সাহিত্য

শূন্যতা

‘ডক্টর, প্লিজ আমার কথাটা একটু শুনুন। আমি আর পারছি না। আপনারা পেয়েছেনটা কী? আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে, বাবার লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলবো। এভাবে আর কতোদিন? আপনি কী বলেন, ডক্টর? যে জিনিসের কোনো ফেইট বা আউটকাম নেই, তার পেছনে ছোটাছুটি করাটা কি বোকামি না?’ এক নিশ্বাসে বললেন কল্লোল সাহেব।

Advertisement

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।

খলিল সাহেবের ছেলে তার বাবার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে নির্বিকারভাবে কথাগুলো আমাকে বলছিলেন। আমি খলিল সাহেবের বেড মনিটরের দিকে তাকালাম। পালস ছিল মিনিটে ৯১। হঠাৎ করেই সেটা বেড়ে মিনিটে ১৬০ এ গিয়ে ঠেকলো। খলিল সাহেবের নিশ্বাসের গতিও হঠাৎ বেড়ে গিয়েছে।

মানে তার ব্রেন নিজ সন্তানের কথাগুলো ট্রেস করতে পারছে। কী বলছে তার সন্তান? এ অনুভূতির কথা কি চিকিৎসাবিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পারবে? হ্যাঁ! খলিল সাহেব কোমায় আছেন ঠিকই কিন্তু তার ব্রেন তো ঠিকই সব কথা ধরতে পারছে। নিজ সন্তান তাকে আজ অথর্ব মনে করছে। তার পেছনে অর্থ খরচ করাকে অপচয় মনে করছে। যদিও তার সন্তানের চিকিৎসার ব্যয় বহন করার সামর্থ আছে।

Advertisement

‘ডক্টর, আপনি নিশ্চয়তা দিন যে, বাবা সুস্থ হবে! তাহলেই আমি ট্রিটমেন্ট কন্টিনিউ করাবো। তা ছাড়া আর একমুহূর্তও না। এভাবে টাকা জলে ফেলার কোনো মানেই খুঁজে পাচ্ছি না। আজ চারদিন হলো বাবা আইসিইউতে। কোনো ইমপ্রুভমেন্টই তো নাই।’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম একটা।

‘দেখুন, কল্লোল সাহেব! আপনার বাবার ব্রেন-স্টেম ইনফার্কশান হয়েছে। ওনার হার্ট সচল, উনি লাইফ সাপোর্টে আছেন। কোমায় আছেন ঠিকই। তবে ওনার এখনো ব্রেন ডেথ হয়নি। অর্থাৎ আপনার বাবার ব্রেন এখনো অনুভূতি গ্রহণ করতে পারছে। আপনার-আমার কথোপকথনও বুঝতে পারছেন। আমি কেন, পৃথিবীর কোনো চিকিৎসকই নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না, আপনার বাবা আর কতোদিন বাঁচবেন। তবে আমি আপনাকে এতটুকু বলতে পারি যে, যদি এখন লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলতে বলেন, তাহলে উনি কষ্ট পেয়ে মারা যাবেন। উনি ভেন্টিলেটর মেশিন দিয়ে শ্বাস নিচ্ছেন। ভেন্টিলেটর খুলে ফেললে উনি শ্বাস নিতে পারবেন না। শ্বাসকষ্টে মারা যাবেন আপনার বাবা! আপনার সামর্থ থাকলে আপনি আরও কয়েকটা দিন অন্তত চিকিৎসা চালিয়ে যান, প্লিজ!’‘ও! আচ্ছা! তার মানে আপনি বা আপনার প্রফেসররা কেউই নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না!’‘জ্বী না।’‘তাহলে খুলে ফেলুন লাইফ সাপোর্ট মেশিন। কোথায় সাইন করতে হবে বলে দেন। সাইন করে দিচ্ছি। এভাবে আর টাকার শ্রাদ্ধ করতে পারবো না।’ থমথমে ভঙ্গিতে এক নাগাড়ে বলে গেলেন কল্লোল সাহেব।

আমি আর কথা বাড়ালাম না।

Advertisement

মনিটরে তাকিয়ে দেখলাম খলিল সাহেবের হার্ট রেট বাড়ছেই, বাড়ছেই। ভেন্টিলেটরে অ্যালার্মও বাজছে। মানে খলিল সাহেব ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছেন। হয়তো বুঝতে পারছেন, তার আদরের সন্তান নিজ হাতে কিছুক্ষণ পরেই তার নিশ্বাস নেওয়ার যন্ত্রটি খুলে ফেলতে সম্মতি দিয়ে দেবেন।

