দেশজুড়ে

ফেনীতে এই দিনে প্রথম ওড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা

আজ ৬ ডিসেম্বর। ফেনী পাক হানাদার মুক্ত দিবস। এদিন বাংলার বীর সেনাদের দীপ্ত পদভারে প্রকম্পিত হয়েছিল ফেনীর আকাশ-বাতাস। ১৯৭১-এর এই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা সম্মুখ সমরে পাক বাহিনীদের পরাজিত করে ফেনীর পূর্বাঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিল।

Advertisement

নভেম্বরের শেষ দিকে ফেনী জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর প্রবল আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাক বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনীসহ মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যরা। ফেনী জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পালিয়ে ফেনী শহরে একত্রিত হয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের নৃশংস বর্বরতায় ক্ষত-বিক্ষত ফেনী শহরে স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা বিজয়ের নিশান উড়িয়ে উল্লাস করে স্বজন-হারাদের কান্না ভুলে গিয়েছিল। জেলার বিভিন্ন স্থানে আটটি বধ্যভূমিতে শহীদদের লাশ শনাক্ত করতে বা তাদের কবর চিহ্নিত করতে ছুটে বেড়িয়েছিল স্বজন-হারারা।

ফেনী অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে কর্মরত তৎকালীন ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে (পরবর্তীতে লে. কর্নেল হিসেবে (অব.) ভারতের বিলোনীয়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল থেকে ১০ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অভিযানে পর্যুদস্ত হয়ে সম্মিলিত পাক বাহিনী চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। ফেনী হানাদারমুক্ত হওয়ার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রামের সঙ্গে সড়ক ও রেল পথে হানাদার বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতে করে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সূর্য উদিত হওয়ার বিষয়টি সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর অনেকগুলো রণাঙ্গনের মধ্যে মুন্সীর হাটের মুক্তারবাড়ী ও বন্ধুয়ার প্রতিরোধের যুদ্ধ ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ রণাঙ্গনে সম্মুখ সমরের যুদ্ধকৌশল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমিগুলোতে পাঠ্যসূচির অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যা এ রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের অহংকার ও গর্বের বিষয়।

Advertisement

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ফেনী জেলার বিভিন্নস্থানে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। লাশ ফেলা হয় পুকুর, খাল, নদী, ডোবা-নালায় ও গভীর জঙ্গলে। ফেনী সরকারি কলেজ এলাকার বধ্যভূমি, দাগনভূঁঞার রাজাপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ সংলগ্ন চৌধুরী বাড়ির পার্শ্বে অরক্ষিত বধ্যভূমি, ফুলগাজীর জামমুড়া গ্রামের বধ্যভূমি, পরশুরামের মালিপাথর বধ্যভূমি ও একই উপজেলার সলিয়া বধ্যভূমি চিহ্নিত হলেও স্বাধীনতার ৪৯ পার হলেও বেশিরভাগ গণকবর চিহ্নিত করা হয়নি।

সেদিনের বিবরণ দিতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাক হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে ফেনীর সব সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে ৫ ডিসেম্বর রাতে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। এ সংবাদ শুনেই জয় বাংলা শ্লোগান ও করতালির মধ্য দিয়ে ফেনীর রাজাঝির দিঘীর পাড়ে সার্কিট হাউজে ও ট্রাংক রোডের প্রেসক্লাব ভবনের সামনে মুক্তিযোদ্ধারা ও হাজার-হাজার মুক্তিকামী মানুষ একত্রিত হতে থাকে।

সেদিন সকালেই ফুলগাজীর বন্দুয়া থেকে এসে ফেনী সার্কিট হাউজে (বর্তমান ফেনী সড়ক ও জনপথ বিভাগের রেস্ট হাউজ) প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন ২নং সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী লে. কর্নেল (অব.) জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা।

দিবসটি উপলক্ষে জেলা প্রশাসন আয়োজন করেছে নানা আয়োজন। শহরের জেল রোডস্থ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শুরু হবে। এছাড়া বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ফেনী জেলা শহরে আলোচনা সভা ও বিজয় র‌্যালি বের করবে। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন দিবসটি উদযাপনের জন্য নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

Advertisement

রাশেদুল হাসান/এআরএ/এমএস