নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরে মৌলিক সব ধরনের সুবিধা রেখে রোহিঙ্গাদের জীবন যাপনের জন্য সরকারের সুপরিকল্পিত আয়োজনে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর (এনজিও) প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, উন্নতমানের একটি আবাসিক এলাকায় যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে, তার সবই সেখানে রয়েছে। এর আগে ভাসানচর পরিদর্শন করলেও এখন সেখানে কাজ করতে গেছেন তারা। নিয়েছেন টন টন খাদ্যসামগ্রী। তাদের সঙ্গে যাচ্ছেন মেডিকেল প্রতিনিধিরাও।
Advertisement
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার জনকে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে নিয়ে যাওয়া হবে ভাসানচরে। বিভিন্ন ধাপে লাখখানেক রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরিত করা হবে এ দ্বীপে। এজন্য এখন বেশ ব্যস্ততা একসময়ের নীরব ভাসানচরে।
সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরের এ দ্বীপ ঘুরে দেখে গেছে, রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম ঘিরে ২২টি এনজিও কাজ শুরু করেছে। ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত নেয়া হয়েছে ৬৬ টন খাদ্যসামগ্রী। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম এনে সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে নৌবাহিনীর ১৪টি জাহাজ। প্রথম দুই মাস তাদের রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হবে। এরপর নিজ নিজ বাসস্থানেই তারা রান্না করতে পারবেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় তিন হাজার ১০০ কোটি টাকায় নির্মিত রোহিঙ্গাদের জন্য এই অস্থায়ী আবাসস্থল এখন কর্মমুখর। দ্বীপটি বাসস্থানের উপযোগী করা, অবকাঠামো উন্নয়ন, বনায়ন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে। রোহিঙ্গাদের জন্য আধুনিক বাসস্থান ছাড়াও বেসামরিক প্রশাসনের প্রশাসনিক ও আবাসিক ভবন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভবন, মসজিদ, স্কুল হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ভবন, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও খেলার মাঠ গড়ে তোলা হয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য সেখানে মহিষ, ভেড়া, হাঁস, কবুতর পালন করা হচ্ছে। আবাদ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি। পরীক্ষামূলকভাবে ধান চাষও করা হচ্ছে।
Advertisement
কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পটি মূলত ক্লাস্টার হাউস, শেল্টার স্টেশন বা গুচ্ছগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউস ও শেল্টার স্টেশন নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মিত ভবনসমূহ ভূমি থেকে চার ফুট উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসে ১২টি ঘর, প্রতিটি ঘরে ১৬টি করে রুম রয়েছে। এর সঙ্গে একটি চারতলাবিশিষ্ট কম্পোজিট স্ট্রাকচারের (স্টিল) শেল্টার স্টেশন রয়েছে, যা আনুমানিক ২৬০ কিলোমিটার ঘণ্টায় ঘূর্ণিঝড় সহনীয়।
প্রকল্পটিতে যেন এক লাখ এক হাজার ৩৬০ জন শরণার্থী বসবাস করতে পারেন সে ব্যবস্থার আলোকে গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করা হয়েছে। মোট ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ঘরের সংখ্যা এক হাজার ৪৪০টি। প্রতিটি ঘরে প্রতি পরিবারের চারজন করে মোট ১৬টি পরিবার বসবাস করতে পারবে। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসের এক প্রান্তে বসবাসকারী পরিবারের নারী-পুরুষদের জন্য আলাদা গোসলখানা ও শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং অন্য প্রান্তে রান্নাঘরও রয়েছে। রয়েছে বিদেশি প্রতিনিধিদের জন্য আবাস ব্যবস্থা।
ধর্মীয় ইবাদত পালনে উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহারের জন্য তিনটি শেল্টার স্টেশনকে মোডিফাই করা হয়েছে এবং এর কাজ শেষ পর্যায়ে।
এছাড়া রোহিঙ্গাবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্তের আলোকে কক্সবাজার ক্যাম্পের মতো বর্ণিত শিক্ষাকার্যক্রম চালু রাখার উদ্দেশে প্রকল্প এলাকায় বিদ্যমান দুটি চারতলা বিশিষ্ট শেল্টার স্টেশনকে মোডিফিকেশন করে নন-ফরমাল শিক্ষা কার্যক্রমের সুবিধা রাখা হয়েছে।
Advertisement
রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে ৩৬টি শেল্টারকে মোডিফিকেশন করে দুটি ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল এবং চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। এ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে।
এক লাখ রোহিঙ্গার আনুমানিক তিন মাসের খাবার সংরক্ষণের জন্য চারটি ওয়্যারহাউসও নির্মাণ করা হয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা হেল্প দ্য নিডি চ্যারিটেবল ট্রাস্টের প্রোগ্রাম ম্যানেজার কামরুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা যা ধারণা করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর ও নিরাপদ জায়গা মনে হচ্ছে ভাসানচর। এখানে থাকার জন্য যে শেল্টারগুলো নির্মাণ করা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ভালো মানের।
আরেক বেসরকারি সংস্থা ‘মুক্তি’র মনিটরিং ও ইভ্যালুয়েশন কর্মকর্তা ফয়সাল বারী বলেন, ‘কক্সবাজারের চেয়ে শত শত গুণ ওয়েল ডেকোরেটেড সিস্টেম করা হয়েছে ভাসানচরে। এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সরকারের বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখা যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা এখানে এলে লাইফটা এনজয় করতে পারবে।’
রোহিঙ্গাদের নিয়ে তিন বছর ধরে কাজ করা এনজিও জনসভা কেন্দ্রের প্রতিনিধি সেলিম ভূঁইয়া বলেন, ‘এর আগে এবং এখন এই রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে আমরা যা দেখলাম— সরকার একটা ভালো আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আমরা যেসব এনজিও এখানে এসেছি, তারা সবাই মনে করি উখিয়া ও টেকনাফের তুলনায় এখানে ভালোভাবে থাকতে পারবে রোহিঙ্গারা। আরও মুক্ত পরিবেশে থাকতে পারবে তারা। আমরা এখানে কিছু উপহার সামগ্রী এনেছি রোহিঙ্গাদের জন্য।’
‘পালস বাংলাদেশ’র সহকারী প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর তুহিন সেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকা থেকে এসেছি। এখানে আসার পর মনে হলো পরিবেশটা চমৎকার। এখানে থাকার ব্যবস্থা এবং যোগাযোগের মাধ্যম হতে শুরু করে যে সুবিধাগুলো আছে সবই আমার ভালো লাগলো। মনে হচ্ছে রোহিঙ্গারা এখানে এলে তাদের থাকাটা খুবই চমৎকার হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বর্ষার সময় কক্সবাজারে ভূমিধস হয়। সেখানে রোহিঙ্গারা বন উজাড় করছে। এখানে আমার মনে হয় থাকা এবং খাওয়ার বিষয়টা খুবই ভালো হবে।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক কমোডর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অস্থায়ী এ বাসস্থান নির্মাণ করা হয়েছে। তাদের যতদিন না নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়া হবে, ততদিন তারা এখানেই থাকবেন। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাইক্লোনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে রামগতি, নোয়াখালীতে ‘গুচ্ছগ্রাম’র সর্বপ্রথম ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন। পরে একই ধারণাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই গুচ্ছগ্রামের ধারণা থেকেই রোহিঙ্গাদের জন্য এ আশ্রয়ণ। তারা ফিরে গেলে বাংলাদেশের ভূমিহীন দুস্থ মানুষের থাকার জন্য দ্বীপটি ব্যবহার করা হবে।’
এইচএস/এইচএ/এমকেএইচ