মতামত

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ও আজকের বাংলাদেশ

‘আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে অভিশাপ দিচ্ছি, মগজের কোষে কোষে যারা পুঁতেছিল আমাদেরই আপনজনের লাশ, আমি তো তাদের জন্য সহজ মৃত্যু করি না কামনা।’ কবি শামসুর রাহমানের অমিয়বাণী সত্য করে শহীদ বুদ্ধিজীবীরা বারবার ফিরে ফিরে আসেন বাঙালির মানসপটে। বাঙালির হৃদয়ে প্রতিভাত হয় শ্রদ্ধা ও শোকের আবহ আর সঞ্চারিত হয় শক্তির।

Advertisement

আমেরিকান তাত্ত্বিক শিক্ষাবিদ অ্যাডওয়ার্ড ডব্লিউ সাইদ বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবী ছাড়া যেমন বড় ধরনের কোনো বিপ্লব সংঘটিত হয়নি, তেমনি তাদের ছাড়া কোনো বিপ্লববিরোধী আন্দোলনও সংঘটিত হয়নি।’ এই সূর্যসন্তানরাই জাতির যেকোনো বিপর্যয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে জাতিকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। পাকিস্তানি শাসক ও শোষকচক্রের অন্যায় অত্যাচার ও শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তারা ছিলেন দিকনির্দেশক এবং সোচ্চারকণ্ঠ। ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হামিদুর রহমান আরবি হরফে বাংলা ও উর্দু লেখার সুপারিশ করলে সেটার তীব্র প্রতিবাদ জানান বুদ্ধিজীবীরা। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের সংহতি বৃদ্ধির অজুহাতে রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করা হলে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তৎক্ষণাৎ এই ভাষা সংস্কারের কঠোর প্রতিবাদ জানান।

রবীন্দ্রনাথ ও তার সাহিত্যের ওপর আসে সাম্প্রদায়িক আঘাত; তাকে চিহ্নিত করা হয় হিন্দু কবি রূপে। এই ‘হিন্দুয়ানি’র অভিযোগ তুলে নজরুলের কবিতা থেকেও ‘হিন্দুয়ানি’ শব্দ বাদ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই ফলশ্রুতিতে বাঙালির মনে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হতে থাকে এবং এই অবিচারের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করে। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সনজিদা খাতুন ও ওয়াহিদুন হকের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘ছায়ানট’। বুদ্ধিজীবীমহলের এমন সাহসী প্রতিবাদ জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিকাশে সাহায্য করেছিল তুমুলভাবে। তাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলেই জনগণ ধীরে ধীরে নিজেদের দাবি ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে যা পরবর্তীতে তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। এ কারণে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। যুদ্ধের শুরু থেকেই মেধাবী ধীমান ব্যক্তিবর্গের প্রতি পাকবাহিনীর ছিল সীমাহীন ক্ষোভ।

স্বাধীনতার পর বঙ্গভবন থেকে প্রাপ্ত রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল যে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন ‘ছাত্র সংঘ’ আলবদর বাহিনী গঠন করে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করে এবং ১৬ ডিসেম্বর আশরাফুজ্জামান খানের নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে তার একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করা হয়, ওই ডায়েরিতে যেসব বুদ্ধিজীবীর নাম ও ঠিকানা পাওয়া যায় তাদের সবাইকে ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত আসামিদ্বয় চৌধুরী মাইনুদ্দীন লন্ডনে ও আশরাফুজ্জামান নিউইয়র্ক প্রবাসী। এছাড়াও একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পেছনে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনসহ পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। ইতিহাসের অধ্যাপক ড. মোহর আলী ৮ জুলাই ‘লন্ডন টাইমস’ পত্রিকায় ‘পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের জীবনের নিরাপত্তা নেই’ এই সংবাদের প্রতিবাদ জানান। এছাড়াও মার্কিন সেনাবাহিনীর সামরিক গোয়েন্দা হেইট এবং সিআইএ এজেন্ট ডুসপিক দুজনই রাও ফরমান আলীর সাথে মিলে প্রায় তিন হাজার বুদ্ধিজীবীর একটা তালিকা তৈরি করেন। এ ঘটনাই প্রমাণ করে যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ।

Advertisement

হিটলারের নাৎসি বাহিনীও পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রকৃতিগত দিক থেকে বিশ্বের ভয়াবহ গণহত্যাগুলোর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে নিজ দেশের সেরা সন্তানদের ছিন্নভিন্ন দেহগুলো দেখে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা ছিল খুব কঠিন। ব্রিটিশ সাংবাদিক নিকোলাস টোমালিন বাঙালিদের বধ্যভূমি পরিদর্শন করে শিরোনাম করেছিলেন, ‘বাংলার বুদ্ধিজীবীরা এক খাদে মরে পড়ে আছেন।’ ভয়াবহতা দেখে অপর বিদেশি সাংবাদিক বলেছিলেন, ‘It’s not only utterly shocking but we are ashamed that we belong to human race which is capable of doing this’. একটি জাতিকে নির্বীজ করে দেবার প্রথম উপায় বুদ্ধিজীবী শূন্য করে দেয়া। এই শ্রেষ্ঠসন্তানরা ছিলেন দেশ ও জাতির সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের প্রতীক। যেমন আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে যে ধরনের কড়া সমালোচনা করেন রবার্ট ফিস্ক কিংবা পাকিস্তানের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক ইস্যুতে সর্বদা সরব আইনজীবী আসমা জাহাঙ্গীর অথবা সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে ভারত সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন অরুন্ধতি রায়।

