গ্রামের স্কুলেই অনেকে পড়েছি আমরা। যখন স্কুলে পড়েছি তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটা আধুনিকও ছিল না। ছিল না ইন্ট্যারনেট ব্যবহারের কোন সুযোগ। তখন জাতীয় পতাকা তৈরি করতো গ্রামের দর্জিরাই। তারপরও এতবড় ভুল বা বিকৃতি ঘটেছে বলে খুব একটা শোনা যেত না। আর এখন এই আধুনিক যুগে কি করে এতবড় অপরাধ সংগঠিত হলো। আর এই অপরাধের সাথে কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, কলেজের শিক্ষরা জড়িত নন। জড়িত দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
Advertisement
জাতীয় পতাকা বিকৃতি করার পরও কি আমরা তাদের দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের শিক্ষক বলতে পারি? আর যদি শিক্ষক বলি তাহলে বুঝতে হবে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যত কতটা অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছি আমরা। যে শিক্ষক জাতীয় পতাকা সম্পর্কে জানেন না, এই আধুনিক যুগে বিকৃতভাবে জাতীয় পতাকা হাতে ছবি তোলেন তাদের যোগ্যতা- দেশপ্রেম-জ্ঞান নিয়ে তো প্রশ্ন থাকতেই পারে।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কয়েকজন শিক্ষক এই বিকৃত জাতীয় পতাকা ব্যবহার করেছন তাদের কি শাস্তি হবে বা হওয়া উচিত? আজ যদি এই বিষয়টি কোন মাদ্রাসা বা সাধারণ স্কুল কলেজে ঘটতো তাহলে যে পরিমাণ তুল-কালাম ঘটতো তা কি ঘটেছে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এই ধরনের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। বিজয় দিবসে জাতীয় পতাকাকে অবমাননা! পতাকার ডিজাইন পরিবর্তন করা, বৃত্ত না দিয়ে চারকোণার মতো আকৃতি দেয়া প্রমাণ করে এই সকল শিক্ষকরা কেউ যোগ্য নন। তাদের দেশপ্রেমও প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অনুষ্ঠানটা ছিল কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান। সুতরাং এর পুরো দায়-দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং কর্তৃপক্ষের। যারা করেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের যারা এর সাথে রয়েছে তারা সবাই সমভাবে অপরাধী।
Advertisement
যারা মহান মুক্তিযুদ্ধ ও এক সাগরের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত লাল সবুজের পতাকাকে বিকৃতি করেছে তারা দেশদ্রোহী। এখন তারা যে মতবাদের বা যে রাজনীতির কথাই বলে থাকুন না কেন। মনে রাখতে হবে, দেশদ্রোহীরা দেশপ্রেমিকদের সাথেই মুখোশ পড়ে অবস্থান করে এবং এরাই আবার সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেদের মুখোশ খুলে স্বরুপে ফিরে আসে।
আর এই সকল জাতীয় অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কেন উপস্থিত থাকেন না? শোনা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ধারাবাহিক অনুপস্থিতি প্রতিষ্ঠানে সকল শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে। সরকার দলের সমর্থক নীল দলের শিক্ষকরাও এসব কথা বলেছেন। তারা মনে করেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও মহান বিজয় দিবসেও উপাচার্য অনুপস্থিত ছিলেন এবং দায়সারাভাবে এই জাতীয় দিবসসমূহ পালন করেছেন। এ ছাড়াও অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনা ঘটার পরেও তিনি ক্যাম্পাসে আসেননি। এমনকি এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি। এরপরও কি উপাচার্য তার দায় এড়াতে পারেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ আর লাল-সবুজের পতাকা। হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা, স্বাধীন মানচিত্র ও স্বাধীন পতাকা। বিজয় দিবস উদযাপিত হয় মহাসমারোহে। এদিন সারাদেশ ছেয়ে যায় লাল-সবুজের সাজে। বাড়ির ছাদে, দোকানে, রাস্তার পাশে, গাড়ির সামনে, এমনকি রিকশার সামনের ডান হ্যান্ডেলে পতপত করে ওড়ে লাল-সবুজ রঙের জাতীয় পতাকা। সবার ধারণা, যেকোনো জাতীয় দিবসে পতাকা উত্তোলন করা যায়। কোন কোন দিবসে, কিভাবে পতাকা উত্তোলন করতে হয়, এসব নিয়ম-কানুন অনেকেই জানি না। আবার যারা পতাকা তৈরি করেন; তারাও ঠিকঠাক জানেন না, আইনে পতাকার আকার ও রঙের ব্যাপারে কী বলা হয়েছে? অনেকেই সচেতন না হওয়ায় জাতীয় পতাকার অবমাননা হয়ে যায়। তাই জাতীয় পতাকার ব্যাপারে সবার সচেতন হওয়া একান্ত দরকার।
