>> দেশে গড়ে প্রতিদিন ৪০টি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়>> বিশ্বে বছরে প্রায় লাখ ৫৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়
Advertisement
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনা গ্রামের খলিল উল্লাহ বাড়ির পাঁচ বছরের শিশু মো. রফিক। গত ৫ জুলাই দুপুরের দিকে উঠোনে খেলছিল সে। মা মার্জিনা বেগম তখন ব্যস্ত রান্নার কাজে। খেলতে খেলতে সবার অলক্ষ্যে রফিক পড়ে যায় পাশের পুকুরে।
রফিককে খুঁজে পাওয়ার পর ছোট্ট দেহে প্রাণ আছে কি নেই বোঝা যায় না। পরিবারের লোকজন যখন তাকে বাঁশখালী হাসপাতালে নিয়ে যায়, সবার আদরের রফিক তখন সব বন্ধন ছিন্ন করেছে। সন্তান হারানোর বেদনায় চোখের জল আজীবনের সাথী হয় মোহাম্মদ শওকত ও মর্জিনা দম্পতির।
একইভাবে গত ৮ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরকাঁকড়া ইউনিয়নের রমজান আলী সারেং বাড়িতে দেড় বছর বয়সী রিয়া মনি এবং চরহাজারী ইউনিয়নের দেওয়ান আলী পাটোয়ারী বাড়িতে দেড় বছর বয়সী লামিয়ার মৃত্যু হয় পুকুরের পানিতে ডুবে।
Advertisement
মানুষের অসচেতনতা ও সরকারের সক্রিয় পদক্ষেপের অভাবে দেশে প্রতিদিনই পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর এমন মিছিল। হারিয়ে যাচ্ছে হাজারো সম্ভাবনাময় প্রাণ, আদরের ধন খুঁইয়ে দুঃসহ বেদনার হাহাকার প্রলম্বিত হচ্ছে হাজারো পরিবারে।
পরিসংখ্যান বলছে, রোগ-বালাইয়ের বাইরেও বাংলাদেশে প্রতি বছর বড় সংখ্যক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। ২০১৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অর্থায়নে দ্য সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশে (সিআইপিআরবি) এবং আইসিডিডিআর’বি পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৪০টি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এর মধ্যে ৩০টি শিশুর বয়স পাঁচ বছরের কম।
গাইবান্ধার সাঘাটায় খালের পানিতে ডুবে মারা যায় আরাফাত হোসেন (৫), মরদেহ উদ্ধারের পর স্বজনদের আহাজারি
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর পৃথিবীতে তিন লাখ ৫৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এর ৯০ শতাংশই মারা যায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে।
Advertisement
শিশুমৃত্যুর এই ভয়াবহ চিত্রকে অনেকেই বলেছেন ‘নীরব মহামারি’। ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ঘটে বলে তা গুরুত্বহীন থেকে যাচ্ছে।
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের (আইএইচএমই) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি এক লাখের মধ্যে পানিতে ডুবে মানুষের মৃত্যু হয় ৮ দশমিক ৯ জনের। আইএইচএমই-এর ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, পানিতে ডুবে মানুষ মারা যাওয়ার হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কমনওয়েলথভুক্ত শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে পঞ্চম।
২০১৬ সালের বাংলাদেশ হেলথ ও ইনজুরি সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী, ইনজুরি বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুর ক্ষেত্রে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যু। ইনজুরি বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুর মধ্যে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ পানিতে ডুবে মারা যায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রাণ যায় আত্মহত্যায়, এই হার ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ হার নিয়ে এরপরেই রয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গ্লোবাল রিপোর্ট অন ড্রাউনিং-এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এক থেকে চার বছরের শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশ শিশুই মারা যায় পানিতে ডুবে।
অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কম এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, চলতি বছরের জুন মাসে দেশের ২৭ জেলায় খেলাধুলা করার সময় পুকুরে ও ডোবার পানিতে ডুবে ১০০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এসব শিশুর বয়স ছয় মাস থেকে ১০ বছরের মধ্যে। এছাড়া একই মাসে বন্ধুদের নিয়ে নদীতে গোসল করতে গিয়ে কয়েকজন কিশোরেরও মৃত্যু হয়েছে।
প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে ‘বাড়ির পাশে খেলার সময় পানিতে ডুবে ১০০ শিশুর মৃত্যু ’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি গত ১ জুলাই প্রকশিত হয়।
দেশে বন্যার সময় পানিতে ডুবে মৃত্যু বেড়ে যায়
গত ১ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত পঞ্চগড়ে ১০, ঠাকুরগাঁওয়ে চার, নীলফামারীতে এক, লালমনিরহাটে তিন, কুড়িগ্রামে সাত, দিনাজপুরে নয়, রংপুরে দুই, গাইবান্ধায় তিন, লক্ষ্মীপুরে আট, নওগাঁয় চার, সুনামগঞ্জে সাত, হবিগঞ্জে তিন, কুষ্টিয়ায় চার, কুমিল্লায় দুই, ভোলায় তিন, চুয়াডাঙ্গায় এক, খাগড়াছড়িতে তিন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক, বরিশালে দুই, ঝালকাঠিতে এক, মৌলভীবাজারে দুই, জামালপুরে এক, মুন্সিগঞ্জে দুই, নোয়াখালীতে পাঁচ, নেত্রকোনায় আট, বরগুনায় দুই, সিলেটে এক ও টাঙ্গাইলে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বেসরকারি সংস্থা সোসাইটি ফর মিডিয়া অ্যান্ড সাসটেইনেবল হিউম্যান কমিউনিকেশন টেকনিকস (সমষ্টি) পরিচালিত এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ২৫০টি ঘটনায় ৪৪৮ জন ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা গেছে। এদের মধ্যে ৩১৭ জনের (৭০ দশমিক ৭৫ শতাংশ) বয়সই নয় বছরের কম।
