ফিচার

শরীরের যেকোনো হাড় ভেঙে গেলে করণীয়

মানুষের শরীরের কাঠামো ২০৬টি হাড়ের মাধ্যমে তৈরি। হাড় গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ হলো প্রধানত ক্যালসিয়াম ও ফসফেট। হাড়, অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশী ইত্যাদি মিলে পূর্ণাঙ্গ মানবদেহের কাঠামো গঠিত হয়। হাড় ও অস্থিসন্ধিসমূহ একটি নির্দিষ্ট দিকে ও নির্দিষ্ট নিয়মে নড়াচড়া করতে পারে। এ নির্দিষ্ট নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলেই হাড় ভেঙে যায়। হাড়ের সবচেয়ে বাইরের আবরণটির নাম পেরিঅস্টিয়াম। এই পেরিওস্টিয়ামের আংশিক বা সম্পূর্ণ ভেঙে যাওয়াকে ফ্র্যাকচার বলে। খুব সাধারণ ভাষায় হাড় ফেটে যাওয়া বা ভেঙে যাওয়াই ফ্র্যাকচার হিসেবে পরিচিত।

Advertisement

কোনো স্থানে সরাসরি আঘাতের কারণে হাড় ভেঙে যায়। হাড়ের ওপর সরাসরি আঘাত, বুলেট ইনজুরি ইত্যাদি হয়। আবার আঘাতের স্থান থেকে বেশ দূরেও হাড় ভেঙে যেতে পারে। এরকম ইনজুরি হলো পরোক্ষ আঘাত। যেমন- বাইরের দিকে হাত ছড়িয়ে পড়ে গেলে কলার বোন ভেঙে যেতে পারে। আবার শক্তিশালী মাংসপেশীর তীব্র ও মারাত্মক সংকোচন ক্রিয়ার জন্যও হাড় ভেঙে যেতে পারে। যেমন- প্রচণ্ড কাশির কারণে পাঁজরের হাড় ভেঙে যেতে পারে।

আঘাতের ফলে হাড়ের সাথে সাথে শরীরে কী কী ধরনের ক্ষতি হয়- তার ওপর ভিত্তি করে হাড় ভাঙার প্রকারভেদ নির্ণয় করা হয়। যেমন- শুধু হাড় ভাঙা এবং শরীরের অন্য কোনো অংশে কোনো ক্ষতির অনুপস্থিতি অথবা হাড় ভাঙার সাথে সাথে শরীরে বাহ্যিক ক্ষত হওয়া। আবার হাড় ভেঙে অভ্যন্তরীণ কোনো অঙ্গের, যেমন- ফুসফুস, মেরুদণ্ড বা মস্তিষ্কের ক্ষতি সাধন, একটি হাড়ের একাধিক জায়গায় ভাঙন, হাড় ভেঙে এর একাংশ অন্য অংশের ভেতর প্রবেশ, হাড় সম্পূর্ণ না ভেঙে বেঁকে এবং সামান্য ফেটে যাওয়া, মাথার খুলি ভেঙে ভেতরের দিকে বসে যাওয়া ইত্যাদিও বিভিন্ন ধরনের হাড় ভাঙার উদাহরণ।

হাড় ভাঙার লক্ষণ: নিচে হাড় ভাঙার লক্ষণসমূহ উল্লেখ করা হলো– ১. ভাঙা জায়গায় ও এর আশেপাশের স্থানে ভীষণ ব্যথা হবে। এমন ব্যথা যে রোগী ভাঙা জায়গা স্পর্শ করতেও পারবে না। কারণ আক্রান্ত স্থানে চাপ দিলে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূত হয়।

Advertisement

২. ভাঙা জায়গা ফুলে যাবে এবং অস্বাভাবিক আকার ধারণ করবে। অনেক সময় একটি হাড় ভেঙে আরেকটি অংশের উপর উঠে গেলে জায়গাটা ফুলে যায় এবং অঙ্গের আকৃতি অপেক্ষাকৃত ছোট দেখা যায়।

৩. যে স্থানে হাড় ভেঙে যায়, সে স্থান তার স্বাভাবিক সঞ্চালন ক্ষমতা হারায় এবং ভাঙা অঙ্গের স্বাভাবিক শক্তি লোপ পায়।

