মতামত

চীনের সফল ‘ছাং এ ৫’ মিশন ও ১৭৩১ গ্রাম চন্দ্রমৃত্তিকার তাৎপর্য

যুক্তরাষ্ট্রের নাসা-র উপ-প্রধান বিজ্ঞানী ডেভিড ড্রেপার নিউইয়র্ক টাইমসকে চীনের সর্বশেষ চন্দ্রাভিযান সম্পর্কে একবার বলেছিলেন: ‘এটি সত্যিই একটি দুঃসাহসী ও স্পর্ধার মিশন।’ এই ‘স্পর্ধার’ মিশনটি অবশেষে সফলভাবে শেষ হয়েছে। অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে, প্রাচীন চীনের চাঁদের দেবী ‘ছাং এ’-র নামে নামকরণ করা চীনের পঞ্চম চন্দ্রযানের প্রায় তিন সপ্তাহের মিশন শেষ হয় বেইজিংয়ের স্থানীয় সময় ১৬ ডিসেম্বর দিবাগত মধ্যরাত ১টা ৫৯ মিনিটে।

Advertisement

‘ছাং এ ৫’ চাঁদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিল গত ২৪ নভেম্বর। গোটা মিশনে এটি চাঁদকে প্রদক্ষিণ করেছে, চাঁদে অবতরণ করেছে, চাঁদের মাটি ও পাথর সংগ্রহ করেছে, এবং অবশেষে সেই মাটি ও পাথর—যার ওজন প্রায় ১৭৩১ গ্রাম— নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। চাঁদের মাটি ও পাথর বহনকারী ‘রিটার্নার’ ক্যাপসুলটি চীনের ইনার মঙ্গোলিয়ার সিচিওয়াং বান্নার নামক স্থানে অবতরণ করে। ক্যাপসুলটি খুঁজে বের করার দায়িত্বে নিয়োজিতদের সেটি খুঁজে বের করতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি।

চাঁদ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চীনে শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে। তবে, চীনের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর প্রথম চন্দ্রযান ‘ছাং এ ১’ উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হন। তারপর একে একে উৎক্ষেপণ করা হয় ‘ছাং এ ২’, ‘ছাং এ ৩’, ও ‘ছাং এ ৪’ চন্দ্রযান। এর মধ্যে চতুর্থ যানটি চীন অবতরণ করিয়েছিল চাঁদের অন্ধকার অংশে, যেখানে আগে পৃথিবীর কোনো যান অবতরণ করেনি। সেই যানের রোভার (rover) এখনও চাঁদের বুকে সক্রিয় আছে।

আগের চারটি মিশনের তুলনায় ‘ছাং এ ৫’ মিশন ছিল অনেক বেশি জটিল ও চ্যালেঞ্জিং। বিষয়টা স্পষ্ট করতে গোটা মিশনের টাইমলাইনটার ওপর আসুন একটু চোখ বুলিয়ে নিই। ২৪ নভেম্বর ‘ছাং এ ৫’ চন্দ্রযান চাঁদের উদ্দেশ্যে উৎক্ষেপণ করা হয় চীনের হাইনান প্রদেশের ওয়েনছাং মহাকাশযান উৎক্ষেপণকেন্দ্র থেকে। উৎক্ষেপণের জন্য ব্যবহৃত হয় চীনের বিখ্যাত ‘লংমার্চ-৫’ রকেট। ২৮ নভেম্বর চীনা চন্দ্রযানটি প্রবেশ করে চাঁদের নির্ধারিত কক্ষপথে। ‘ছাং এ ৫’ চন্দ্রযানে মূলত দুটি অংশ ছিল: ল্যান্ডার-অ্যাসেন্ডার (lander-ascender) অংশ (ল্যান্ডার চাঁদের বুকে অবতরণের জন্য এবং অ্যাসেন্ডার চাঁদের বুক থেকে উড্ডয়নের পর অরবিটারের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য) ও অরবিটার-রিটার্নার (orbiter-returner) অংশ (অরবিটার চাঁদকে প্রদক্ষিণ অব্যাহত রাখার জন্য এবং রিটার্নার চাঁদের মাটি ও পাথর নিয়ে পৃথিবীপৃষ্ঠে অবতরণের জন্য)। এ দুটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে ল্যান্ডার-অ্যাসেন্ডার অংশটি চাঁদের বুকে অবতরণ করে পয়লা ডিসেম্বর ও চাঁদের নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু করে। পরবর্তী দু’দিনে ল্যান্ডার-অ্যাসেন্ডার অংশের রোবট চাঁদের বুকে ড্রিল করে প্রায় ৬ ফুট নিচ থেকে ও চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে এবং চাঁদের বুকে চীনের পতাকা স্থাপন করে। ৩ ডিসেম্বর চাঁদের নমুনাসহ অ্যাসেন্ডার অংশটি উড্ডয়ন করে ও চাঁদের পূর্বনির্ধারিত কক্ষপথে প্রবেশ করে। ৬ ডিসেম্বর অ্যাসেন্ডার অংশটি অরবিটার-রিটার্নার অংশের সঙ্গে সংযুক্ত হয় ও চন্দ্রমৃত্তিকাসমৃদ্ধ কনটেইনারটি রিটার্নারে স্থানান্তর করে। পরে অ্যাসেন্ডারটি অরবিটার-রিটার্নার অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে চাঁদের বুকে নেমে যায় (এটা করা হয়েছে মহাকাশের পরিবেশ রক্ষার জন্য; চাঁদের কক্ষপথে যেন অকারণে একটি মহাকাশ-যন্ত্রাংশ জট না-পাকাতে পারে!)। আর অরবিটার-রিটার্নার অংশটি ১৩ ডিসেম্বের প্রবেশ করে চাঁদ-পৃথিবী স্থানান্তর কক্ষপথে (moon-Earth transfer orbit)। ১৭ ডিসেম্বর রিটার্নার বিচ্ছিন্ন হয় অরবিটার থেকে ও চীনের ইনার মঙ্গোলিয়ায় প্যারাসুটের সাহায্যে অবতরণ করে।

