতিথি পাকিস্তানি বিজ্ঞানীদের ‘চোর’ ও অন্য একজন পাকিস্তানিদের ‘ভিক্ষুক’ বলে বর্ণনা করেছেন। এই সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপক (গোস্বামী), পাকিস্তান অথবা পাকিস্তানি জনগণকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, ‘আমরা বিজ্ঞানীদের তৈরি করি, তোমরা সন্ত্রাসী তৈরি করো।’
Advertisement
রিপাবলিক তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নিয়ে সাফাই দিয়েছে কিন্তু অফকম তাদের যুক্তিগুলোকে বাতিল করে দেয়। রিপাবলিক টিভি নিয়ে সর্বশেষ খবর হচ্ছে এটি এবার বাংলায় সম্প্রচারের জন্য কলকাতায় আসছে। এর প্রধান সম্পাদক সাম্প্রদায়িকতা এবং ঘৃণা প্রচারে সারা ভারতে একটি শ্রেণির কাছে খুবই জনপ্রিয় আর অসাম্প্রদায়িক শ্রেণি অর্ণবকে সাংবাদিক বলতেও ঘৃণাবোধ করে। সম্প্রতি খুনের অভিযোগে তাকে মুম্বাই পুলিশ গ্রেফতার করেছিল কিন্তু সরকারি আনুকূল্যে সর্বোচ্চ আদালতকে ব্যবহার করে তিনি বেরিয়ে এসে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং মহারাষ্ট্র সরকারের বিরুদ্ধে উগ্র কথাবার্তা, হুমকি চালিয়ে যাচ্ছেন, যা পৃথিবীর কোনো দেশে সাংবাদিকতা বলে স্বীকৃত নয়।
রিপাবলিক কলকাতায় আসছে শুনে অনেকে আতঙ্কিত। কারণ এর আসার উদ্দেশ্য আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পশ্চিম বাংলায় হিন্দু-মুসলিম ঘৃণা ছড়ানো, যা বিজেপি এবং এই টিভির প্রধান কাজ। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যা সম্পর্ক তার অনেকখানি দখল করে আছে পশ্চিম বাংলা। ভারত তিস্তার পানি দিচ্ছে না বাংলাদেশকে, চুক্তি হতে পারছে না মমতার কারণে- এটা পুরোনো খবর। কিন্তু আসল খবর হচ্ছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে সেটা কোনো বাধা নয় আর মমতা চুক্তিতে বাধা দিচ্ছেন সে কারণে বাংলাদেশেরও মমতার ওপর কোনো ক্ষোভ নেই।
আগামী এপ্রিল-মে মাসের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশ স্বস্তিবোধ করার কোনো কারণ নেই। কারণ পশ্চিমবঙ্গে যে হারে হিন্দু জঙ্গিদের উত্থান হচ্ছে তার ছায়া বাংলাদেশেও পড়ছে। কথায় কথায় সেখানকার মুসলমানদের বাংলাদেশে চলে আসার হুমকি দেয় হিন্দুত্ববাদীরা। মমতার শাসনে সেখানে সাম্প্রদায়িকতা কমেছে বলা যায় না কিন্তু মুসলমানরা অন্তত অসহায়বোধ করে না। বিজেপি এলে মুসলিম নির্যাতন আর বাংলাদেশের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক ইস্যু তুলে চলমান সম্পর্কের মধ্যে যে বিষ ঢালবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রিপাবলিক বাংলা সেখানে আগুনে ঘি ঢালার কাজটি করবে প্রথম দিন থেকে।
বাংলাদেশ সরকার দেশি টিভিতে কী কী সম্প্রচার হচ্ছে সেটা নিয়ে খুব তৎপর। কিন্তু এর পাশাপাশি বিদেশি টিভি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে এখন। বাংলাদেশের আকাশকে অবাধ রেখে ভারতীয় নিউজ চ্যানেলকে আমাদের সমাজে ঘৃণা ও সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর সুযোগ করে দেয়া উচিত না আমাদের। অবাধে চলছে বলে ব্রিটেনের মতো আমাদের কোনো মনিটরিং সংস্থার এদের জরিমানা করারও সুযোগ নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। anisalamgir@gmail.com
এইচআর/বিএ/এমকেএইচ