শামসুর রাহমান ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের অভ্যুত্থান, স্বাধীনতা, সমসাময়িক বিভিন্ন অনিয়ম, অনাচার বা অপ্রাসঙ্গিকতা ছড়া-কবিতায় তুলে ধরেছেন। কোথাও কোথাও প্রতিবাদও করেছেন। তিনি প্রথম জীবনে সাংবাদিক ছিলেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ আর চেতনায় প্রবাহিত ছিলেন শামসুর রাহমান। কবি শামসুর রাহমানও সে সময়ের পত্রিকার পাতায় কবিতা, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয়, মিছিল, মিটিং, গণআন্দোলন, বক্তৃতা, গণজোয়ারে প্রচণ্ড সরব ছিলেন। তার কবিতা শাসকের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে তিনি মানুষকে উজ্জীবিত করতে কবিতা লিখেছেন। সেসব কবিতা সেসময়ের মানুষকে অধিকার সচেতন ও রাজনীতিমুখী করে তুলেছিল। তিনি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড়’ নামক কবিতা।
Advertisement
বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি শামসুর রাহমান অনেক কবিতা লিখেছেন স্বাধীনতা ও আন্দোলন কেন্দ্রিক। তাঁর ‘নিজ বাসভূমে’, ‘বন্দি শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে নিয়ে অনেক কবিতা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য কবিতার মধ্যে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘গেরিলা’, ‘তুমি বলেছিলে’, ‘এখানে দরোজা ছিল’ প্রভৃতি। ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা কাব্যগ্রন্থের ‘রক্তসেচ’ কবিতায় সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে এভাবে- ‘টিক্কার ইউনিফর্মে শিশুর মগজ/যুবকের পাঁজরের গুঁড়ো।/নিয়াজীর টুপিতে রক্তের প্রস্রবণ/ ফরমান আলীর টাইএর নীচে ঝুলন্ত তরুণী... তুমি কি তাদের কখনো করবে ক্ষমা?’
পাকিস্তান সরকারের আমলে কলকাতার একটি সাহিত্য পত্রিকায় (দেশ) মজলুম আদিব (নির্যাতিত কবি) নামে কবিতা ছাপা হয়। ‘ঈর্ষাতুর নই, তবু আমি/তোমাদের আজ বড় ঈর্ষা করি। তোমরা সুন্দর/জামা পরো, পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ জমাও,/কখনো সেজন্যে নয়। ভালো খাও দাও,/ফুর্তি করো সবান্ধব/সেজন্যেও নয়। বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,/স্বাধীন দেশের কবি, তাদের সৌভাগ্যে/আমি বড়ো ঈর্ষান্বিত আজ।’... অথচ এদেশে আমি আজ দমবদ্ধ/এ বন্দী-শিবিরে/মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ/মনের মতন শব্দ কোনো।/মনের মতন সব কবিতা লেখার/অধিকার ওরা/করেছে হরণ। ...স্বাধীনতা নামক শব্দটি/ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ করে বারবার/তৃপ্তি পেতে চাই। শহরের আনাচে কানাচে/প্রতিটি রাস্তায়/অলিতে-গলিতে,/রঙিন সাইনবোর্ড, প্রত্যেক বাড়িতে/স্বাধীনতা নামক শব্দটি আমি লিখে দিতে চাই/বিশাল অক্ষরে।’ (বন্দী শিবির থেকে, ২১ জুলাই ১৯৭১ তারিখে কবিতাটি ভারতীয় ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ছদ্মনামে)
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ততকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে বিরোধী দলগুলোর সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ নামে উপস্থাপন করেন। এ সময়ে তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হন, তিনি যখন কারাগারে তখন তাকে উদ্দেশ্য করে কবি শামসুর রাহমান লেখেন কবিতা ‘টেলেমেকাস’। অংশবিশেষ এরকম- ‘ইথাকায় রাখলে পা দেখতে পাবে রয়েছি দাঁড়িয়ে/দরজা আগলে, পিতা, অধীর তোমারই প্রতীক্ষায়।/এখনো কি ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মাস্তুল তোমার।/বন্দরে যাবে না দেখা? অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ূধ/আবার অভিজ্ঞ হাতে?/তুলবে না ধনুকে টঙ্কার?’ ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে শামসুর রাহমান তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তানে কর্মরত অবস্থায় পেশাগত অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসংগীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন। যাতে আরও স্বাক্ষর করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, আহমেদ হুমায়ুন, ফজল শাহাবুদ্দীন।