Advertisement

জটিল মিশন সফলভাবে সম্পন্ন করে, ‘ছাং এ ৫’ চন্দ্রযানের ‘রিটার্নার’ ক্যাপসুলটি চাঁদের ১৭৩১ গ্রাম পাথর ও মাটি নিয়ে আসে পৃথিবীতে। প্রায় ৪০ বছর পর পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ থেকে আবারও চন্দ্রমৃত্তিকা এলো পৃথিবীর বুকে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যাপোলো প্রজেক্ট’-এর আওতায় নভোচারীদের মাধ্যমে চাঁদ থেকে ৩৮০ কিলোগ্রাম মাটি ও পাথর পৃথিবীতে নিয়ে আসা হয়েছিল। আর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন মানববিহীন যানের মাধ্যমে তিন বারে চাঁদ থেকে মোট ৩০০ গ্রাম মাটি ও পাথর পৃথিবীতে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়।

যাই হোক, চীনের ‘ছাং এ ৫’ মিশন নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ ও এ মিশন থেকে সংগৃহীত চন্দ্রমৃত্তিকাও তাৎপর্যময়। চীন এই মিশনের মাধ্যমে পৃথিবীর বাইরের কোনো উপগ্রহ বা গ্রহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার প্রযুক্তি আয়ত্ত করেছে। চীন চাঁদের মেরু অঞ্চলে চন্দ্রযান পাঠাতে চায়; গড়ে তুলতে চায় চাঁদের বুকে স্থায়ী গবেষণাগার। এ লক্ষ্য অর্জনে ‘ছাং এ’ গ্রুপের আরও কয়েকটি চন্দ্রযান অদূর ভবিষ্যতে চাঁদে পাঠানোর পরিকল্পনা চীনের। শুধু তাই নয়, ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পরিকল্পনা আছে চীনের। ‘ছাং এ ৫’ মিশনের সাফল্য এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথেও চীনকে এগিয়ে দিয়েছে অনেকটা।

‘ছাং এ ৫’ মিশনের মাধ্যমে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা ৪০ বছর পর আবারও চাঁদের মাটি-পাথর নিয়ে গবেষণার সুযোগ পেয়েছেন। এ মাটি ও পাথর চাঁদের ‘মনস রামখা’ (Mons Rumker) নামের আগ্নেয় সমভূমি (volcanic plain) থেকে সংগৃহীত হওয়ায় বিজ্ঞানীদের কাছে আলাদা গুরুত্বও পাচ্ছে। নাসার বিজ্ঞানী ডেভিড ড্রেপার বলেছেন, এই স্থানের নমুনা নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা চাঁদের ইতিহাস সম্পর্কে নতুন তথ্য পাবেন। বস্তুত, ‘ছাং এ ৫’ কর্তৃক সংগৃহীত নমুনা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কেও অজানা তথ্য পেতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। চীনা বিজ্ঞান একাডেমির ইন্সটিটিউট অব জিওলোজি অ্যান্ড জিওফিজিক্সের গবেষক লিন ইয়াংথিং বলেছেন, “চাঁদের মাটি হচ্ছে একটি গোপন বইয়ের মতো, যাতে পৃথিবী, সূর্য ও চাঁদের অনেক গোপন তথ্য লুকিয়ে আছে। আমাদের সৌরজগত ও পৃথিবীকে আরও ভালোভাবে জানতে চাঁদের মাটির গবেষণা সাহায্য করবে।”

