থমাস এল. ফ্রাইডম্যান
Advertisement
আমেরিকার ছোট শহরগুলোর ডিজিটাল অর্থনৈতিক উন্নয়ন কীভাবে ত্বরান্বিত হবে এই বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি আমি গ্রামীণ উদ্ভাবন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ম্যাট ডানের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তিনি তার বাসার পাশের ভার্মন্ট কমিউনিটি সম্পর্কে বলছিলেন, যেখানে একটি বড় গণগ্রন্থাগার আছে। তিনি বললেন, আপনি রোববারে গিয়ে দেখবেন সেখানকার পার্কিংয়ের জায়গাটাও ভর্তি! একটাই সমস্যা এই লাইব্রেরিটা আগে এদিন করে বন্ধ ছিল।
আপনি দেখবেন সেখানে পার্কিংয়ের জায়গাটাও গাড়িতে পূর্ণ যেখানে শিশুরা তাদের বাসার কাজ এবং বড়রা বসে অফিসের কাজ করছে। তারা এখানকার ওয়্যারলেস সংযোগ ব্যবহার করছে। কর্তৃপক্ষ এই পাসওয়ার্ড সবার জন্য উন্মুক্ত করেছে কারণ গ্রামের এই এলাকাগুলোতে এখনও উচ্চগতিসম্পন্ন ব্রডব্যান্ড সংযোগ অপ্রতুল।
দুঃখজনক হলেও সত্য গ্রামে বসবাসকারী মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে বহুসংখ্যক মানুষ পাতাল রেলের পাশের স্যান্ডউইচের দোকান এবং ডেইরি কুইন্সে যায় কেবলমাত্র ফ্রি ওয়াই-ফাই সংযোগ পাওয়ার আশায়। এই কারণে আমি মনি করি নবনির্বাচিত মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সঙ্গে আমার এই বিষয়ে কথা বলা উচিত।
Advertisement
কেবল ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য হ্যারিস খুবই স্মার্ট এবং তেজদীপ্ত, যেটা একটা অবস্থান মাত্র, যারসঙ্গে কিছু দাফতরিক দায়িত্ব আছে। আমার ভালো লাগতো যদি নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতেন। তিনি কমলাকে পল্লী উন্নয়ন সম্পাদকের দায়িত্বও দিতে পারতেন। যার ফলে তিনি বৈষম্য দূর করে সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা, ইন্টারনেট সংযোগের নগর-গ্রামের ব্যবধান দূর করার জন্য কাজ করতে পারতেন। সেইসঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে সৃষ্ট বৈষম্য, চাকরিতে প্রবেশে বৈষম্য এগুলো ঘুচানোর চেষ্টা করতেন। আবার নানা রকম বঞ্চনার ফলে নগরীর মানুষের প্রতি গ্রামীণ জনমনে যে ক্ষোভ ও মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা নিরসনে কাজ করতে পারতেন।
গ্রামীণ আমেরিকায় ডেমোক্র্যাটরা রিপাবলিকানদের কাছে টিকতেই পারতো না। কিন্তু গত দুইবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প সেই ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছেন! এই বৈষম্যগুলো দূর করার দায়িত্ব হ্যারিসকে দিয়ে বাইডেনের দল একটা বাস্তবসম্মত কাজ করতে পারতো।
আমেরিকানদের মনে এটা নবউদ্দীপনার সঞ্চার করতো যে, ডেমোক্র্যাটরা গ্রামীণ সমাজকে রিপাবলিকানদের হাতে ছেড়ে দেয়নি। বরং তারা তাদের আধিপত্য খর্ব করতে যাচ্ছে। এটা হ্যারিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রথম দিন থেকেই তাকে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক করতে পারে।
