‘এ টুর্নামেন্ট থেকে আমরা বেশ কিছু প্লেয়ার পেয়েছি, যারা আমাদের পাইপলাইন শক্তিশালী করেছে’- শুক্রবার বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপের ফাইনাল ম্যাচের দুই ইনিংসের বিরতির সময় সংবাদমাধ্যমে সঙ্গে আলাপে এমনটাই বলছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন।
Advertisement
টুর্নামেন্টে কাদের খেলা বেশি ভালো লেগেছে এবং এ থেকে প্রাপ্তি কী?- তা জানাতে গিয়েই এমন মন্তব্য করেন বিসিবি সভাপতি। এসময় বেশ কয়েকটি নাম উল্লেখ করেছেন পাপন, যারা পুরো আসরজুড়েই বাজিমাত করেছেন ব্যাটে কিংবা বলে। তাদের ব্যাপারে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন পাপন, জানিয়েছেন নিজের সন্তুষ্টির কথা।
তেমনি কিছু ক্রিকেটারকে নিয়ে সাজানো এ প্রতিবেদন। যারা এবারের আসরে নতুন করে জানিয়েছেন নিজেদের সামর্থ্য, দিয়েছেন নিজেদের আগমনী বার্তা। তারাই হতে পারেন নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ক্রিকেটের মাঠ কাঁপানো তারকা। টি-টোয়েন্টি কাপের এমন সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের কথাই তুলে ধরা হলো এ প্রতিবেদনেঃ
পারভেজ হোসেন ইমন (ফরচুন বরিশাল)
Advertisement
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের বাঁহাতি ওপেনার পারভেজ হোসেন ইমন। ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে চোট পাওয়ার পরেও খেলেছিলেন ৪৭ রানের ইনিংস। তখন দেখিয়েছিলেন ধৈর্যশীল ব্যাটিংয়ের উদাহরণ। আর এবার বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে দেখালেন নিজের আরেক রুপ।
মিনিস্টার গ্রুপ রাজশাহীর বিপক্ষে ম্যাচে ২২০ রানের বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে মাত্র ৪২ বলে সেঞ্চুরি করেছেন পারভেজ ইমন। যা কি না দেশের ইতিহাসে যেকোনো ফরম্যাটে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড। এছাড়া বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে সেঞ্চুরির রেকর্ডটাও নিজের করে নিয়েছেন পারভেজ ইমন।
টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে ৪২ বলে ৫১ রানের ইনিংস দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। সবমিলিয়ে খেলেছেন ৯টি ম্যাচ, রান করেছেন ২৩৩, স্ট্রাইকরেট ছিল ১৩০+। রাজশাহীর বিপক্ষে খেলা ৪২ বলে ১০০ রানের ইনিংসের জন্য টুর্নামেন্টের বিশেষ পারফরম্যান্সের পুরস্কারও পেয়েছেন এ ১৯ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান।
আনিসুল ইসলাম ইমন (মিনিস্টার গ্রুপ রাজশাহী)
Advertisement
টুর্নামেন্টে মিনিস্টার গ্রুপ রাজশাহীর ডানহাতি ওপেনার আনিসুল ইসলামের নামটি জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেটে পুরোপুরি নতুন। ২০১৮-১৯ মৌসুমের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলার মাধ্যমে প্রথম জাতীয় পর্যায়ে নাম লেখান নারায়ণগঞ্জের ডানহাতি এ ওপেনার। সেবার উত্তরা স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে করেন ৪২৪ রান।
তার দল উত্তরা স্পোর্টিং অবনমিত হয়ে গেলেও আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে নজর কেড়েছিলেন আনিসুল ইমন। ফলে দল পান ২০১৯-২০ মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগেও। স্থগিত হওয়ার আগে খেলা একমাত্র ম্যাচটিতে ওল্ডডিওএইচএসের হয়ে হাঁকিয়েছিলেন ফিফটি। তার মধ্যে সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে প্লেয়ার্স ড্রাফট থেকে দলে নেন রাজশাহীর কোচ সারোয়ার ইমরান।