যা ভেবেছিলাম, ঠিক তা-ই হলো। কিন্তু মন-প্রাণ দিয়ে চাচ্ছিলাম যেন এটা না ঘটে। এতো বোঝানোর পরও লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়ার সম্মতিপত্রে সাইন করলেন কল্লোল সাহেব।‘ডক্টর! মৃত ঘোষণা করতে আর কতক্ষণ সময় লাগবে?’আমি বোবার মতো চুপ করে রইলাম। কী-ই বা আর বলবো? তবু বিড়বিড়িয়ে অজান্তেই বলে ফেললাম-‘আমাকে অন্তত ঘণ্টা দুয়েক সময় দিন প্লিজ। লাইফ সাপোর্ট হঠাৎই একবারে খুলে ফেলতে চাচ্ছি না। আস্তে আস্তে উইথড্র করি। এতে আপনার বাবার কষ্ট কম হবে।’‘ডক্টর, শুনুন। বাবার ডেথ সার্টিফিকেটটা কিন্তু আমার হাতে দেবেন। বাবার ইনস্যুরেন্স আছে তো!’

আমি কিছু বললাম না কল্লোল সাহেবকে। চুপ করে রইলাম। আমার একটা তীব্র কষ্টের অনুভূতি হচ্ছে বহুদিন পর। আইসিইউ থেকে রোগীর সব দর্শনপ্রার্থীদের চলে যেতে অনুরোধ করলাম। চুপ করে খলিল সাহেবের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। শতভাগ অক্সিজেন থেকে কমিয়ে কমিয়ে ৯০-৮০-৭০-৬০ ভাগ করছি। খলিল সাহেবের চোখে পানি। মানুষটা কোমায় আছে ঠিকই কিন্তু অনুভূতি? অনুভূতি তো মরেনি, অশ্রুগ্রন্থিও সচল।

হয়তো উনি ফিরে গেছেন আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের কোনো স্মৃতিতে। তার একমাত্র ছেলে কল্লোলের বয়স হয়তো তখন মাত্র দুই বছর। বাবা! বাবা! বলে ডাকতে শিখেছে ছেলেটা। খলিল সাহেব দিন-রাত পরিশ্রম করছেন। তার একটাই স্বপ্ন- কল্লোলের যাতে কখনো কোনো কষ্ট না হয়। যতো কষ্ট সব খলিল সাহেবই করবেন। অফিস থেকে ফিরে হয়তো চিৎকার করে ডাকতেন-‘বাবা! কল্লোল! কোথায় আমার লক্ষ্মীসোনা? আসো বাবা! বাবার বুকে আসো!’ছোট্ট কল্লোলও হয়তো একলাফে বাবার বুকে উঠে চুপ করে বসে থাকতো। হয়তো তখন বিড়বিড় করে খলিল সাহেব বলতেন- ‘কল্লোল! বাবা আমার! তোকে অনেক বড় হতে হবে যে! মানুষের মতো মানুষ হতে হবে! বাবার অনেক কষ্ট হয় রে চাকরি করতে! সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি যে বাবার। তারপরও যখন তোকে বুকে নেই, মনে হয় তুই একদিকে আর বাকি দুনিয়া অন্যদিকে!’

আমি পেছনে সরে চলে এলাম। স্ক্রিন দিয়ে ঢেকে দিলাম খলিল সাহেবের বিছানা। আমি দূরে চুপচাপ বসে আছি। চিকিৎসকরা আসলেই বড্ড অসহায়! দূর থেকে মনিটরটা দেখা যাচ্ছে। খলিল সাহেবের হার্ট রেট কমে আসছে। ৬০-৫৫-৪০-৩৫-২০-১৫...

পৃথিবীর চাওয়া-পাওয়ার জটিল সমীকরণের কাছে, অর্থের কাছে, হার মেনে যাচ্ছে পিতা-পুত্রের রক্তের টান, ছেলেবেলার ঘুমপাড়ানির গান, বাবার কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমানোর সেই অপূর্ব মুহূর্ত।

একসময় থেমে গেলো বেড মনিটরের সব শব্দ। হার্ট রেট, শ্বাস-প্রশ্বাস কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না মনিটরে- সবই ফ্ল্যাট লাইন। এ নিষ্ঠুর জগতের সাথে সব দেনা-পাওনা মিটিয়ে এক পিতা চলে গেলেন অসীম শূন্যতার প্রান্তরে। কখনোই খলিল সাহেব আদর করে তার ছেলেকে আর কাছে টেনে নেবেন না। কখনোই আইসক্রিম-চকলেট দিয়ে তার ছেলের অভিমান ভাঙাবেন না। ছেলেকে হাত ধরে পরম নির্ভরতায় আর স্কুলে নিয়ে যাবেন না।

থেকে যাবে শুধু তার ছবি আর ইনস্যুরেন্স পেপার...

এসইউ/এমএস