হাড় ভাঙার ক্ষেত্রে কিছু সাবধানতা–১. যেকোনো প্রকার নড়াচাড়ার আগে রোগী ভাঙা জায়গা যেন না নাড়াতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। সম্ভব হলে লাঠি বা শক্ত কিছু দিয়ে বাঁধার ব্যবস্থা করতে হবে, যেন ভাঙা অংশে কোনো নড়াচাড়া না হয়। এতে স্থানটি আবার আঘাত পাওয়া থেকে রক্ষা পাবে। শুধু তা-ই নয়, এতে হাড়ের ভাঙাপ্রান্ত, রক্তনালী, স্নায়ু বা মাংসপেশীকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না। তবে বাঁধন দেওয়ার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন রক্ত সঞ্চালন বন্ধ না হয়ে যায়। ফ্র্যাকচার স্থির করা যায় ব্যান্ডেজ কিংবা স্প্লিন্টের মাধ্যমে।

স্বাভাবিক ক্ষেত্রে সাধারণ ব্যান্ডেজই যথেষ্ট। কিন্তু অঙ্গবিকৃতি ঘটলে বা দুর্ঘটনা ঘটলে রোগীকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য, বিশেষ করে রোগীর হাতে ও পায়ে স্প্লিন্ট বেঁধে দিতে হবে, যাতে স্থানটি নড়াচড়া থেকে বিরত থাকে। সতর্ক থাকতে হবে যেন কখনোই ফ্র্যাকচারের ঠিক ওপরের স্থানে ব্যান্ডেজ না বাঁধা হয়। আবার স্প্লিন্ট এমন লম্বা হতে হবে, যাতে অস্থিসন্ধির ওপরের ও ফ্র্যাকচারের নিচের অংশকে নিশ্চল রাখতে পারে। স্প্লিন্ট ভালো প্যাডযুক্ত হতে হবে, যাতে হাত বা পায়ের সাথে ঠিকমতো খাপ খায়। এটি পর্যাপ্ত চওড়া হবে। জরুরি ক্ষেত্রে স্প্লিন্ট হিসেবে হাঁটার জন্য ব্যবহৃত লাঠি, কাঠের টুকরো কিংবা হার্ডবোর্ডের টুকরোও ব্যবহার করা যেতে পারে।

Advertisement

২. বাহ্যিক ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হলে তা বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে।

৩. খেয়াল রাখতে হবে যেন রোগী আরামদায়ক অবস্থায় থাকতে পারেন। ব্যথার মধ্যে রোগীকে যতটা সম্ভব স্বস্তি দেওয়া যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। সম্ভব হলে ভাঙা জায়গায় বরফ দেওয়া যেতে পারে, তাতে ক্ষতস্থান অবশ হয়ে ব্যথা কিছুটা কমতে পারে।

৪. আঘাতজনিত কারণে রোগী বমি করে ফেললে, যতটা সম্ভব কম নড়াচাড়া করে রোগীকে বাম কাত করে বমি করানোর ব্যবস্থা করুন। অন্যথায় পাকস্থলি থেকে উঠে আসা এসব অর্ধপাচ্য খাবার ফুসফুসে চলে গেলে অবস্থা আরও জটিল হয়ে যেতে পারে।

৫. রোগী অচেতন থাকলে শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন পরীক্ষা করে দেখে রোগীকে প্রয়োজনে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস ও বুকে চাপ দিয়ে সিপিআর দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।

৬. রোগী সচেতন থাকলে তিনি প্রচণ্ড ব্যথার মধ্যে থাকবেন। তাই রোগীকে মানসিকভাবে শক্ত রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। রোগীকে আশ্বস্ত করুন ও ধৈর্য ধারনের মাধ্যমে অহেতুক তীব্র দুশ্চিন্তা থেকে রোগীকে বিরত রাখুন।

