আন্তর্জাতিক

নারী উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছে কোভিড-১৯

একটা সময় নারী-পুরুষের সমতার বিষয়টি ভাবাই যায়নি। বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে নারীকে সম্পত্তি হিসেবে উপস্থাপনের ঘটনাও কম দেখা যায়নি। অনেক দেশেই নারীরা তাদের পুরুষ অভিভাবকের কথার বাইরে এক চুলও নড়তে পারেন না। এসব দেশে জন্মের পর থেকেই বাবার কথামত চলতে হয়। আর বিয়ের পর স্বামীই যেন সব ধ্যান-জ্ঞান। খুব কম মানুষই নারীদের শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারে। একজন নারী যে জার্মানির মতো দেশের সরকার প্রধান বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান হতে পারেন অথবা কোনো নারী ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে পারেন এটা প্রাচীন ধ্যান-ধারণার খুব কম মানুষই বিশ্বাস করবেন হয়তো।

Advertisement

তবে আগের এই পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। অনেক দেশেই নারীকে এখন নারী বলে ছোট করা বা ছেলে সন্তানের চেয়ে কম গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টিতে সেকেলে ধারণা বা কল্পনার বাইরেই মনে করা হয়। এখন বিশ্বের বেশিরভাগ ধনী দেশেই বাবা-মায়েরা তাদের ছেলে সন্তানের মতোই মেয়েদেরও একই রকমভাবে গুরুত্ব দিয়ে বড় করছেন। এমনকি তাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রচুর অর্থও ব্যয় করছেন।

শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পুরুষদের তুলনায় এগিয়ে আছেন নারীরা। পাঁচ দশক আগে নিম্নমধ্যবিত্ত আয়ের দেশগুলোতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল মাত্র ৪৯ শতাংশ। সে সময় ছেলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল ৭১ শতাংশ। বর্তমানে বিদ্যালয়গুলোতে ছেলে-মেয়ের উপস্থিতি ৯০ শতাংশ। মাধ্যমিক স্তরেও মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।

এক সময় মেয়ে সন্তানের জন্মে বাবা-মা খুশি হতে পারতেন না। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি বদলেছে। এখন ছেলে সন্তানের তুলনায় অনেক বাবা-মা একটিমেয়ে সন্তানের আশা করেন। চীনের মতো দেশেও এই চিত্র পাল্টেছে। সেখানে লিঙ্গের ভিত্তিতে ভ্রূণ হত্যার প্রচলন অনেক আগে থেকেই আছে।

Advertisement

অপরদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মেয়েদের বাল্যবিয়ের সংখ্যাও আগের চেয়ে অনেক কমেছে। ১৯৯৫ সালের দিকে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ছয়জন মেয়ে ১৮ বছরের আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। এই সংখ্যা এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে।

মেয়েদের সার্বিক উন্নতির বিষয়টি অনেকাংশে সমাজের ওপর নির্ভর করে। নারীরা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেলে তারাও পুরুষের মতোই সমান অবদান রাখতে পারবে এটা ভুলে গেলে চলবে না। যে মেয়েটি মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে সে অল্প বয়সেই বিয়ে করে সংসার জীবনে প্রবেশ করতে চাইবে না বা অল্প বয়সেই মা হয়ে সন্তান পালনের মতো কঠিন দায়িত্ব গ্রহণ করতে চাইবে না। শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। মানুষ নিজের জীবন সম্পর্কে ভাবতে শেখে এবং তার পছন্দের পরিধি বাড়ে। ফলে শিক্ষিত একজন নারী নিজেকে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ রেখে দরিদ্র জীবন-যাপন করতে চাইবেন না। বরং তিনি সাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করবেন। একজন অশিক্ষিত নারীর চেয়ে তিনি দ্বিগুণ উপার্জন করতে সক্ষম।

সাম্প্রতিক সময়ে সারাবিশ্বেই ভয়াবহ সঙ্কট তৈরি করে রেখেছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। এমন পরিস্থিতিতে দরিদ্র দেশগুলোতে করোনার কারণে নারীদের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আগের সময়গুলোতেও একই পরিস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। যে কোনো বিপর্যয়ে নারীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় যখন ইবোলার প্রাদুর্ভাব ঘটে সে সময় প্রচুর মেয়ে শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। অনেক শিক্ষার্থীই আর স্কুলে ফিরে আসেনি। পরবর্তীতে তাদের হয় অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে গেছে অথবা তারা শিশু শ্রমিক হিসেবে উপার্জনে নামতে বাধ্য হয়েছে।

জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ সতর্ক করে বলেছে, করোনা মহামারির কারণেও একই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। তবে এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের সংখ্যা আগের তুলনায় বেশি হবে। কারণ বিশ্বের ২১৮টি দেশ ও অঞ্চলে এই ভাইরাসের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে। আর অল্প কিছু দেশ ছাড়া বাকি সব দেশেই করোনার কারণে ভয়াবহ বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, আগামী দশকে বাল্যবিয়ের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যেতে পারে। প্রায় দেড় কোটি মেয়ে শিশু বাল্যবিয়ের বলি হতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

Advertisement

দরিদ্র দেশগুলো শিক্ষা এবং নারীদের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিলেও বিভিন্ন দাতা সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। দীর্ঘ সময় ধরে নারীদের স্কুলে ধরে রাখতে পারলেই তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা অর্জিত হয়ে যাবে না। বরং তাদের ভ্যাকসিন প্রদান, জন্মনিয়ন্ত্রণ, যে কোনো বিষয়ে তাদের সম্মতির বিষয়গুলো শেখানোর সুযোগও এটি। একই সঙ্গে বাবা-মাকেও সন্তানের বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া যায়।

বয়ঃসন্ধিকাল নারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়ই নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যার সম্মুখীন হয় তারা। মস্তিষ্কের উন্নয়নের ক্ষেত্রেও এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়কে কাজে লাগাতে পারলেই কয়েক লাখ নারী তাদের সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হবেন। কিন্তু যদি এক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তবে তাদের জীবন দরিদ্রের ছকেই আটকে থাকবে এবং তারা নিজেদের আত্মবিশ্বাস নিয়ে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারবেন না। তাই সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত সময়েই নিতে হবে।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

টিটিএন/এমকেএইচ