Advertisement
বাংলা ভাষার ওপর বারবার হামলা করেছে বিদেশি শত্রুরা। বাংলা ভাষাকে কেড়ে নিতে চেয়েছে সময়ে সময়ে। পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেন আইয়ুব খান। যার প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালের আগস্টে ৪১ জন কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী বিবৃতি দেন, তাদের একজন ছিলেন শামসুর রাহমান। কবি ক্ষুদ্ধ হয়ে লেখেন- ‘নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।/মমতা নামের প্রতি প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়/ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে/শিউলিশৈশবে ‘পাখী সব করে রব’ ব’লে মদনমোহন/তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি,/অবিচ্ছিন্ন পরস্পর মমতায় লীন,/ঘুরেছি কাননে তাঁ নেচে নেচে, যেখানে কুসুম-কলি সবই/ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সংকেতে। আজন্ম আমার সাথী তুমি,/আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গ’ড়ে পলে পলে,/তাইতো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে/আমারই বন্দরে’। (বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা)
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান। তিনি লেখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের/জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।/বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে/নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো/হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষ্মতায়/বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট/উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।/ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত/মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট/শহরের প্রধান সড়কে/কারখানার চিমনি-চূড়োয়/গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে/উড়ছে, উড়ছে অবিরাম/আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে, চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।/আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা/সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;/আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা’।
চারিদিকে লাশ, রক্ত। তাঁর ‘বারবার ফিরে আসে’ কবিতায় দৃপ্ত উচ্চারণ- ‘বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শাটর্/ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,/ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।/হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে, ঘোরে হাতে হাতে,/মিছিলে পতাকা হয় বারবার রক্তাপ্লুত শার্ট।/বিষম দামাল দিনগুলি ফিরে আসে বারবার,/বারবার কল্লোলিত আমাদের শহর ও গ্রাম।/‘আবারআসবো ফিরে’ ব’লে সজীব কিশোর/শার্টের আস্তিন দ্রুত গোটাতে গোটাতে/শ্লোগানের নিভাঁজ উল্লাসে/বারবার মিশে যায় নতুন মিছিলে, ফেরে না যে আর।/একটি মায়ের চোখ থেকে/করুণ প্লাবন মুছে যেতে না যেতেই/আরেক মায়ের চোখ শ্রাবণের অঝোরে আকাশ হ’য়ে যায়। একটি বধূর/সংসার উজাড়-করা হাহাকার থামতে না থামতেই, হায়,/আরেক বধূর বুক খাঁ-খাঁ গোরস্থান হ’য়ে যায়,/একটি পিতার হাত থেকে কবরের কাঁচা মাটি/ঝ’রে পড়তে না পড়তেই/আরেক পিতার বুক-শূন্য-করা গুলিবিদ্ধ সন্তানের লাশ/নেমে যায় নীরন্ধ্র কবরে।’
