‘কল্লোল যুগ’ বা ‘কল্লোল গোষ্ঠীর’ গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী সদস্য হচ্ছেন বুদ্ধদেব বসু। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদক, সম্পাদক ও সমালোচক। বিংশ শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকের নতুন বাংলা কাব্যরীতির সূচনা করতে তিনি মূল ভূমিকা পালন করেছেন। ‘প্রগতি’ ও ‘কল্লোল’ নামে দুটি পত্রিকায় লেখার মাধ্যমে যে কয়েকজন বাঙালি লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশায়ই রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে দাঁড়ানোর দুঃসাহস করেছিলেন, তিনি তাদের অন্যতম। ‘কল্লোল’ সাহিত্যপত্রের সময়কালকে (১৯২৩-১৯২৯) ‘কল্লোল যুগ’ হিসাবে অভিহিত করা হয়। এ সময়ে বাংলা সাহিত্যে প্রভাবশালী আন্দোলন দানা বাঁধে; যা বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত করে। কল্লোল লেখকদের অন্যতম ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, কাজী নজরুল ইসলাম ও বুদ্ধদেব বসু।
Advertisement
বুদ্ধদেব বসু ১৯০৮ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৪ সালের ৮ মার্চ কলকাতায় মারা যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে ১৯৩০ সালে প্রথম শ্রেণিতে বিএ অনার্স এবং ১৯৩১ সালে প্রথম শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রাবস্থায় বুদ্ধদেব বসু হাতে লেখা ‘পতাকা’, ‘ক্ষণিকা’ ও মাসিক ‘প্রগতি’ পত্রিকার সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাত্র অবস্থায় তিনি ‘বাসন্তিকা পত্রিকা’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনা করতেন বলে জানা যায়।
বুদ্ধদেব বসু উচ্চমানের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন। ঢাকার পুরানা পল্টন থেকে তাঁর ও অজিত দত্তের যৌথ সম্পাদনায় ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত সচিত্র মাসিক ‘প্রগতি’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন। কলকাতা বসবাসকালে তিনি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহযোগিতায় ১৯৩৫ সালে ত্রৈমাসিক ‘কবিতা’ পত্রিকা সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। পঁচিশ বছরেরও অধিককাল তিনি পত্রিকাটির ১০৪টি সংখ্যা সম্পাদনা করে আধুনিক কাব্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ‘প্রগতি’র প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বিশ্ব সাহিত্যকে ধারন করে বাংলা সাহিত্যকে প্রতিষ্ঠিত ও উচ্চমার্গে নিয়ে যাওয়া। ফলশ্রুতিতে প্রগতির প্রতি সংখ্যায় বিদেশি সাহিত্য থাকত। গল্প, কবিতা, কাহিনি বা অনুবাদ ছাপা হত। প্রগতির প্রথম সংখ্যায়ই এইচ জি ওয়েলসের রদেনস্টাইনের ছবি আঁকা ছিল। রবীন্দ্রবলয় থেকে বেরিয়ে আসার আকাঙ্ক্ষীদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল ‘প্রগতি’। পত্রিকাটির মাধ্যমে তিরিশের কবিদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রতিভাবান বুদ্ধদেব বসু। সমালোচকের অনেকেই বলে থাকেন, কিছু বছর আগের কল্লোলের চেয়েও প্রভাববিস্তারকারী ছিল ‘প্রগতি’ পত্রিকাটি।
‘পরিচয়’ সাহিত্যপত্রের এক আড্ডায় অন্নদাশংকর রায়ের হাতে ইংরেজি ‘পোয়েট্টি’ পত্রিকাটি দেখে বুদ্ধদেব বসু অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, মার্কিন কবিতাপত্রিকাটির মতো যদি তিনিও একটি কবিতাপত্রিকা করতে পারতেন! ফলশ্রুতিতে সম্পাদনায় এসব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে শুধু কবিতাকেন্দ্রিক একটি সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। নামও দিলেন ‘কবিতা পত্রিকা’। আধুনিক বাংলা কবিতার পক্ষে বলিষ্ঠতম কণ্ঠস্বর তাঁর। বিশেষ করে পত্রিকাটির মাধ্যমে। আধুনিক বাংলা কবিতা প্রতিষ্ঠার জন্য এত শ্রম, ঘাম, ত্যাগ স্বীকার আর কেউ করেননি। এজন্য তাঁকে অনেক সমালোচনা ও অপবাদ শুনতে হয়েছে।
Advertisement
বাংলা ভাষার অগ্রগণ্য সাহিত্যপত্র হচ্ছে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকা। ১৯৩৫ সালের অক্টোবর মাসে বুদ্ধদেব বসু প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহযোগিতায় ‘কবিতা’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করেন। বাংলা সাহিত্যে নতুন কবিদের জন্য উৎকৃষ্ট প্লাটফর্ম হিসেবে বহু বছর ধরে কবিতা পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ‘কবিতা’ পত্রিকার মাধ্যমেই সত্যিকার বুদ্ধদেব হয়ে ওঠেন তিনি। এখানে সর্বাধিক কবিতাও লিখেছেন তিনি। রবীন্দ্রবলয় থেকে মুক্তি দিয়ে বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলা সাহিত্যের পথচলার জন্য নিরলস কাজ করেছেন তিনি। এজন্য সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় কাজ করেছেন। অনুবাদেও যথেষ্ট সময় দিয়েছেন। সমালোচনার জন্য তিনি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। জীবনানন্দ দাশকে উচ্চাসনে নিয়ে আসতে বুদ্ধদেব বসুর অবদান অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে কবিতা পত্রিকার ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাঙালি অনেক কবির ক্ষেত্রেই বুদ্ধদেব বসু অনুপ্রেরণার নাম। অবহেলিত সাহিত্যমেধাগুলো তুলে আনতে রাতদিন পরিশ্রম করেছেন তিনি। সমালোচক হিসাবে যথেষ্ট পারঙ্গমতার পরিচয় দিলেও কবি হিসাবে নিজেকে ততটা উচ্চাসনে নিয়ে যেতে পারেননি। তাঁকে দেখেই বলা হয়, ভালো সমালোচক মানেই ভালো কবি না-ও হতে পারেন।
