মৃত্যুই হচ্ছে জীবনের প্রান্তিক স্টেশন। তার ওপারে আর আলো নেই। কিন্তু কেউ কেউ জীবনের নানা স্টেশনে এমন কিছু রেখে যান যা তার মৃত্যুর পর আরও বেশি আলো ছড়ায়। গত বৃহস্পতিবার বুয়েন্স আইরেসের শহরতলিতে যে লোকটা সমাহিত হলেন; আসলেই কী তিনি মৃত!
Advertisement
হ্যাঁ, মৃত। কারণ; মৃত্যু এক, আদি এবং চূড়ান্ত। আর্জেন্টিনার ভিলা ফ্লোরিতোর বস্তিতে ছয় ফুট বাই ছয় ফুট, দুই ঘরের বাস করা পরিবারে ৬০ বছর আগে যে দিয়েগো ম্যারাডোনার জন্ম হয়েছিল, তিনি হৃদরোগে মারা গেছেন। বুয়েন্স আইরেস শহরতলিতে মা-বাবার কবরের পাশেই তিনি শায়িত। কিন্তু ফুটবলার ম্যারাডোনা? বিশ্ব ফুটবলে তার স্মৃতির বুনোট এমন, মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শেও সেগুলো অটুট। ফুটবল মাঠের চতুর্দিকে সেগুলো মুগ্ধতার হাওয়ায় ভেসে বেড়াবে।
মাত্র ৯ বছর বয়সে যে কিশোর টেলিভিশনে ফুটবল স্কিল দেখিয়ে সংসার চালাতে টাকা দিতেন, টিভির সামনে ফুটবল, কমলা লেবু আর বোতলের ছিপি নাচিয়ে পরিবারকে টেনেছেন, বস্তিতে কাদায় থিক থিক করা ৩০ গজী জমিতে ফুটবল প্র্যাকটিস করতে ১৩ বছর বয়সে স্কুল ছেড়েছেন, আবার ১৬ বছর বয়সে কোকাকোলাা কোম্পানি তাকেই ৬ লাখ ডলার স্পন্সরশিপ অফার দিয়েছে! এরপর সেই ফুটবল দিয়েই যে লোকটা বিশ্বে তার দেশের সেরা ব্র্যান্ডিং করেছিলেন, সেই ম্যারাডোনা মরেন কীভাবে! ব্যক্তি ম্যারাডোনা মৃত। কিন্তু ফুটবলার ম্যারাডোনা অমর। সেটা আগামী ২১ বছর, ২০০ বছর হয়তো হাজার বছর র্পযন্ত।
আবেগে মোড়ানো ফুটবল নামক খেলাটার সেরা বিজ্ঞাপন- দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা। সেটা মাঠে এবং মাঠের বাইরে। ফুটবলীয় দক্ষতায়-কেলেঙ্কারি-বিতর্কে। ম্যারাডোনাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো চরিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে কী? নিশ্চিতভাবে পাল্টা প্রশ্ন করা হবে; কেন পেলে? হালফিলের মেসি-রোনালদো- নেইমার! আসলে তুলনা করার কাজটা অযৌক্তিক। একই সঙ্গে অনৈতিক। তারপরও এই তুলনা তর্ক-বিতর্ক ছিল, আছে এবং থাকবে।
Advertisement
ফুটবল গ্রহে পেলে-ম্যারাডোনা শ্রেষ্ঠত্বের বিতর্ক থাকবে। পেলে দুর্ধর্ষ, অসাধারণ যার সম্পর্কে বলা হয় এক ডজ দুবার দেন না। যার ঘরে গোটা তিনেক বিশ্বকাপ মেডেল আছে, যিনি মাস্টার কার্ড, ইউনিসেফের মতো জগদ্বিখ্যাত সংস্থার মার্কেটিং সেরা অস্ত্র। তার জন্য আলাদা একটা ইমেজ পেলে সব সময় ধরে রেখেছেন। আপদমস্তক রাষ্ট্রদূতসুলভ আচরণ। এই ইমেজযুদ্ধে পেলের ধারে কাছে রাখা যাবে না ম্যারাডোনাকে। অথচ দুজন প্রায় একই রকম জায়গা থেকে উঠে এসেছেন। দুজনেই অল্প শিক্ষিত। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। শৈশব-কৈশোর কেটেছে দু’জনেরই চূড়ান্ত দারিদ্র্যের মধ্যে।