ডেমোক্র্যাটদের শিশুসুলভ কাজ করা অনুচিত। বাইডেন নির্বাচনে কোনোমতে জিতেছেন, যেসব শহর ও উপশহরে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে বাইডেন সেখানে কোনোমতে উৎরে গেছেন। কারণ, সেখানে কিছু মানুষ ‘ট্রাম্পমুক্ত’ হোয়াইট হাউস চেয়েছেন। তবে কখনই পুলিশ প্রশাসনকে অসহযোগিতায় তাদের আগ্রহ ছিল না।
Advertisement
এটাও সত্য উপশহরের ভোটাররা ট্রাম্পকে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সেইসঙ্গে তারা গত কয়েক বছরে অতি-বাম ধারার গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণাও ছেঁকে ছেঁকে বাদ দিয়েছেন। ডেমোক্র্যাটরা প্রেসিডেন্সিতে জিতলেও সেই উপশহরগুলোর ভোটারদের কারণে অনেক আইনসভা, হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ ও সিনেটে পিছিয়ে পড়েছে।
ডেমোক্র্যাটরা যদি ২০২২ সাল কোনোমতে পার করে তবুও তারা ২০২৪ সালের দিকে একা হয়ে পড়বে। কেবল শহর ও উপশরের মাধ্যমে তারা উৎরে যাবে এমনটা ভাবা বোকামি। রিপাবলিকানরা যদি ট্রাম্পের চেয়ে বুদ্ধিমান ও জনগণের কাছে কম আপত্তিকর ব্যক্তির নেতৃত্বে চলে তবেই ডেমোক্র্যাটরা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়বে।
গ্রামীণ আমেরিকাকে কাঙ্ক্ষিত উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া মানেই পুরো আমেরিকার জন্য কাজ করা। যা একটি জাতিকে একসঙ্গে বেড়ে ওঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে বাইডেনের স্বপ্ন পূরণ করবে।
এই ধারণা ডেমোক্রেটিক পার্টির ডিএনএ-তে আছে। আমার নিজের রাজ্য মিনেসোটায় তারা এখনও ডেমোক্রেটিক কৃষক-শ্রমিক পার্টি (ডিএফএল) নামে পরিচিত। দলকে সেই জোট পুনর্গঠন করতে হবে।
‘একটা উপায়ে তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা যায়। যখন প্রকৃতপক্ষেই দল কৃষক, শ্রমিক এবং সাধারণ জনগণের ক্ষমতায়ন চাইবে।’ বলেছেন হার্ভাডের মিকাইল স্যান্ডেল। যিনি লিখেছেন ‘দ্য টিরান্নি অফ ম্যারিট: হোয়াটস বিকাম অফ দ্য কমন গুড?’ এর মতো বই। ডেমোক্র্যাটদের অবশ্যই ট্রাম্পের বর্ণবাদী, ধনতান্ত্রিক জনতামুখিতার বিপরীতে জনগণকে কীভাবে নাগরিক কর্মকাণ্ডসহ নগর এবং গ্রামের নানা কর্মকাণ্ডে নতুন করে নিযুক্ত করা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।
কমলা হ্যারিসের মিশন এটাই হওয়া উচিত। এটা একজন ভাইস প্রেসিডেন্টের জন্য গর্বের যা গ্রামীণ আমেরিকা হতে শুরু হবে। মিনেসোটার প্রভাবশালী কৃষক মালিকানাধীন সমিতির হেড কোয়ার্টারের প্রেসিডেন্ট ল্যান্ড ও’ল্যাকস বেথ ফর্ড বলেছেন, ‘আমি ‘গ্রামীণ’ শব্দটাকে ভয় পাই। এটা আমার সমস্যা না।’ কিন্তু তার যুক্তিতে যোগাযোগ ও প্রযুক্তিকে গ্রামীণ আমেরিকায় ছড়িয়ে দেওয়া ‘এটা আমেরিকান ইস্যু, আমেরিকান প্রতিযোগিতার ইস্যু এবং আমেরিকান জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু।’
