পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে সেনা শাসনের অধীনে থাকা মিয়ানমারে এবার গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে। দেশটিতে ১৯৬০ সালের পর রোববার এই প্রথম স্বচ্ছ এবং অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে আসছেন দেশটির স্বাধীনতার জনকের কন্যা ও বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী হিসেবে পরিচিত ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রধান অং সান সু চি। মিয়ানমারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এ লড়াইয়ে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এ নেত্রীকে।রোববার মিয়ানমারের গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে ঐতিহাসিক এ নির্বাচনে ৪৯৮ আসনের বিপরীতে ছয় হাজারেরও বেশি প্রার্থী এবং ৯১ টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। দেশটির গণতন্ত্রের এ যাত্রায় সু চির এনএলডি ক্ষমতায় যাচ্ছে। তবে বর্তমান ক্ষমতাসীন সেনা সমর্থিত সরকারের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৩০ জানুয়ারি। সুতরাং সে পর্যন্ত পার্লামেন্ট গঠনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে সু চিকে।সেনাশাসনের রাহুগ্রাস থেকে বের হয়ে গণতন্ত্রের ধারায় ফিরে আসার এ পদক্ষেপে দেশটির একটি বৃহৎ অংশ নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। মিয়ানমারে ৫০ লাখ মুসলিম বসবাস করছে। যা দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪ থেকে ১০ ভাগ। ২০১১ সালের নির্বাচনে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গোষ্ঠীকে সাদা কার্ড প্রদান করে ভোট দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এবারের নির্বাচনে অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের একেবারেই নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়েছে। ফলে বার্মিজ জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিনের জাতিগত দাঙ্গার বিষয়টি নিয়ে যে এক ধরনের রাজনীতি চলছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।এসব রোহিঙ্গা ও সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কখনোই সে দেশের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। এমন কি সংখ্যালঘু এসব রোহিঙ্গা ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারে যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে নীরব ভূমিকা পালন করেছে। তবে এবারের নির্বাচনে এসব সংখ্যালঘু গোষ্ঠী সু চির এনএলডির ওপর ভরসা রেখেছেন। এখন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আশায় বুক বেঁধে আছে দেশটিতে সামরিক শাসনের অবসান হলে তারা সে দেশের নাগরিক বলে স্বীকৃতি পাবে। এখন সময়ই বলে দেবে সু চি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এ অগ্রযাত্রায় এ বিষয়গুলোকে কীভাবে সমাধান করেন।গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এ লড়াই সু চির পথ যে অনেকাংশে কঠিন হবে সে কথা বলাই যায়। কেননা দেশটির বেশ কয়েকটি অঞ্চলে এক ডজনেরও বেশি বিদ্রোহী গোষ্ঠী সরকারি বাহিনীর সঙ্গে লড়াইরত। এসব বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে একটি চুক্তিও করে দেশটি। তবে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কাচিন বিদ্রোহীরা এ চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে।বিভিন্ন সংখ্যালঘু ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীদের ওপর হামলা ও সহিংসতার ঘটনা দেশটিতে হর-হামেশাই ঘটছে। এই গোষ্ঠীগুলোকে বিদ্রোহের পথ থেকে বের করে এনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সু চিকেই কাজ করতে হবে। নতুবা সহিংসতাপ্রবণ দেশটিতে জনগণের নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত হওয়া সু চির গণতন্ত্রের যাত্রা ব্যাহত হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন। রাখাইন রাজ্যে ২০১২ সালে ধর্মীয় ও জাতিগত সহিংসতায় অন্তত দুই শতাধিক মুসলিম নিহত হয়েছে। এছাড়া গৃহহীন হয়ে পড়েছে আরো এক লাখ ২৪ হাজার।অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক দমনপীড়নের নজির রয়েছে মিয়ানমারে। ১৯৮৮ সালে দেশটিতে সামরিক জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। সে সময় সামরিক জান্তা সরকার বিক্ষোভ দমনের নামে অন্তত তিন হাজার লোককে হত্যা করে। আর এই সময়েই প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে রাজনীতির মঞ্চে আগমণ ঘটে অং সান সু চির। ১৯৬২ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর সামরিক একনায়কতন্ত্রের অধীনে ১৯৯০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় এনএলডি জয়ী হলেও ক্ষমতায় যেতে পারেনি। তৎকালীন সেনাশাসিত সরকার সু চিকে গৃহবন্দী করে। ১৯৯১ সালে গৃহবন্দী অবস্থায় শান্তিতে নোবেল পান সু চি। দীর্ঘদিন পর ২০১০ সালে গৃহবন্দী থেকে মুক্তি মেলে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী এ নেত্রী। এরপর পুনরায় দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন সু চি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে দেশের জনগণকে সচেতন করে তুলতে দেশব্যাপী প্রচারণায় অংশ নেন। সংস্কারের মাধ্যমে মিয়ানমারে রাজনৈতিক ও অর্থনীতির গতিকে চাঙ্গা করার প্রতিশ্রুতি দেন। তার এ প্রতিশ্রুতি কতটুকু বাস্তবে রূপ নেবে তা দেশটির আগামী দিনগুলোই বলে দেবে। এসআইএস/এসএইচএস/আরআইপি
Advertisement