সবাইকে মনে রাখতে হবে, আমাদের এই লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা শুধু একখণ্ড কাপড় নয়। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক-মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ইতিহাস অনেক ত্যাগ ও আবেগের। লাল-সবুজে মিশে রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের পবিত্র রক্ত। এ পতাকা পুরো বাংলাদেশকে ধারণ করেছে তার বুকে। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ইতিহাসের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ জড়িয়ে রয়েছে বলেই এর প্রতি আমাদের আবেগটাও ভিন্ন।
Advertisement
জাতীয় পতাকার বিকৃতি বা অবমাননা করার অর্থ হচ্ছে স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা। স্বাধীন-স্বার্বভৌম বাংলাদেশকে অস্বীকার করা। আবেগের বসে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে গিয়ে অনেক কষ্টে অর্জিত এ পতাকার প্রতি যদি অবমূল্যায়ন করা হয়, তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা কষ্ট পাবে। অনেক রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধারা এই দেশ স্বাধীন করেছেন, উড়িয়েছেন লাল-সবুজের পতাকা। তাই জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা নাগরিক হিসাবে আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় পতাকা বিকৃতির মাধ্যমে যারা মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করেছেন তারা যারাই হোন না কেন, যে মতবাদেরই হোন না কেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রয়োজন। আশা করি সরকার তদন্ত কমিটি গঠন-দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার নামে কোন মহলের অসৎ উদেশ্য বাস্তবায়ন না করে শাস্তি নিশ্চিত করবেন। যাদের জাতীয় পতাকা সম্পর্কে জ্ঞান নাই তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে থাকার অধিকারও নেই।
এটি আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মর্যাদা হারিয়েছে। হয়তো শিক্ষকরা মানতে চাইবেন না বিষয়টি। তবে, এটি সত্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খোদ পড়াশোনাটাই আজ উপেক্ষিত। শিক্ষার পরিবেশের ভয়ানক দুর্দশা চলছে। আছে কেবল সরকারি দলের ছাত্র-সংগঠনের নানা কর্মকাণ্ড আর সরকারপন্থী শিক্ষকদের নানা গ্রুপিং। রাজনীতিই বড় সমস্যা। রাজনীতির কারণে শিক্ষক নিয়োগে মান বজায় রাখা যাচ্ছে না। আমাদের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের কোনো র্যাংকিংয়ে আসে না। সরকারের তথা জনগণের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে, শিক্ষক-অশিক্ষক সব কর্মী বেতন পান। অথচ স্বায়ত্তশাসন নামের এক বিধানের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বড় বড় অন্যায় আর অপরাধ দেখেও ব্যবস্থা নিতে পারে না।
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ব্যক্তিই দেশের জন্য সত্যিকারভাবে কাজ করতে পারে। তাই স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে গড়ে তুলতে হবে, তাদের জাতীয় পতাকা সম্পর্কেও শিক্ষা দিতে হবে। এজন্য তাদেরকে যথাযথভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, পতাকা তৈরি ও অর্জনের ইতিহাস জানাতে হবে।
লেখক : রাজনীতিক, কলাম লেখক।gmbhuiyan@gmail.com
এইচআর/জেআইএম