বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যসহ দেশের সব ভাস্কর্য ভাঙা ও বঙ্গবন্ধুর অবমাননার জন্য দায়ী এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
Advertisement
ভাস্কর্য, ম্যুরাল, মনুমেন্ট ও স্ট্যাচুর বিষয়ে সচেতন করতে এবং জনমনের বিভ্রান্তি দূর করতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ও বায়তুল মোকারম মসজিদের পেশ ইমামকে (খতিব) তাদের বক্তব্য সব গণমাধ্যমে জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এ আদেশের পাশাপাশি জাতির পিতার ভাস্কর্য সুরক্ষা, ভাঙচুরের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে সংবিধানের ৭(ক) অনুচ্ছেদ ও দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা এবং প্রচলিত আইন অনুযায়ী কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। অপর রুলে, ভাঙচুরকারী ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে বিবাদীদের নিস্ক্রিয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র সচিব, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশ প্রধান, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
Advertisement
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যসহ দেশের সব ভাস্কর্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে করা রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে মঙ্গলবার (৮ ডিসেম্বর) দুপুরে হাইকোর্টের বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে আজ রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী নাহিদ সুলতানা যুথী। সঙ্গে ছিলেন, শাহ মনজুরুল হক। অন্যদিকে ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তার সঙ্গে ছিলেন- ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এ বি এম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।
আইনজীবী শাহ মনজুরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংবিধানের ৭(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভাঙচুরকারী ও উসকানিদাতাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না এবং বিবাদীদের নিস্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, মর্মে রুল জারি করেছেন আদালত।’
তিনি বলেন, ‘এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ যেসব বিবাদী রয়েছে তাদের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহসহ প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’
Advertisement
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর ও অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। জারি করা রুলে ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়েছেন আদালত এবং একই সঙ্গে ভাস্কর্য, ম্যুরাল, স্ট্যাচু ও প্রতিকৃতি নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি এবং সচেতনা গড়ে তুলতে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারণা চালাতে ইসলামী ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক এবং বায়তুল মোকাররমের খতিবকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যসহ দেশের সব ভাস্কর্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশনা চেয়ে করা রিটটি শুনানির জন্যে (কজলিস্ট) কার্যতালিকায় ছিল আজ।
জনস্বার্থে গত রোববার (৬ ডিসেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট উত্তম লাহিড়ী এ রিট করেন। দেশের সব জায়গায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদন করা হয়। সব ভাস্কর্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য করা রিট আবেদনের ওপর শুনানির জন্য আজকের দিন ঠিক করেন সংশ্লিষ্ট আদালত। সে অনুযায়ী রিটটি শুনানি হয়।
রিটে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনে নৈরাজ্য/বিশৃঙ্খলা/অনাচার প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম/পদক্ষেপ নিতে বিবাদীদের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না- এ মর্মে রুল জারির আর্জি জানানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক (ডিজি) ও বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পেশ ইমামকে (খতিব) রিটে বিবাদী করা হয়েছে।
রিটে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনকে কেন্দ্র করে যেকোনো ধরনের নৈরাজ্য ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ভাস্কর্য নিয়ে জনমনে সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূর করতে জনসচেতনতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
গত ৪ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে কুষ্টিয়া শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় স্থানীয় মাদরাসার দুই ছাত্র ও দুই শিক্ষককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা হলেন- শহরের জুগিয়া পশ্চিমপাড়া ইবনে মাস্উদ (রা.) মাদরাসার হেফজ বিভাগের ছাত্র আবু বক্কর ওরফে মিঠুন (১৯) ও সবুজ ইসলাম ওরফে নাহিদ (২০) এবং শিক্ষক আল-আমিন (২৭) ও ইউসুফ আলী (২৬)। গ্রেফতার দুই মাদরাসাছাত্র পুলিশকে জানিয়েছেন, ইসলামি বক্তা মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক ও ফয়জুল করিমের বয়ান শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর করেন।
তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, রাত গভীর রাতে যখন মাদরাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েন, তখন তারা দুজনে গোপনে মাদরাসা থেকে বের হয়ে হেঁটে শাহীন কাউন্সিলরের বাসার সামনে দিয়ে কানাবিল মোড় পার হন। এরপর কমলাপুর হয়ে মজমপুর রেললাইন ধরে ফজলুল উলুম মাদরাসার পাশ দিয়ে পাঁচ রাস্তার মোড়ে ভাস্কর্যের কাছে আসেন। তারপর ভাস্কর্য নির্মাণকাজে ব্যবহৃত বাঁশের মই দিয়ে উপরে উঠে নাহিদুল ইসলামের ব্যাগ থেকে হাতুড়ি বের করে আবু বকর মিঠুন ও সবুজ ইসলাম দুজন মিলে রাত ২টা ৫ মিনিট থেকে রাত ২টা ১৩ মিনিট পর্যন্তু নির্মাণাধীন ভাস্কর্যটির বিভিন্ন জায়গায় হাতুড়ি দিয়ে জোরে আঘাত করেন। ভাস্কর্যটির ক্ষতিসাধন করে পুনরায় হেঁটে মাদরাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে মাদরাসার শিক্ষক আল-আমিন ও ইউসুফ আলীকে তারা ভাস্কর্য ভাঙচুরের বিষয়টি জানালে দুজনই তাদের মাদরাসা থেকে দ্রুত পালিয়ে যেতে বলেন। পরে আসামিদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে ওই দুই শিক্ষককে মাদরাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
এদিকে ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নেতা মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও চরমোনাই পীর সৈয়দ ফয়জুল করীমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। সোমবার (৭ ডিসেম্বর) ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম সত্যব্রত শিকদারের আদালতে এ মামলাটি করেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কেন্দ্রীয় সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল।
এফএইচ/এমআরআর/এমএস