বিভীষিকাময় সময়ে লেখা তাঁর একটি কবিতায় যুদ্ধের চিত্র প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। যেমন- ‘কখনো নিঝুম পথে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে কেউ গুলির আঘাতে।/মনে হয়, ওরা গুলিবিদ্ধ করে স্বাধীনতাকেই/ দিন দুপুরেই জীপে একজন তরুণকে কানামাছি করে/নিয়ে যায় ওরা।/মনে হয়, চোখ বাঁধা স্বাধীনতা যাচ্ছে বধ্যভূমিতে।/বেয়নেটবিদ্ধ লাশ বুড়িগঙ্গায় কি শীতলক্ষ্যায় ভাসে,/মনে হয়, স্বাধীনতা লখিন্দর যেন,/বেহুলা বিহীন,/জলেরই ভেলায় ভাসমান,/যখন শহরে ফাটে বোমা, হাতবোমা, অকস্মাৎ/ফাটে ফৌজী ট্রাকের ভেতর,/মনে হয়, স্বাধীনতা গর্জে ওঠে ক্রোধান্বিত দেবতার মতো’।
Advertisement
‘তুমি বলেছিলে’ কবিতায় বর্বর হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে নিঃসঙ্কোচে। নয়াবাজার, ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মসজিদ, মন্দির, মানচিত্র, পুরনো দলিল ইত্যাদি ঘাতকের হাত থেকে রেহাই পায়নি। একে-একে তারা সব ধ্বংস করেছে। ঘাতকদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শহর ছেড়ে পালাচ্ছে সবাই দিগ্বিদিক। বনপোড়া হরিণী যেমন বন থেকে পালায়, তেমনি নবজাতককে বুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত জননী শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। ‘বিষম পুড়ছে চতুর্দিকে ঘর-বাড়ি। পুড়ছে টিয়ের খাঁচা, রবীন্দ্র রচনাবলি, মিষ্টান্ন ভান্ডার,/মানচিত্র, পুরনো দলিল।/মৌচাকে আগুন দিলে যেমন সশব্দে/সাধের আশ্রয় ত্যাগী হয়/মৌমাছির ঝাঁক,/তেমনি সবাই/পালাচ্ছে শহর ছেড়ে দিগ্বিদিক। ...দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার,/আমাদের চৌদিকে আগুন,/গুলির ইস্পাতী শিলাবৃষ্টি অবিরাম।/তুমি বলেছিলে/আমাকে বাঁচাও।/অসহায় আমি তাও বলতে পারিনি।’ (তুমি বলেছিলে)
‘উদ্ধার’ ও ‘কাক’ কবিতাদ্বয় শামসুর রাহমানকে উদ্ধার করেছে আটকেপড়া বৃত্তাবদ্ধ জীবন থেকে। বিধৃত হয়েছে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের বাস্তব সমাজ আলেখ্য। মাঠে কোনো গরু নেই, রাখাল ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। শূন্য মাঠ, নির্বাক বৃক্ষ, নগ্ন রৌদ্র, স্পন্দমান কাক–এগুলো হাহাকার ও শূন্যতার প্রতীক। ‘গ্রাম্য পথে পদচিহ্ন নেই। গোঠে গরু/নেই কোনো, রাখাল উধাও, রুক্ষ্ম সরু/আল খাঁ খাঁ, পথ পার্শ্বে বৃক্ষেরা নির্বাক/নগ্ন রৌদ্র চতুর্দিকে, স্পন্দমান কাক, শুধু কাক।’ (কাক)।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে তিনি খুনিদের উদ্দেশ্য করে ‘অভিশাপ দিচ্ছি’ কবিতায় লেখেন- ‘আমাকে করেছে বাধ্য যারা/আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত/সিঁড়ি ভেঙ্গে যেতে আসতে/নদীতে আর বনবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে/অভিশাপ দিচ্ছি আজ সেইখানে দজ্জালদের।’
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শামসুর রাহমান সপরিবারে তাদের পৈতৃক বাড়ি নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে চলে যান। এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বেদনামথিত হয়ে লেখেন ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’সহ বেশকিছু কবিতা। তাঁর ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি অমর হয়ে আছে। ‘স্বাধীনতা তুমি/শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা/স্বাধীনতা তুমি/পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।/স্বাধীনতা তুমি/ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।/...স্বাধীনতা তুমি/অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।/স্বাধীনতা তুমি/বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার।’ (স্বাধীনতা তুমি)
কবির এমন উচ্চারণ আমাদের আজও প্রভাবিত করে। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকা। তাঁর কবিতায় খুঁজে পাই একাত্তরের বিষাদময় চিত্র।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
এসইউ/জেআইএম