বুদ্ধদেব বসু ছিলেন আধুনিক কবিকূলের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। কলকাতায় তার বাড়ির নাম রেখেছিলেন ‘কবিতা ভবন’। এখানে তৎকালীন আধুনিক কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা হতো। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সমালোচনা, নাটক, কাব্যনাটক, অনুবাদ, সম্পাদনা, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ, সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫৬টি। বুদ্ধদেব বসু বাংলা সাহিত্য সমালোচনা ও কিছু সাময়িকী পত্রিকা সম্পাদনা ও গোষ্ঠীতে নেতৃত্ব বা সহযোগিতা করার জন্য বেশি স্মরণীয় হয়ে আছেন। সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭০ সালে ‘পদ্মভূষণ’ এবং ১৯৬৭ সালে ‘সাহিত্য আকাদেমি’ পুরস্কার (তপস্বী ও তরঙ্গিণী কাব্যনাট্য) লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি ১৯৭৪ সালে মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ (স্বাগত বিদায়) লাভ করেন।
প্রগতির ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যায় (শ্রাবণ ১৩৩৪) জীবনানন্দের ‘খুশ-রোজী’ কবিতাটি ছাপা হয়। ‘ঝরা পালক’র কবিতা প্রগতিতে প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকাটিতে বুদ্ধদেব বসু সযত্নে জীবনানন্দ দাশের কবিতা ছাপতেন। বিশিষ্ট জীবনানন্দ দাশ গবেষক ক্লিনটন বি. সিলি বলেছেন, ‘প্রগতি কেবল জীবনানন্দ দাশের কবিতা ছাপেনি, বুদ্ধদেব নিজে দায়িত্ব নিয়েছিলেন জীবনানন্দের ওপর দুটি সম্পাদকীয় লেখার, যা ছিলো তাঁর ওপর লেখা প্রথম আলোচনা...’। এরপর থেকে জীবনানন্দ সত্যিকারের জীবনানন্দ হয়ে লিখতে শুরু করেন। বুদ্ধদেব বসু প্রমাণ করেছেন সম্পাদকের অন্যতম গুণ বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। সম্পূর্ণ অনাসক্ত ও নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি বাছাই করেছেন ভালো কবিতা। স্বীকৃতি দিয়েছেন যোগ্য কবিকে।
‘কবিতা পত্রিকায় কবিতা ছাপা হওয়া মানেই কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করা’- বাংলা সাহিত্যে এমন গৌরব আর কোনো সাহিত্যপত্র অর্জন করতে পারেনি। অনেক কবির কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতেন যেন ‘কবিতা’ পত্রিকায় তাদের কবিতা ছাপা হয়। বুদ্ধদেবকে ‘কবিদের কবি’ আখ্যা দিয়ে আল মাহমুদ লিখেছিলেন, ‘আমাদের তখনকার আড্ডাটা ছিল ‘বিউটি রেস্তোরা’, বাংলাবাজারে। সেখানে গেলে আমার বন্ধু শহীদ কাদরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনি আমাকে সদ্য প্রকাশিত কবিতা পত্রিকার চৈত্র সংখ্যাটি হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এই নাও তোমার কবিতা ছাপা হয়েছে।... আমি এক ঝটকায় পত্রিকাটি হাতে তুলে নিয়ে দেখে নিলাম। জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসুর পরেই আমার কবিতা ছাপা হয়েছে।... আমার তিনটি কবিতা ছাপা হওয়াতে আনন্দে আমার ফেটে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। সেদিন থেকেই আমি ভেবে নিয়েছিলাম আমি কবি হব। কবি ছাড়া আর কিছু না। এভাবেই বসু আমাদের জীবনে এক মহান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।’
Advertisement
ভবিষ্যতের কবিকে স্বাগত জানানো, অবহেলিত কবি প্রতিভাকে খুঁজে বের করা ও আধুনিক কবিতাকে জনপ্রিয় করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন, অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। উদ্যোগ, আধুনিক কবির রচনার সঠিক মূল্যায়ন তাঁকে অনন্যতা দিয়েছে। ফলে বহুমুখী বুদ্ধদেব বসুর কবিতাকেন্দ্রিক কর্মযজ্ঞের উজ্জ্বলতম প্রকাশ ঘটেছে তাঁর ‘সম্পাদক’ সত্তার মধ্যদিয়ে। সম্পাদকের চেয়ারে থেকে বুদ্ধদেব বসু কবিতা নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন। তাঁর মতো এত কবিতাপ্রেমিক সাহিত্যিক বা সংগঠক বিশ্বে বিরলই। ব্যতিক্রমী এ বিরল দৃষ্টান্তের জন্য বুদ্ধদেব বসু বাংলা সাহিত্যের পাঠকের হৃদয়ে আজীবন উচ্চাসনে প্রোথিত হয়ে আছেন এবং থাকবেন। এখন পর্যন্ত তাঁর কেউ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেনি; ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।
এসইউ/এমকেএইচ