পানিতে ডুবে মৃত্যুর সবগুলো ঘটনার তথ্য গণমাধ্যমে আসে না। এ নিয়ে জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে কোনো কার্যকর তথ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা এখনো গড়ে উঠেনি বলে জানিয়েছেন পানিতে ডুবে মানুষের মৃত্যুর তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা।
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিয়ে গবেষণা ও রোধে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)। এই সংস্থার উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. আমিনুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০১৬ সালে বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে করা হয়। সেখানে দেখা যায় প্রতি বছর বাংলাদেশে সব বয়সের প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এর ১০ হাজারই হচ্ছে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু।’
জরিপ অনুযায়ী প্রতিদিন ৪০টি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় জানিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার, বাংলাদেশ-এর পরিচালক আমিনুর রহমান বলেন, ‘পানিতে ডুবে ১৯ হাজার মানুষের মৃত্যুর মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী মানুষ রয়েছে সাড়ে ১৪ হাজার।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর তিন লাখ ৫৯ হাজারের মতো মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়, এর ৯০ শতাংশই মারা যায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। সব দেশেই পানিতে ডুবে মৃত্যুর মধ্যে এক থেকে চার বছরের শিশু মৃত্যুর হার বেশি।’
বেশিরভাগ শিশুর মৃত্যু ঘটে বাড়ি থেকে ২০ মিটার দূরে পুকুরে
আমিনুর রহমান বলেন, ‘করোনায়ও প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। সেটার ওপর আমরা ইনটেসিভলি নজর রাখছি। করোনায় এখন প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জনের মতো মারা যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিদিন বাংলাদেশে ৪০টি শিশু পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। এটা নীরব প্যানডেমিক (মহামারি)। করোনাকে আমি ছোট করে দেখছি না। কিন্তু শিশুমৃত্যুর বিষয়টিতে যেভাবে ভয় পেয়ে নজর দেয়া উচিত, সেভাবে কি দিচ্ছি?’
বাংলাদেশে পানিতে ডুবে বেশি শিশুমৃত্যুর কারণ তুলে ধরে আমিনুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে নদী ও জলাশয় অনেক বেশি, তাই মানুষ পানির কাছাকাছি থাকেও বেশি। এছাড়া মানুষের সচেতনতার অভাব রয়েছে। কাছে জলাশয় বা পুকুর থাকলে শিশুরা যে পড়ে গিয়ে ডুবে মারা যেতে পারে, সেই বিষয়ে মানুষ সচেতন নয়। শিশুদের নজরদারির অভাব রয়েছে। যেভাবে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান করার কথা, সেভাবে তত্ত্বাবধান করা হয় না। দক্ষতার অভাব বা সাঁতার না জানার কারণে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। দেখা গেছে, বেশির ভাগ শিশু ১০ বছর হওয়ার পর সাঁতার শিখে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিশুদের ক্ষেত্রে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সময়টা সকাল ৯টা থেকে দুপুর পর্যন্ত। যখন মায়েরা রান্নাবান্না ও ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকে। বাবারা বাড়ির বাইরে থাকেন, বড় ভাই-বোনেরা যখন স্কুলে থাকে। বাচ্চারা আনঅ্যাটেন্ডেড (একাকি) থাকে। সাধারণত দেখা যায় ৮০ শতাংশ শিশুর (পাঁচ বছরের কম বয়সী) মৃত্যু ঘটে বাড়ি থেকে ২০ মিটার দূরে পুকুরে।’
সব ঋতুতেই শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে জানিয়ে আমিনুর রহমান বলেন, ‘বর্ষাকালে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। একটা বাচ্চার পানিতে ডুবে মৃত্যুর জন্য এক হাঁটু পানিই যথেষ্ট। বন্যার সময়ও পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে।’
২০১৬ সালের পর আর পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিয়ে জরিপ হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে গবেষণা অব্যাহত রাখতে হবে। আর রেগুলার তথ্য দরকার। তবে একটি সিস্টেমের মধ্যে এনে সরকার এটা করতে পারে।’
‘পানিতে ডুবে মৃত্যুর হিসাব সেভাবে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। কেউ পুলিশে রিপোর্ট করে না। রিপোর্টিং সিস্টেম সরকার দাঁড় করাতে পারে। ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃত্যু রেকর্ড করা যেতে পারে, এটা খুব কার্যকর উপায় হবে। আমরা বছর শেষে জানতে পারব এই বছর কতজন মারা গেল। সেই অনুযায়ী সরকার পরিকল্পনাও নিতে পারবে’—বলেন সিআইপিআরবির উপ-নির্বাহী পরিচালক।
আরএমএম/এমআরআর/এইচএ/এমএস