কোচের আস্থার প্রতিদান অনেকাংশেই দিতে সক্ষম হয়েছেন আনিসুল ইমন। অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর সঙ্গে ইনিংসের সূচনা করেছেন পুরো ৮টি ম্যাচেই। রান করেছেন দলের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৯৯, হাঁকিয়েছেন দুইটি ফিফটি। এছাড়া বল হাতেও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ব্রেকথ্রুসহ নিয়েছেন মোট ৪টি উইকেট।
রাজশাহী ও বরিশালের মধ্যকার ম্যাচটিতে নাজমুল শান্ত ও পারভেজ ইমন সেঞ্চুরিতে অনেকটাই আড়ালে চলে যায় আনিসুল ইমনের ৩৯ বলে ৬৯ রানের ইনিংসটি। আনিসুল ইমনের ৭ চার ও ৩ ছয়ের মারে খেলা ইনিংসটির মাধ্যমেই মূলত বড় সংগ্রহের ভিত পেয়েছিল রাজশাহী।
এছাড়াও গাজী গ্রুপ চট্টগ্রামের বিপক্ষে বল হাতে ২২ রানে ১ উইকেট নেয়ার পর, ব্যাট হাতে খেলেছিলেন ৪৪ বলে ৫৮ রানের দায়িত্বশীল ইনিংস। টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচে বেক্সিমকো ঢাকার বিপক্ষে ২৩ বলে ৩৫ রানের ক্যামিও ইনিংস খেলে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন ইমন। খোদ বিসিবি প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপনও জানতে চেয়েছিলেন আনিসুল ইমনের ব্যাপারে।
শরিফুল ইসলাম (গাজী গ্রুপ চট্টগ্রাম)
বছরের শুরুতে হওয়া যুব বিশ্বকাপে পারভেজ ইমনের সতীর্থ ছিলেন বাঁহাতি পেসার শরিফুল ইসলাম। তবে জাতীয় পর্যায়ে তার খানিক পরিচিতি ছিল আরও আগে থেকেই। ছয় ফুটের বেশি উচ্চতায় ফাস্ট বোলিংয়ের আগ্রাসনটা সহজাত শরিফুলের। যা এবার হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে প্রতিপক্ষ দলগুলো।
টুর্নামেন্টে গাজী গ্রুপ চট্টগ্রামের অপ্রতিরোধ্য যাত্রার অন্যতম কান্ডারি ছিলেন শরিফুল। আরেক বাঁহাতি পেসার মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে মিলে প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইনআপকে বেঁধে রাখার কাজটা সফলতার সঙ্গেই করেছেন তিনি। উচ্চতার কারণে পাওয়া বাড়তি বাউন্স এবং একইসঙ্গে স্লোয়ারের মিশেল শরিফুলের বোলিংকে করে তোলে আনপ্লেয়েবল।
সবমিলিয়ে এবারের বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে ১০ ম্যাচে ৩৮ ওভার বোলিং করেছেন শরিফুল, রান খরচ করেছেন ওভারপ্রতি ৮.০০ করে, তার শিকার আসরের তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৬টি উইকেট। ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো বোলিংয়ে ২৭ রানে ৩ উইকেট নেয়ায় তিনিও পেয়েছেন বিশেষ পারফরম্যান্সের পুরস্কার।
শহিদুল ইসলাম (জেমকন খুলনা)
শুক্রবার বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপের ফাইনালে শিরোপা জয়ের জন্য শেষ ওভারে ১৬ রান প্রয়োজন ছিল গাজী গ্রুপ চট্টগ্রামের। শহিদুল ইসলামের করা সেই ওভারের প্রথম পাঁচ বলে কোনও বাউন্ডারি হাঁকাতে পারেনি চট্টগ্রাম, উল্টো হারায় দুই সেট ব্যাটসম্যান মোসাদ্দেক সৈকত ও সৈকত আলির উইকেট।
শেষ বলে ছক্কা হাঁকান নাহিদুল। কিন্তু এটি শুধুমাত্র পরাজয়ের ব্যবধান কমানো ছাড়া আর কোনও কাজেই আসেনি। দুর্দান্ত শেষ ওভার করে দলকে ৫ রানের জয় এনে দেন বাবার মৃত্যুশোক সামলে খেলতে নামা শহিদুল। শুধু ফাইনাল ম্যাচেই নয়, পুরো টুর্নামেন্টেই ধারাবাহিক বোলিং করেছেন নারায়ণগঞ্জের এ ডানহাতি পেসার।
পুরো খুলনার বোলিং ইনিংসের মাঝপথ ও ডেথ ওভারের ভরসার পাত্র ছিলেন শহিদুল। সবমিলিয়ে ৮ ম্যাচে ৭.৬৩ ইকোনমি রেটে আসরের পঞ্চম সর্বোচ্চ ১৫টি উইকেট শিকার করেছেন তিনি। সবশেষ বিপিএলেও ১৩ ম্যাচে ১৯ উইকেট নিয়ে তিনি ছিলেন পঞ্চম সেরা উইকেটশিকারি।
হাসান মাহমুদ (জেমকন খুলনা)
