বিশেষ প্রতিবেদন

স্বাস্থ্যকর্মীকে সপ্তাহে একদিন পাওয়া যায়!

রোববার বেলা ১২টা। খুব ভোরে বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে চরের ভেতরের প্রায় ৭/৮ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে একমাত্র স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র কমিউনিটি ক্লিনিকে এসেছেন আকলিমা বানু (৪৫)। এসময় তার সঙ্গে ছিল ১০ বছরের অসুস্থ নাতি সবুজ। নাতির সর্দি-কাশির ওষুধ নিতে এসে আকলিমা জানতে পারলেন তিনি কোনো চিকিৎসা পাবেন না। কারণ, শংকরপুর চরের এই একমাত্র কমিউনিটি সপ্তাহে মাত্র একদিন খোলা থাকে। দায়িত্বপ্রাপ্ত নারী চিকিৎসক থাকেন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ৪৪ কিলোমিটার দূরে বগুড়া শহরে। তিনি চাকরি রক্ষার্থে সপ্তাহে একটি দিন কর্মক্ষেত্রে হাজিরা দেন। ওই একটি দিনই শুধু ওষুধপত্র সরবরাহ করা হয়। সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে অসুস্থ রোগীদের যেতে হয় চর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে সারিয়াকান্দি উপজেলা সদরে কিংবা জামালপুর জেলার কয়রা এলাকায়। এ কারণে দুর্গম এই চরের বাসিন্দা ছয় হাজার মানুষের অধীর অপেক্ষা সপ্তাহের শুধু এই একটি দিনের জন্য। তবে এই কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য সহকারী রূপসী বেগম মোবাইলে জাগো নিউজকে জানান, তিনি সপ্তাহের প্রতিদিন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে হাজির হতে না পারলেও চেষ্টা করেন সপ্তাহে অন্তত ৩/৪ দিন যাবার। শংকরপুর চরেই তারা শ্বশুরবাড়ি। তাই সেখানকার মানুষের প্রতি তার আলাদা যত্ন নেবার তাড়না আছে। তার অনুপস্থিতিতে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন কাজ চালিয়ে নিতে পারেন।স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা টুকু জাগো নিউজকে জানান, স্বাস্থ্যকর্মীরা তার কথা শোনে না। তিনি অনেক অনুরোধ করার পরেও গ্রামের দরিদ্র এসব মানুষের সেবা দিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়মিত ক্লিনিক খোলা রাখার ব্যবস্থা করতে পারেননি। এ কারণে অসহায় এসব মানুষকে ছুটতে হয় অনেক দূরে। সপ্তাহের প্রতিদিন যেখানে কমিউনিটি ক্লিনিক খোলার কথা সেখানে, খোলা থাকছে মাত্র একদিন। অথচ বিষয়টি দেখার কেউ নেই।চরাঞ্চলের চিত্র এ ধরনের হলে শহরের চিত্র যে উল্টো তা নয়। প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রতি ৫ হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হলেও সাধারন মানুষের স্বাস্থ্য সেবায় সেগুলো কোন কাজেই আসছে না। প্রয়োজনীয় ওষুধ, জনবল সঙ্কট, ক্লিনিক চালু না থাকাসহ গ্রামাঞ্চলের মানুষের কমিউনিটি ক্লিনিক সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকায় এ খাত থেকে কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেন না তারা। তাই বেহাল দশা এই গুরুত্বপূর্ণ সেবা কেন্দ্রটির। নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত হওয়ায় লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এসব কমিউনিটি ক্লিনিকের বেশিরভাগই এখন পরিত্যক্ত হয়ে গেছে।