চাঁদ থেকে সংগৃহীত ১৭৩১ গ্রাম মাটি ও পাথর নিয়ে গবেষণা আরেকটি কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ; শুধু চীনের জন্য নয়, গোটা মানবজাতির জন্য। কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন, চাঁদের বুকে বিপুল পরিমাণ হিলিয়াম-৩ (Hilium-3) পাওয়া যেতে পারে। হিলিয়াম-৩ হচ্ছে একটি হালকা গ্যাসীয় উপাদান। আমাদের জানা বিশ্বের সবচেয়ে হালকা গ্যাসীয় উপাদান হচ্ছে হাইড্রোজেন। এক্ষেত্রে হিলিয়ামের স্থান দ্বিতীয়। আবার আমাদের জানা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আছে হাইড্রোজেন। এক্ষেত্রেও দ্বিতীয় স্থানে আছে হিলিয়াম। তো, হিলিয়াম-৩ হচ্ছে এই হিলিয়ামের একটি হালকা ও স্থিতিশীল আইসোটোপ। এর দুটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন। ১৯৩৯ সালে বিজ্ঞানীরা হিলিয়াম-৩ আবিষ্কার করেন।

Advertisement

এই হিলিয়াম-৩ চাঁদের বুকে যথেষ্ট পরিমাণে মজুত আছে বলে কোনো কোনো বিজ্ঞানীর ধারণা। আর এতে আনন্দিত হবার কারণ হচ্ছে, পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনে হিলিয়াম-৩- এর ব্যবহারের বিপুল সম্ভাবনা। অনেকেই হিলিয়াম-৩-কে দেখছেন ভবিষ্যতের পৃথিবীর ‘শক্তির উৎস’ হিসেবে। কারণ, হিলিয়াম-৩ ব্যবহার করে পারমাণবিক শক্তি উৎপন্ন করলে অন্তত দু’দিকে লাভ: শক্তি উৎপন্ন হবে অনেক অনেক বেশি এবং এতে তেজস্ক্রিয় উপজাত (radioactive byproduct) সৃষ্টি হবে না বললেই চলে। ফলে এটি হতে পারে তেল ও গ্যাসের পারফেক্ট বিকল্প। চীনের চন্দ্রাভিযান প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন পরামর্শক ও এ প্রকল্পের সাবেক মুখ্য বিজ্ঞানী উইয়াং জিইউয়ান (Ouyang Ziyuan)বলেছেন, যদি চাঁদ থেকে হিলিয়াম-৩ সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসা ও তা পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনে ব্যবহারের স্বপ্ন পূরণ হয়, তাহলে গোটা পৃথিবীর ১০ হাজার বছরের শক্তির চাহিদা পূরণ হতে পারে।

চীনের বিজ্ঞান একাডেমির চন্দ্র ও গ্রহবিজ্ঞান কেন্দ্রের পরিচালক লি সিয়ংইয়াও (Li Xiongyao) চন্দ্রমৃত্তিকা নিয়ে গবেষণার আরেকটি সুফলের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, চাঁদের মাটি পৃথিবী থেকে পাঠানো চন্দ্রযান ও নভোচারীদের জন্য কী ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে, তা জানা খুব জরুরি। প্রাপ্ত চন্দ্রমৃত্তিকা নিয়ে গবেষণা করে এ তথ্য জানা যেতে পারে এবং ভবিষ্যতের চন্দ্রাভিযানে সে সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হতে পারে।

চাঁদ থেকে নিয়ে আসা যুক্তরাষ্ট্রের নাসা’র বিজ্ঞানীদের ৩৮০ কিলোগ্রাম মাটি ও পাথরের চেয়ে অনেক কম ওজন ‘ছাং এ ৫’-এর নিয়ে আসা ১৭৩১ গ্রাম চন্দ্রমৃত্তিকা। সোভিয়েত চন্দ্রযানের আনা ৩০০ গ্রামের চেয়ে আবার এ প্রায় ৬ গুণ বেশি। কিন্তু ওজন এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সময় ও সংগ্রহস্থল। তাই, চীনা বিজ্ঞানীদের মতো, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন এই চন্দ্রমৃত্তিকা নিয়ে গবেষণা করতে। চীনও এ ব্যাপারে উদার মনোভাব দেখাচ্ছে; বলছে, বিদেশি বিজ্ঞানীরাও সুযোগ পাবেন। শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা, পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ থেকে উড়ে আসা, এই চন্দ্রমৃত্তিকা থেকে কী তথ্য উদ্ধার করতে পারেন, তা-ই এখন দেখার বিষয়।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।alimulh@yahoo.com

এইচআর/জেআইএম