স্বাধীনতাপূর্ব বুদ্ধিজীবীরা দীপালোকের ন্যায় যে ভূমিকা পালন করেছেন তার ধারাবাহিকতার চরম অভাব পরিলক্ষিত হয় এই সময়ে। শ্রীযুক্ত ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাক-পরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তেমনই আইয়ুবের শাসনামলেই শওকত ওসমান ‘ক্রীতদাসের হাসি’র মতো উপন্যাসে তাকে স্বৈরাচারী বলেছেন। আনোয়ার পাশা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর রাইফেলের মুখে ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ বইটি লিখে তাদের মুখোশ উন্মোচন করেন। জহির রায়হান সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে ‘জীবন থেকে নেয়া’র মতো কালজয়ী সিনেমা বানিয়ে তাদের শোষণ-বঞ্চনার কাহিনী তুলে ধরেছেন। মুনীর চৌধুরী জেলখানায় বন্দী থাকা অবস্থায় ‘কবর’ নাটক লিখে মঞ্চস্থ করে পাকদুশাসনের গালে চপেটাঘাত করেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রাজাকার ও পাকিস্তানিদের হাতে প্রাণ উৎসর্গ করতে হয়। দুঃখজনকভাবে ৭৫’পরবর্তী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সত্য বলার সৎ সাহসের প্রচণ্ড অভাব দেখা যায়। স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করা হলো, বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার চক্রান্ত করা হলো, যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বুকে ধারণ করে ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রাণ উৎসর্গ করলো তা নিষিদ্ধ করা হলো! কিন্তু এ প্রজন্মের বুদ্ধিজীবীরা ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাইতো নবগঠিত দেশকে মেধাশূন্য করার মাধ্যমে যে পরিকল্পনা তারা নিয়েছিল তা অনেকাংশে সফল হয়েছিল।বিশ্বাসঘাতক নরাধমের অনেকেই পঁচাত্তরপরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজে পুনর্বাসিত হয়েছে; কেউবা মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন মাত্রই এই ব্যর্থ সুবিধাবাদীরা সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের নিমিত্তে আপন গুহা হতে কিলবিল করে বের হয়ে এসেছে। সকল পেশার এসব ধান্দাবাজ জাতির পিতার আদর্শ ধারণ তো করেই না বরং তার নাম ও ছবি ব্যাবহার করে হীনস্বার্থ হাসিলের চেষ্টায় ব্যস্ত আছে।

বিজয় অর্জনের পর ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ‘বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি’ গঠন করেন। এই কমিটির প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। তদন্ত কমিটির প্রধান প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান বলেছিলেন, ‘এরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীদের বাছাই করে আঘাত হেনেছে।’

১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর 'দৈনিক আজাদ'-এর শিরোনাম ছিল, ‘আর একটা সপ্তাহ গেলেই ওরা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সবাইকেই মেরে ফেলত আলবদর বাহিনীর মাস্টারপ্ল্যান’। ১৪ ডিসেম্বর তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রায় ২০০ জনের মতো বুদ্ধিজীবী লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবীদের তাদের বাসা হতে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সব শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিচয় দূরের কথা, তাদের প্রকৃত সংখ্যাই অদ্যাবধি নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট এক হাজার ৭০ জন। বাংলাপিডিয়া হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য ২ জন।

Advertisement

আশার বাণী স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বর্তমান সরকার এক হাজার ২২২ জনের তালিকা ইতোমধ্যে প্রকাশিত করে। বাংলা একাডেমির এবং বাংলাপিডিয়ার সংজ্ঞা এই দুটোর সমন্বয় করে আগামী বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মধ্যে তালিকা সংযুক্ত করে চূড়ান্ত করা হবে। জহির রায়হানকে বিএনপি-জামায়াত সরকার কোনো তালিকায় রাখেনি। কারণ তিনি ১৬ ডিসেম্বরের পর শহীদ হয়েছেন। তাই ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ৩১ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন 'মিরপুর মুক্ত দিবস’ অন্তর্ভুক্ত করে তালিকা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার শেষ হয়েছে, বাংলাদেশ আজ কলঙ্কমুক্ত হলেও এখনো দায়মুক্ত নয়। সেই সব মেধাবী মানুষ বেঁচে থাকলে আজ হয়তো বাংলাদেশকে আমরা একটি উচ্চতর জায়গায় দেখতে পেতাম। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হয়তো এখন বাংলাদেশের নামও উচ্চারিত হতো। তাদের অস্তিত্ব অনুভাব করবে জাতি বারবার, তাদের নাম প্রতিধ্বনিত হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর, তাদের উপস্থিতি থাকবে কাল থেকে কালান্তর। যেমনটি মুনীর চৌধুরী ‘কবর’ নাটকে প্রতিজ্ঞা করে গেছেন, ‘বৃষ্টিতে ভেঁজা নরম ঘাসের উপর দিয়ে আমি আরও হাঁটব। ঠাণ্ডা রূপোর মতো পানি চিড়ে হাত পা ছুঁড়ে সাঁতার কাটব। আমি বার বার আসব।...’

লেখক: ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। রাজনীতি বিশ্লেষক।

এইচআর/বিএ/জেআইএম