সম্প্রতি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র নগরে মশক নিধনে চলমান নানা কর্মসূচির কথা গণমাধ্যমে জানিয়েছেন। তারা দাবি করেছেন, আগের বছরের তুলনায় এবার যথাযথভাবে মশক নিধন কার্যক্রম চলছে। এতে মশার উপদ্রব কমেছে ঢাকা শহরে।
Advertisement
তবে ভিন্ন কথা বলছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নাগরিকরা। তাদের অভিযোগ, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার নগরে মশার উপদ্রব বেশি। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে কিউলেক্স মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ তারা। ঘরে-বাইরে, বাসা কিংবা অফিস সব জায়গায় মশা। কিন্তু মশক নিধন কর্মীদের মাঠে তেমন দেখা যায় না। এর মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে এডিশ মশার উপদ্রবও বাড়ছে।
একই কথা বলেছেন কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বছর ডেঙ্গু যখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল, সে সময় মশক নিধন কার্যক্রম ব্যাপকভাবে পরিচালিত হয়েছিল। এখন তা ঝিমিয়ে পড়েছে। ফলে রাজধানীতে কিউলেক্স মশা বাড়ছে। নতুন করে দুর্যোগ এড়াতে হলে মশক নিধন কার্যক্রমে ঢিলেমি করা যাবে না। এ ছাড়া মশক নিধন কার্যক্রমের পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।’
সিটি করপোরেশনে মশা মারার ওষুধ ছিটানোর জনবল কম
Advertisement
ডিএনসিসি
ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, ডিএনসিসি এলাকার আয়তন ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ৫৪টি সাধারণ ওয়ার্ড। প্রতিটি ওয়ার্ডে গড়ে ১২ জন কর্মী সকাল-বিকেল দুই শিফটে মশা মারার ওষুধ ছিটান। কিন্তু ওয়ার্ডের আয়তন অনুযায়ী লোকবল অনেক কম। এতে আজ এক গলিতে মশার ওষুধ ছিটানো হলে ফের এ গলিতে আসতে গড়ে এক সপ্তাহ লাগে। এমন পরিস্থিতিতে মশক কর্মীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। মশাও সহনীয় পর্যায়ে আনা যায় না। এছাড়া কিছু মশক কর্মীর মাঝে কাজ ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। ফলে মেয়র যেভাবে মশক নিধন করতে চান, তা যথাযথভাবে হয় না।
মহাখালীর ওয়ারলেস এলাকার বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে নগরের প্রতিটি বাড়ি বা ফ্ল্যাট থেকে কর নেয় ডিএনসিসি। কিন্তু নাগরিকরা তার সুফল বা সেবা পায় না। দিন-রাত বাসায় কয়েল জ্বালিয়ে অথবা মশারি টানিয়ে রাখতে হয়। বনানীতে নিজ অফিসে গিয়েও শান্তি নেই। মশার উপদ্রবে ঠিকমতো কাজকর্মও করা যায় না।’
সবশেষ গত নভেম্বরের মাঝামাঝি মিরপুরের পীরেরবাগে মশার ওষুধ (ফগিং) ছিটাতে দেখেছেন মুদি দোকানি নিজাম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘মাসে এক-দুবার মশার ওষুধ ছিটাতে দেখি। কিন্তু মশা মরে না। দোকানে কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হয়। অথচ এই শুষ্ক মৌসুমে কয়েল জ্বালিয়ে রাখলে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থাকে।’
Advertisement
লোকবল কম থাকায় মশক কর্মীদের হিমশিম খেতে হয়
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নগরবাসীকে ডেঙ্গু ও মশাবাহিত অন্যান্য রোগ থেকে সুরক্ষা দিতে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা এবং বাসা-বাড়িতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়েছে ডিএনসিসি। এর মধ্যে মহাখালী ও আশপাশ এলাকার ৪২টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এছাড়া ১ হাজার ১৮৫টি বাড়ি ও স্থাপনায় এডিস মশার প্রজনন উপযোগী পরিবেশ পাওয়া যায়। কিন্তু মশা মারার ওষুধ ছিটানোর মতো সেই পরিমাণ জনবল সিটি করপোরেশনে নেই।
গত ২ ডিসেম্বর ফেসবুক লাইভে নগরের বিভিন্ন সমস্যা এবং সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। এ সময় মশা নিধনে এক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গত বছর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই মশার প্রাদুর্ভাবে ডেঙ্গু জ্বর ছড়িয়ে পড়ে। চলতি বছর মশার লার্ভা ধ্বংসে চিরুনি অভিযান চালিয়েছি। মশা নিধনে ফোর্থ জেনারেশন ওষুধের ব্যবহার, লার্ভিসাইড, এডাল্টিসাইড ব্যবহার করছি। এতে এবার ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ততটা ছড়াতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, ‘মশা নিধনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা। মশার ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিও মনিটরিং করছি। এ কার্যক্রমে নগরবাসীকে সম্পৃক্ত হতে হবে।’
সকাল-বিকেল মশা মারার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে বলে দাবি কাউন্সিলরদের
ডিএসসিসি
ডিএসসিসির আয়তন ১০৯ দশমিক ২৫১ বর্গকিলোমিটার। সাধারণ ওয়ার্ড ৭৫টি। কিন্তু এসব ওয়ার্ডের আয়তন অনুযায়ী জনবল, মশার ওষুধ, ফগার মেশিন সংকট রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সংস্থাটির কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দাবি, তাদের তেমন কিছুর সংকট নেই। মশার উপদ্রবও অনেকটা কম। এর মধ্যে গত ২৮ অক্টোবর থেকে বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। অভিযানের অংশ হিসেবে প্রতিদিন পাঁচটি করে ওয়ার্ডে জরিপ করা হচ্ছে। জরিপকারী কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
ধোলাইরপাড়ের বাসিন্দা আবু তালেব বলেন, গত সপ্তাহে কিউলেক্স মশার কামড়ে তার মেয়ের গোদ রোগ হয়েছে। এটা খুবই ভয়ংকর। তিনি তার সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, যেসব এলাকায় কিউলেক্স মশা তুলনামূলক বেশি, সেই ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এডিসের লার্ভা ধ্বংসে বাসা-বাড়িতে চলে অভিযান
৪১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সারোয়ার হাসান আলো জাগো নিউজকে বলেন, তার ওয়ার্ডে সকাল-বিকেল মশা মারার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। মশার উপদ্রব নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ নেই।
গত ২ ডিসেম্বর সিরডাপ মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি বলেন, ‘আমরা যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম অত্যন্ত বেগবান করেছি। সারা বছরই মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চলমান। ফলে এ বছর ডেঙ্গুর কারণে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি।’
এমএমএ/এমএসএইচ/জেআইএম