‘গ্রামীণ আমেরিকার উন্নয়নে বিনিয়োগবিমুখতা আমাদের নিরাপত্তা ও উন্নতি প্রশমিত করবে। এর ফলে আমরা প্রতিযোগিতায় চীন থেকেও পিছিয়ে পড়বো। চীন গ্রামীণ উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।’ জানান ফোর্ড। তিনি বলেন, ‘প্রায় ৩৫ শতাংশ কৃষক নিজেদের খামার পরিচালনার জন্য ইন্টারনেটের ব্যান্ডউইথ যথাযথ পাচ্ছেন না, ছেলে-মেয়েদের সুশিক্ষার বন্দোবস্ত করতে পারছেন না। এমনকি তাদের দাদা-দাদীরাও টেলিমিডিসিন সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন।
বাইডেন-হ্যারিসের গ্রামীণ উন্নয়ন নীতি কেমন হওয়া উচিত? এটা প্রতিনিয়ত কেমন হবে তা যেন দৃশ্যমান হয়। ডুলুথের মেয়র এমিলি লারসন আমাকে বলেছেন, ‘দৃশ্যমান’ এবং ‘জনগণের কথা শোনা’ এমন সম্মান আমেরিকাকে আরও বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। আসলে সম্মানের সঙ্গে জনগণের কথা শোনার চেয়ে বড় সম্মান প্রদর্শন আর কিছুই হতে পারে না।
লারসন আরও বলেন, গ্রামীণ এলাকাগুলোর তাদের নিজেদের সামাজিক নেটওয়ার্ক আছে। কিন্তু সেগুলো বিভিন্ন মেট্রোপলিটন এলাকার নির্দিষ্ট কিছু জায়গায়। ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য ওই অঞ্চলগুলোতে লোকজনকে মধ্যরাতেও দেখা যাবে কিন্তু তারা এ বিষয়ে ফেসবুকে কোনো পোস্ট পর্যন্ত দেয় না!
বাইডেন-হ্যারিসের এই পদ্ধতি নির্ধারণ করা উচিত যে, আগামী চার বছরের মধ্যে গ্রামীণ সম্প্রদায়গুলো যেন ব্রডব্যান্ড সুবিধা পায়। যা আধুনিক অর্থনীতির উন্নয়নের অন্যতম অবকাঠামো হিসেবে কাজ করবে।
ম্যাট ডান পরামর্শ দিয়েছেন অনুন্নত সম্প্রদায়গুলোর জন্য ৫০ বছরের জন্য নতুন একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় লোনের ব্যবস্থা করতে যা হবে। অনুন্নত সম্প্রদায়গুলোকে যা দেয়া হবে। গ্রামীণ সম্প্রদায় যেন সরকারি-বেসরকারি যৌথভাবে ব্রডব্যান্ড কানেকশনে যুক্ত হতে পারেন। ইন্টারনেটের গতি প্রতি সেকেন্ডে ১০০ মেগাবাইট এবং ডাউনলোড যেন হয় উচ্চ গতি সম্পন্ন। যেখানে সব ধরনের দূরশিক্ষণের উপকরণ এবং টেলিহেলথ উপকরণ আপলোড করা থাকবে। রিপ্রেজেনটেটিভ (সংসদ সদস্য) জেমস কালিবার্ন এমনই একটি বিলে জয়ী হয়েছেন।
গত বছর ডানের সঙ্গে কত গিগাবাইট হাই-টেক নেটওয়ার্ক সাপোর্ট কৃষকদের দেওয়া হচ্ছে এটা দেখার জন্য রেড উইং, মিন ভ্রমণের সময় আমি অনেক লিখেছি। এমন অনেক আবিষ্কারক সম্পর্কে লিখেছি যারা একটা রোবোটিক রোস্টার চালু করেছে যা মুরগীর খামারে চলমান থাকে মৃতপাখিদের জন্য যতক্ষণ না তা একেবারে শুয়ে পড়ে। কিন্তু একটা অপ্রত্যাশিত বিষয় পাখিরা করে চলেছে যে তারা রোবটের মুখে পড়ার আগেই দ্রুত সরে পড়ছে।
যেখানে এই ‘পোল্ট্রি পেট্রল’ রোবট স্বয়ংক্রিয়ভাবে ৮০ ভাগ কাজ করে বলেন ডানে। তার কথা হলো এই রোবটগুলো দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় যা কেবল দ্রুতগতির ব্রডব্যান্ড সংযোগের মাধ্যমেই সম্ভব।