বগুড়া সিভিল সার্জন অফিসের পরিসংখ্যানবিদ জয়নাল আবেদীন জাগো নিউজকে জানান, প্রতিটি ঘরে ঘরে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিতে এই কমিউনিটি ক্লিনিক (সিসি) কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। বর্তমানে বগুড়া জেলার প্রস্তাবিত ৩১৫টি সিসির মধ্যে ২৮৭টিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে। প্রতিটি সিসিতে একজন করে হেলথ প্রোভাইডার নিয়োগ শেষ করা হয়েছে। তবে তারা ট্রেনিংয়ের জন্য এখনো সব দায়িত্ব বুঝে নেননি। তাদের জায়গায় একজন করে স্বাস্থ্য সহকারী সিসিগুলোতে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন। সাধারণত সিসিগুলোতে, টাইফয়েড, কালাজ্বর, জর, সর্দি-কাশি, চর্ম রোগ, পাতলা পায়খানাসহ প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। সেক্ষেত্রে জরুরি কোনো রোগী হলে তাকে থানা বা জেলা পর্যায়ে প্রেরণ করা হয়। তবে ইউনিয়নের সাধারণ মানুষগুলো চিকিৎসা সেবা নেয়ায় সরকারি একমাত্র মাধ্যম হলো এই কমিউনিটি ক্লিনিক। বগুড়া জেলার ১২ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে স্থাপন করা ৩১৫টি ক্লিনিকের মধ্যে ২৮টি বন্ধ রয়েছে বলে জানান তিনি। সিভিল সার্জন অফিসের স্টোর কিপার জসিম উদ্দিন জাগো নিউজকে জানান, বর্তমানে সিসিগুলোতে জেলা পর্যায় থেকে কোনো ওষুধ সরবরাহ করা হয় না। মন্ত্রাণালয় থেকে চাহিদা মাফিক সরাসরি অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানির মাধ্যমে সিসিতে ওষুধ সরবরাহ করা হয়। এরমধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য সহকারীরা কী পরিমাণ ওষুধ বিতরণ করলো, আর কী পরিমাণ অবশিষ্ট থাকলো তা তাদের জানা থাকে না।বিগত ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষকে সরকারিভাবে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে গ্রামে গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক (সিসি) চালু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রাণালয়ের অধীনে রিভাইটালেইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়াটিভ ইন বাংলাদেশ নামের একটি প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি ইউনিয়নের ৫ হাজার জনসংখ্যার জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের লক্ষ্যে বিগত ২০০০ সালে নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। ওই সময় বগুড়া জেলায় জনসংখ্যার দিক থেকে ৩৭৯টি সিসি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। এই নির্মাণ পর্যায়ক্রমে করার কথা। নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পর সরকার পরিবর্তনের কারণে প্রকল্পটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবারো প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখে এবং কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। বর্তমানে বগুড়ায় ৩১৫টি সিসি নির্মাণ করা হয়েছে। এরমধ্যে বগুড়া সদরের ১১টি ইউনিয়নে ৩৮টি, শাজাহানপুর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে ২৪টি, শিবগঞ্জের ১২টি ইউনিয়নে ৪০টি, সোনাতলার ৭টি ইউনিয়নে ১৯টি, গাবতলীর ১১টি ইউনিয়নে ৩২টি, সারিয়াকান্দির ১২টি ইউনিয়নে ২৫টি, শেরপুরের ১০টি ইউনিয়নে ২৪টি, ধুনটের ১০টি ইউনিয়নে ৩০টি, আদমদীঘির ৭ ইউনিয়নে ২০টি, নন্দীগ্রামের ৫ ইউনিয়নে ২১টি, কাহালুর ৯টি ইউনিয়নে ২৩টি, দুপচাঁচিয়ার ৬টি ইউনিয়নে ২১টি। তবে নির্মিত কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে বন্ধ রয়েছে ২৮টি। সীমাবাড়ী ইউনিয়নের লাঙ্গলমোড়া ও নিশিন্দারা গ্রামে ক্লিনিক চালুর পর কিছুদিন ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহকারীরা স্বাস্থ্য সেবা ও বিনামূল্যে ওষুধপত্র প্রদান করলেও জোট সরকারের আমলে তা বন্ধ হয়ে যায়। এই সিসি আজও চালু হয়নি। এরকম অবস্থা বেশিরভাগ উপজেলাগুলোতেই। সিএমএমইউএর নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার আলী জাগো নিউজকে জানান, ২০০০ সাল থেকে সিসির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। মাঝে প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকার পর আবার চালু করা হয়েছে। বগুড়া জেলায় ২০১১ থেকে এ পর্যন্ত নতুন করে আরও ৩৯টি সিসি নির্মাণ করা হয়েছে। শুরুতে স্থানীয় বাসিন্দাদের দান করা পাঁচ শতক জমিতে সিসি নির্মাণ করা হয়। সেখানে বাজেট ছিল প্রতিটি আড়াই লাখ টাকা। কিন্তু বর্তমানে সেই সিসি নির্মাণে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকা। এতো টাকা দিয়ে ভবন নির্মাণের পর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার ঘটনা দুঃখজনক বলে জানান তিনি।তবে শুধু গ্রামাঞ্চলেই যে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর এই দূরাবস্থা তা নয়। শহরাঞ্চলেও একই অবস্থা। বগুড়া সদরের মালগ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এসকান্দার জাগো নিউজকে জানান, সিসিগুলোতে অভিজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়নি। একজন মাত্র স্বাস্থ্য সহকারী দিয়ে কাজ চলছে। যারা শুধু ট্রেনিং নিয়ে রোগীর ওষুধ দিয়ে থাকে। সব সময় ওষুধ পাওয়া যায় না। বাহির থেকে নিতে হয় ওষুধ। সে জন্যই অনেকেই সিসিতে চিকিৎসা নিতে যায় না। গত সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় বগুড়া সদরের শ্যমবাড়িয়া গ্রামে কমিউিনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায় সদ্য নিয়োগ প্রাপ্ত হেলথ প্রোভাইডার সামছুন্নাহার ক্লিনিক খুলে বসে আছেন। ২/৪ জন রোগী সেবা নিতে আসলেও তিনি তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা ও ওষুধ দিতে পারছেন না। এই ক্লিনিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য সহকারী রিয়াজুল ইসলাম বেলা ১১টা পর্যন্ত আসেননি। ফলে ২/৪ জন রোগী আসলেও অপেক্ষা করে ফিরে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে শ্যামবাড়িয়া গ্রামের রহিমা বেগম জাগো নিউজকে জানান, বাড়ির কাজ-কর্ম ফেলে রেখে এসেছি। ডাক্তার সাহেব কখন আসবেন তার ঠিক নেই। এ কারণে তিনি ওষুধ না নিয়েই ফিরে যাচ্ছেন। বগুড়ার গ্রামাঞ্চলে এমন অনেক ক্লিনিক রয়েছে যেখানে দিনের বেলায় গরু-ছাগল চষে বেড়াচ্ছে আর রাতে বখাটেদের গাঁজা আর মদের আসর বসছে। দীর্ঘ ৭/৮ বছর অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থেকে ক্লিনিকগুলো জরাজীর্ণ ভাঙাচোরা স্থাপনায় পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ দরজা-জানালা চুরি হয়ে গেছে। কোনো ভাঙা দরজায় ঝুলছে তালা। অবস্থা এমনই বেহাল যে, এ অবস্থা বেশিদিন চলতে থাকলে ভবনের ইট-সুরকিও অবশিষ্ট থাকবে না। বগুড়ার সিভিল সার্জন ডা. অর্ধেন্দু দেব জাগো নিউজকে জানান, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এখন কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর উপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সে লক্ষ্যেই নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন উদ্যোগ। তবে মাঠে পর্যায়ে সেবাসেবা দিতে দায়িত্বপ্রাপ্তরা এ ব্যাপারে কোনো গাফিলতি করলে সেই অভিযোগের ব্যপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে গ্রামাঞ্চলের ক্লিনিকগুলোর অবস্থা নজরদারি করতে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরাই ভূমিকা রাখতে পারেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।এমজেড/এমএস

Advertisement