মাথার খুলির হাড় ভেঙে গেলে: রোগীর মাথা ও কাঁধ সামান্য উঁচু করে রোগীকে শুইয়ে রাখবেন। রোগীকে কোনো ধরনের নড়াচাড়া করা থেকে বিরত থাকুন। যদি স্থানান্তর করতে হয়, তবে অনেক সাবধানে দুই হাত দিয়ে রোগীর মাথা স্থির রেখে অবলম্বন ব্যবহার করে স্থানান্তর করুন। শরীরের কাপড় আলগা করে দিন, এতে ব্যর্থ হলে প্রয়োজনে কিছু দিয়ে কাপড় কেটে ফেলুন। রোগীর তাপমাত্রা ঠিক রাখতে চেষ্টা করুন। দরকার হলে হাতের তালুতে ও পায়ের তলায় গরম সেঁক দিতে পারেন। মাথায় কিছু প্রবেশ করে মাথার ভেতরেই থেকে গেলে কোনক্রমেই তা বের করার চেষ্টা করবেন না। সামান্য এদিক সেদিক হলে রোগীর অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। কোনো অবস্থায়ই রোগীকে পানি পান করতে বা কোনো কিছু খেতে দিবেন না। তাঁকে দ্রুত প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত সদর হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।

মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গেলে: মেরুদণ্ডের ঘাড়ের দিকের অংশ ভেঙে গেলে রোগী জ্ঞান হারাতে পারেন। এ অবস্থায় রোগী যেন শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে যেতে পারেন সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দিতে হলে কোনক্রমেই রোগীর মাথা ও ঘাড় নাড়াচাড়া করা যাবে না। আঙুল দিয়ে আলতো করে নিচের চোয়াল আলগা করে কৃত্রিম শ্বাসের ব্যবস্থা করতে হবে। বমির কারণে রোগীকে বামপাশে কাত করতে হলে একাধিক জন মিলে একসাথে রোগীকে সাবধানে সামান্য কাত করতে পারেন। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যেন মাথা, ঘাড় আর মেরুদণ্ড একই কলামে থাকে। রোগীকে স্থানান্তর করতে হলে অবশ্যই চিৎ করে শোয়াতে হবে। এজন্য স্ট্রেচার আবশ্যক। স্ট্রেচার না পাওয়া গেলে শক্ত বড় কাঠের তক্তা বা এই জাতীয় জিনিস ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে কোনো অবস্থায়ই বেশি নাড়াচাড়া করা যাবে না। মেরুদণ্ড স্বাভাবিক অবস্থায় রাখতে পিঠের নিচে কিছু অংশে বালিশ জাতীয় নরম কিছু দিয়ে ঠেস দিয়ে রাখা যেতে পারে। পাশাপাশি কোনো অবস্থায়ই মেরুদণ্ডে যেন টান না লাগে, সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মাথা ও ঘাড় যেন কোনোভাবে না নড়ে যায়, সেজন্য সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

কলার বোন ভেঙে গেলে: আমাদের কাঁধের কাছে এ অস্থির অবস্থান। যা হাতের ওজনকে কেন্দ্রীয় কঙ্কালে সঞ্চালন করতে সাহায্য করে। হাড়টি কোনো কারণে ভেঙে গেলে ভাঙা হাড়ের দিকের বগলে নরম কাপড় বা প্যাড দিয়ে ঊর্ধ্ববাহুকে স্বাভাবিক অবস্থায় এনে মোটা ব্যান্ডেজের সাহায্যে বেঁধে দিতে হবে। তারপর নিম্নবাহু বুকের উপর রেখে আরেকটি কাপড়ের সাহায্যে সুস্থ হাতের দিকে কাঁধের উপর বেঁধে দিতে হবে, যেন তা নাড়াচাড়া না করতে পারে। এছাড়া ‘কলার অ্যান্ড কাফ স্লিং’ও ব্যবহার করতে পারেন। এতে ভাঙা স্থানও স্বাভাবিক অবস্থানে থাকবে।