কিন্তু যখন ভালো সংযোগ জরুরি, তখন পর্যাপ্ত পাওয়া যায় না। ডান আরও বলেন, গ্রামীণ সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে আমাদের ডিজিটাল প্রশিক্ষণে বিনিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ছোট শহরগুলোতে কাজ করার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক কোম্পানিগুলোকে প্রণোদনা দিয়ে নিয়ে আসতে হবে। বর্তমানে দেশের মোট কাজের ১৫ ভাগ আমেরিকার গ্রামীণ জনগণ করে থাকে কিন্তু ভবিষ্যতে মাত্র ৫ ভাগ চাকরি আছে ডিজিটাল অর্থনীতিতে। তবে মহামারি মানুষকে শিখিয়ে দিয়েছে ডিজিটাল অর্থনৈতিক কাজ যেকোনো জায়গায় সৃষ্টি করা যায়।
কমলা হ্যারিস ওই কাজের জন্য উপযুক্ত। আমেরিকার সিলিকন ভ্যালিকে গ্রামীণ উপত্যকার সঙ্গে কে সংযোগ করতে পারবে? তিনি আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ অংশের সঙ্গে সেতুবন্ধন সৃষ্টির প্রাকৃতিক নির্মাতা। কারণ গ্রামীণ আমেরিকা শ্বেতাঙ্গদের আমেরিকা নয়। নগর ইন্সটিটিউটের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী আমেরিকানদের প্রতি পাঁচ জনে একজন গ্রামীণ সম্প্রদায়ে বাস করে এবং প্রতি পাঁচ জনে একজনের বেশি (২২ শতাংশ)কৃষ্ণাঙ্গ। আমি গত বছর উইলমার, মিন এবং একটি শহর সম্পর্কে লিখেছিলাম ১৯৫০ সালে যেগুলোর সবাই শ্বেতাঙ্গ ছিলেন। বর্তমানে অর্ধেক স্পেনীয়, সোমালিয়ান, এশিয়ান এবং নেটিভ (আদি) আমেরিকান।
মিনেসোটার ছোট্ট শহর যেমন উইলমার যা দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে তা অন্তর্ভুক্তি এবং বৈচিত্র ম্যানেজ করতে পারে। কারণ তারা নতুন শ্রমিক এবং গৃহ ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে যখন অনেক শ্বেতাঙ্গ তরুণ বড় বড় শহরে যাওয়ার আশার এলাকা ত্যাগ করে।
শিগগিরই হ্যারিস হবেন প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট যা স্বভাবতই নগরীর ভোটারদের মধ্যে অনুরণন সৃষ্টি করবে। যাহোক তিনি যদি বাইডেনের মন্ত্রিসভায় নিজেকে দেখাতে পারেন যে তিনিই প্রথম গ্রামীণ আমেরিকার কথা শুনেন, প্রথম তা নিয়ে সচেতনতাকে উৎসাহিত করেন এবং তিনিই প্রথম এই বিষয়কে গুরুত্ব দেন, তাহলে তিনি এবং ডেমোক্রেটরা গ্রামীণ রাজ্যগুলোর ভোটে নিজেকে আরও প্রতিযোগিতার জায়গায় নিয়ে যাবেন।
এমনকি এটা কেবল ১০ অথবা ১৫ পার্সেন্ট বেশি ভোট পেতে সাহায্য করবে। যেটা ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন রিপাবলিকান বলয় থেকে হোয়াইট হাউসকে বর্তমানে এবং আরও চার বছর পরও মুক্ত করবে। মানুষকে মানসিক সুস্থতা দান করবে। রিপাবলিকান পার্টির শক থেরাপি প্রয়োজন এবং প্রাচীন এই দলটি যখন দেখবে গ্রামীণ আমেরিকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে তখন তারা যে শক পাবে তার সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা করা যায় না।
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত
লেখক : বিদেশ বিষয়ক কলামনিস্ট। ১৯৮১ সালে তিনি নিউইয়র্ক টাইমসে যোগদান করেন। তিনবার পুলিৎজার পুরস্কার জয় করেন। ‘বৈরুত থেকে জেরুজালেম’ এর মতো জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বইসহ তিনি আরও সাতটি বই লিখেছেন।
অনুবাদ : সাখাওয়াত হোসেন সুজন
এইচআর/এসএইচএস/এমএস