বল হাতে টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন জেমকন খুলনার অন্যতম ভরসার পাত্র ছিলেন ডানহাতি পেসার হাসান মাহমুদ। টানা ১৩৮-১৪০ কিমি প্রতি ঘণ্টায় বোলিংয়ের সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত স্লোয়ার ও নিখুঁত ইয়র্কারের মিশেলে নিজেকে দারুণ এক প্যাকেজ হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন লক্ষ্মীপুরের এ তরুণ পেসার।
চট্টগ্রামের বিপক্ষে ফাইনালেও নিজের শেষ স্পেলের শেষ বলে ছক্কা হজমের আগে ৩.৫ ওভারে মাত্র ২৪ রান খরচ করেছিলেন তিনি। পুরো আসরে তাকে ৯টি ম্যাচ খেলিয়েছে খুলনা। যেখানে ৩৩ ওভার হাত ঘুরিয়ে ১১ উইকেট শিকার করেছেন তিনি, ওভারপ্রতি খরচা ছিল মাত্র ৭.১৫ রান।
শফিকুল ইসলাম (বেক্সিমকো ঢাকা)
বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপের দলগুলোর সামনে রীতিমতো সারপ্রাইজ হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিলেন বেক্সিমকো ঢাকার ২৩ বছর বয়সী বাঁহাতি পেসার শফিকুল ইসলাম। পুরো আসরজুড়েই নিয়ন্ত্রিত বোলিং করেছেন তিনি। ঢাকাকে প্লে-অফে তোলার পথে তারও ছিল অনেক বড় অবদান।
প্রথম রাউন্ডে গাজী গ্রুপ চট্টগ্রামকে হারানো একমাত্র দল ছিল ঢাকা। সেই ম্যাচে বল হাতে ৪ ওভারে মাত্র ২৫ রান খরচায় ১ উইকেটের পাশাপাশি দুর্দান্ত এক ক্যাচে প্রতিপক্ষের সেরা ব্যাটসম্যান লিটন দাসের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন শফিকুল। যা ঢাকার জয়ের পথ অনেকটাই সুগম করে দিয়েছিল।
টুর্নামেন্টে শফিকুল খেলেছেন ৮টি ম্যাচ, তাকে দিয়ে ৩১ ওভার বোলিং করিয়েছিলেন অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম। ওভারপ্রতি ৭.৭০ রান খরচ করে ১১টি উইকেট শিকার করেছেন তিনি। আসরে ২টি মেইডেন ওভারও করেছেন শফিকুর। মোহাম্মদ নাইম শেখ (বেক্সিমকো ঢাকা)
বেক্সিমকো ঢাকার হয়ে খেলা এ বাঁহাতি ওপেনারের নামটি প্রায় সবারই জানা। তবে গতবছর ভারতের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে ৮১ রানের ইনিংসব্যতীত তেমন আর কিছু করতে পারেননি এ ২১ বছর বয়সী ওপেনার। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে আভাস দিয়েছেন নিজেকে নতুন করে ফিরে পাওয়ার।
ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে এবারের আসরের তৃতীয় সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন নাইম শেখ। সেদিন তিনি খেলেছেন ৮ চার ও ৭ ছয়ের মারে ৬৪ বলে ১০৫ রানের ইনিংস। প্রথম ৫০ করতে ৪৩ বল খেলার পর সেদিন পরের ১৭ বলেই করে ফেলেন আরও ৫০ রান। যা প্রমাণ করেছিল তার আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের সামর্থ্য। আসরে ১০ ম্যাচ খেলে ২৬০ রান করেছেন নাইম।
নাহিদুল ইসলাম (গাজী গ্রুপ চট্টগ্রাম)
ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ কয়েকবছর ধরেই কার্যকরী পারফরমার অফস্পিনিং অলরাউন্ডার নাহিদুল ইসলাম। বিশেষ করে ২০১৭ সালে রংপুর রাইডার্সের হয়ে বিপিএল শিরোপা জেতার পথে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছিলেন খুলনার ২৭ বছর বয়সী এ অলরাউন্ডার। তবে কখনও সে অর্থে পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে পারেননি তিনি।
তবে এবারের বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে নাহিদুলকে দারুণভাবে ব্যবহার করেছেন চট্টগ্রাম অধিনায়ক মোহাম্মদ মিঠুন। প্রায় সব ম্যাচেই একপ্রান্ত থেকে আক্রমনে রেখেছেন নাহিদুলকে এবং পেয়েছেন সফলতা। পুরো আসর জুড়েই কিপটে বোলিং করেছেন নাহিদুল, এনে দিয়েছেন কার্যকরী সব ব্রেকথ্রু।
সবমিলিয়ে এবারের টুর্নামেন্টে ১১ ম্যাচে ৩৬ ওভার হাত ঘুরিয়ে তিনি রান খরচ করেছেন ওভারপ্রতি মাত্র ৬.০৫ রান করে, তার উইকেট শিকার মোট ১০টি। এছাড়া ব্যাট হাতেও পুরো আসর মিলিয়ে ৫ চার ও ৩ ছয়ের মারে ২৪ বলে ৪৫ রান করেছেন নাহিদুল।
এসএএস/এমকেএইচ