ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার হাইলাকাঠি গ্রামে ৭৫টি পরিবার রয়েছে, যারা শীতলপাটি তৈরি ও বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। পাটি গাছের বাগান ও শীতলপাটি বুননের খ্যাতির কারণে গ্রামটি ‘পাটিগ্রাম’ এবং এ কাজে যারা জড়িত তারা ‘পাটিকর’ হিসেবে এলাকায় পরিচিত। এছাড়া ঝালকাঠিতে মোট ১১টি গ্রামের দুই শতাধিক পরিবার এ কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন।
Advertisement
প্রতিবছর পাটি তৈরির মৌসুমে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নেন এই পাটিকররা। এ বছর (মার্চ-মে) পাটি বিক্রির মূল মৌসুমে করোনা মহামারির কারণে তাদের কয়েক হাজার পাটি অবিক্রীত অবস্থায় থেকে যায়। মৌসুম শেষ হওয়ায় এক হাজার টাকার শীতলপাটি বিক্রি করতে হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। আবার এনজিও থেকে নেয়া ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তারা সেটি নিয়েও বিপাকে। প্রতিদিনই ঋণ উত্তোলনকারীদের বিভিন্ন ধরনের অশালীন কথা শুনতে হচ্ছে এই পাটিকরদের।
পাটিকররা জানান, সব মিলিয়ে এই মৌসুমে তারা অন্তত দেড় কোটি টাকা লোকসানে রয়েছেন। আবার প্লাস্টিকের তৈরি পাটিতে বাজার সয়লাব হওয়ায় তাদের পেশায় টিকে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।
পাটিকর বাবুল এ বিষয়ে বলেন, শীত মৌসুমে বাগান থেকে পাটিগাছ কেটে শীতলপাটির জন্য বেতি (কাঁচামাল) তৈরি করা হয়। এ সময়ে আমরা বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নেই। তা দিয়ে কাঁচামাল কিনি এবং সংসার চালাই। গতবছর ঋণ নিয়ে ১২০টি শীতলপাটি বুনেছিলাম। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে কোথাও কোনো মেলা বা অনুষ্ঠান না হওয়ায় পাটিগুলো ঘরেই থেকে গেছে। প্রতিটি পাটি এক হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারলে কমপক্ষে এক লাখ ২০ হাজার টাকা উপার্জন হতো। সেই পাটি এখন অনেক কমদামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আবার ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় ঋণ আদায়কারীদের অনেক গালমন্দও শুনতে হচ্ছে।’
Advertisement
আরেক পাটিকর নির্মল বলেন, প্রতিবছর যে পাটি এক হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করি, গত মৌসুমে বুনানো সেই পাটি এখন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। উপায় না পেয়ে নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাচ্ছি।
এ বিষয়ে ঝালকাঠি পাটিকর সমিতির সাবেক সভাপতি বলাই পাটিকর বলেন, চট্টগ্রামে জব্বারের বলিখেলা অনুষ্ঠানের মেলা, চরমোনাই-ছারছিনা মাহফিল এবং বিভিন্ন মেলা ও অনুষ্ঠানে জেলার ১১টি গ্রাম থেকে ১৫ হাজারেরও বেশি পাটি বিক্রি হতো। কিন্তু এবার করোনার কারণে আমাদের বুনানো পাটি ঘরেই আছে। কোথাও কোনো পাটি বিক্রি করতে পারিনি। দুই শতাধিক পরিবারের প্রতিটি পরিবার লক্ষাধিক টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সবাই মহাবিপাকে আছি। একদিকে পাটি বিক্রি করতে না পারায় লোকসান, অন্যদিকে ঋণ পরিশোধের চাপ।
তিনি আরও বলেন, প্লাস্টিকের তৈরি পাটি কমদামে গ্রামাঞ্চলে বিক্রির ফলে আমাদের পাটির বিক্রি কমে গেছে। এ কারণে শীতলপাটি বিক্রি লাভজনক না হওয়ায় অনেক পাটিকর কাজ থেকে সরে গেছেন। কেউ এখন অটো চালাচ্ছেন, কেউ রিকশা, কেউ ফেরিওয়ালা, দোকানি। আমরা কতদিন এ পেশায় টিকে থাকতে পারব জানি না।
পাটিকর সমিতির সভাপতি তাপস পাটিকর বলেন, ঝালকাঠির শীতলপাটি দেশে-বিদেশে সমাদৃত। ঝালকাঠিতে অতিথি এলে তাকে শীতলপাটি উপহার দেয়া হয়। প্রতিবছর শীত মৌসুমে কাঁচামাল প্রস্তুত করে শীতলপাটি বুনিয়ে চৈত্র-বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে বিভিন্ন মেলা, মাহফিল ও অনুষ্ঠানে বিক্রি করা হয়। এ সময় এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সংসার চালান পাটিকররা। কিন্তু গতবছর শীত মৌসুমে বুনানো পাটি কোথাও বিক্রি করতে না পারায় এখনও ঘরে রয়েছে।
Advertisement
বর্তমানে ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার হাইলাকাঠি ও ডহরশংকর গ্রামে রয়েছে দুই শতাধিক পরিবার। এদের অধিকাংশই পাটি বুনে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই দুই গ্রামের শত শত হেক্টর জমিজুড়ে বিশাল নজরকাড়া পাটিগাছের বাগান। এখানে শীতলপাটি, নামাজের পাটি ও আসন পাটি নামে তিন ধরনের পাটি তৈরি করা হয়।
স্থানীয় মঞ্জুরানী পাটিকর বলেন, আমাদের অন্য কোনো উপার্জন নেই। শুধু শীতলপাটি বিক্রি করেই সংসারের খরচ এবং ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া চালাই। শীত মৌসুমে এবং বর্ষার সময় আর্থিক সংকটে ভুগতে হয়। তখন এনজিও থেকে চড়াসুদে ঋণ নিতে হয়। সরকার যদি বিনা সুদে ঋণ দিত তাহলে আরও বেশি শীতলপাটি তৈরি করা সম্ভব হতো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি পাটি বুনতে তিন-চারজন মানুষের দু-তিনদিন সময় লাগে। পাটি বিক্রি করে পাঁচশ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আসে। পাইত্রা (পাটি গাছ) চাষ ও কেনার জন্য মূলধন প্রয়োজন হয়। এ জন্য পাটিকররা মহাজন ও এনজিওগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। পাটিকরদের জন্য কোনো ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা না থাকায় পুঁজির জন্য তারা দাদন ব্যবসায়ী ও মহাজনদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন। তাছাড়া বিদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এখন পর্যন্ত শীতলপাটি রফতানিযোগ্য পণ্যের স্বীকৃতি পায়নি।
মো. আতিকুর রহমান/এমএইচআর/বিএ/এমকেএইচ