এত সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে দুজনই বিত্তবৈভবের মালিক। কিন্তু একজন ভারসাম্য হারাননি। অন্যজন ভীষণভাবে রাতারাতি বিত্তবৈভবের মধ্যে ঢুকে পড়ে ভারসাম্য ধরে রাখতে পারেননি। তিনি ম্যারাডোনা। তারপরও ফুটবলের সেরা বিজ্ঞাপন সেই ম্যারাডোনা। সেটা মাঠে এবং মাঠের বাইরে। মাদক, ডোপ কেলেঙ্কারি, নারী কেলেঙ্কারির পরও। মাঠে সেরা বিনোদনকারী আর্জেন্টিনার এই পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। ম্যারাডোনা বিশ্বের সব মাঠে সেরা হয়েই খেলেছেন। সেটা স্পেনের মাঠ, ইতালির মাঠ কিংবা আর্জেন্টিনাই হোক।
পেলে দুর্দান্ত। অসাধারণ। কিন্তু ইতালি বা স্পেনের ফুটবল লিগের মতো কঠিন লিগে নিজেকে ফেলেননি। কিন্তু ম্যারাডোনা মার খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে খেলে গেছেন। অসম্ভব সাহস আর সহনশীলতা তার। মাঠে ম্যারাডোনার ভূমিশয্যা নেয়া সেটাও দর্শকদের কাছে অন্যরকম এক অনুভূতি বা সহানুভূতির জন্ম দিয়েছে। ড্রাগ নেয়া, ড্রাগ রাখা, ড্রাগ চালান, সাংবাদিকদের সাথে দুর্ব্যবহার, তাদের দিকে এয়ারগান ছোড়া বিশ্বকাপে ডোপিং করে ধরা পড়া- এই লোকটা কীভাবে ফুটবলের সেরা বিজ্ঞাপন হন?
হন। কারণ, এফিড্রিন নিয়ে কেন, এফিড্রিনের ড্রামে চুবিয়ে রেখেও অন্য কাউকে দিয়ে কী ওই ফুটবল খেলানো সম্ভব? যা ম্যারাডোনা খেলে দেখিয়েছেন! তাছাড়া স্পেন, ইতালিতে বিশ্বসেরা সব ডিফেন্ডারের সঙ্গে যে মাস্তানিটা তিনি করে দেখিয়েছেন, সেটা তার আগে পরে ক’জনে করেছেন? ফুটবল সম্রাট পেলে এই মাস্তানি থেকে নিজেকে সব সময় দূরে সরিয়ে রাখতে ইউরোপেই পাড়ি দেননি।
Advertisement
ম্যারাডোনাকে ইংলিশ মিডিয়া সব সময় বলেছে, ‘অর্থ পিশাচ’! ডলারের জন্য তিনি নাকি ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে হৃদয়হীন মানুষ! মাঠে এবং মাঠের বাইরে ম্যারাডোনা যা করেছেন এবং তাকে নিয়ে যা লেখা হয়েছে, তাতে তার ভক্তদের হৃদয়ের ওপর চাপ বেড়েছে সব সময়। শেষ পর্যন্ত হৃদয়ের রোগেই পৃথিবী ছাড়লেন তিনি। করোনাকালে প্রতিদিন মৃত্যুর মধ্যেই চক্কর কাটছে পৃথিবীর মানুষ। কিন্তু হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ম্যারাডোনার মৃত্যু- শিরানোম হলো বিশ্বজুড়ে। মৃত্যুও যেন ম্যারাডোনাকে অমরত্বের সীলছাপ্পর দিয়ে দিল!
আর মৃত্যুর পর শোনা যাচ্ছে অর্থ পিশাচ সেই মানুষটার ব্যাংক ব্যালান্স খুব একটা স্ফীত নয়! অবিশ্বাস্য! আবার বিশ্বাসযোগ্য। কারণ বস্তিতে জন্ম নেয়া এই লোকটাই অনাথ শিশুদের জন্য লাখ লাখ টাকা দিয়েছেন। কারখানা শ্রমিকদের হাতে নিজে চেক পৌঁছে দিয়েছেন। ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষতাড়িত মানুষদের জন্য বিনা পারিশ্রমিকে ম্যাচ খেলেছেন!
ফুটবলে স্বর্গীয় বিনোদনের জন্য ম্যারাডোনার গোল আছে। ফুটবল বিজ্ঞাপনের জন্য একটা কথাই বলা যায়। ১১ জনের দলে ‘দশ নম্বর’ জার্সিধারী যে একাই ১০ জনের দায়িত্ব পালন করে দলকে চ্যাম্পিয়ন করেছেন! হোক সেই দলটার নাম নাপোলি কিংবা আর্জেন্টিনা!
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।
এইচআর/এমএস