ঊর্ধ্ববাহু ভেঙে গেলে: আহত হাতের নিম্নবাহু ভাঁজ করে এমনভাবে রাখতে হবে, যেন আঙুল কাঁধ স্পর্শ করে। সম্ভব হলে হাত ও বুকের মাঝখানে একটি নরম কাপড় বা প্যাড দেওয়া যেতে পারে। এবার হাতটি গলার সাথে মোটা ব্যান্ডেজের সাহায্যে ঝুলিয়ে দিতে হবে। একটি ঊর্ধ্ববাহুর দৈর্ঘের সমান সোজা লাঠির সাথে ভাঙা হাত ও শরীর ব্যান্ডেজের সাহায্যে পেঁচিয়ে দিন, একটি কাঁধের নিচ দিয়ে, আরেকটি কনুইয়ের উপর দিয়ে। যদি একাধিক স্থানে হাড় ভাঙা থাকে এবং হাত ভাঁজ না করা যায়, তবে হাত সোজা করে শরীরের পাশে নিয়ে ব্যান্ডেজ দিয়ে শরীর ও বাহু জড়িয়ে, শরীর ও কনুই জড়িয়ে এবং কব্জি ও উরু জড়িয়ে রাখতে হবে।

নিম্নবাহু ভেঙে গেলে: কনুই ভাঁজ করার মাধ্যমে ঊর্ধ্ববাহুর সাথে সমকোণ তৈরি করে রোগীর নিম্নবাহু এমনভাবে রাখুন যেন হাতের তালু শরীরের দিকে আর বুড়া আঙুল উপরের দিকে থাকে। এরপর দুটি শক্ত কাঠি ব্যবহার করে ব্যান্ডেজের সাহায্যে রোগীর নিম্নবাহু পেঁচিয়ে ফেলুন, যেন হাড় ঠিক স্থানে সোজা হয়ে থাকে। শেষে রোগীর হাত একটি কাপড়ের সাহায্যে গলার সাথে ঝুলিয়ে দিন।

হাঁটু বা পায়ের অন্য কোথাও ভেঙে গেলে: প্রথমে রোগীকে চিৎ করে শুইয়ে দিন। ভাঙা পায়ের নিচে বা দুই পাশে, পায়ের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটি লম্বা কাঠের তক্তা বা সোজা লাঠি রেখে ব্যান্ডেজের সাহায্যে উরুতে একটি বাঁধন এবং গোড়ালি ও পায়ের পাতাজুড়ে একটি বাঁধন দিন। এরপর পা স্থির রাখার জন্য যতটা প্রয়োজন, পায়ের বাকি অংশে ততটা বাঁধ দিন। ভাঙা স্থানের কাছে বাঁধার সময় সাবধানতা অবলম্বন করুন। হাঁটু ভেঙে গেলে হাঁটুর ঠিক উপরে একটি ব্যান্ডেজের মধ্যভাগ রেখে তা পেঁচিয়ে হাঁটুর ঠিক নিচে এসে গিঁট দিন। তক্তা ও পায়ের মাঝে প্রয়োজনমত প্যাড বা নরম কাপড় ব্যবহার করুন। সব অবস্থায়ই যেন রোগীর ভাঙা পা একটু উঁচু করে রাখা যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

পায়ের পাতা ভেঙে গেলে: প্রথমে গোড়ালি থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত দীর্ঘ একটি কাঠের তক্তা নিন। এরপর ব্যান্ডেজের সাহায্যে তক্তাটিকে পায়ের সাথে ভালোভাবে বাঁধুন। এবার আরেকটি ব্যান্ডেজের সাহায্যে পায়ের গোড়ালিসহ পায়ের পাতা পেঁচিয়ে ফেলুন। খেয়াল রাখতে হবে, পা সব সময় যেন একটু উঁচুতে থাকে।

হাড় ভাঙা ছাড়াও অস্থিসন্ধির স্থানচ্যুতি এবং হাত-পা মচকে যাওয়া প্রাত্যহিক জীবনে সাধারণ ঘটনা। একটি হাড় আরেকটি হাড়ের সাথে যেখানে সংযুক্ত হয়েছে তাকে অস্থিসন্ধি বলে। অনেক সময় আঘাত পেলে বা হঠাৎ টান পড়লে হাড় তার অস্থিসন্ধি থেকে ছুটে যেতে পারে। এ অবস্থায় যথেচ্ছ টানাটানি করে হাড়কে পূর্বাবস্থানে আনার চেষ্টা না করে যেভাবে রোগী আরাম পায় সেভাবে তাকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আর কোথাও মচকে গেলে ওই মচকানো জায়গা নাড়াচাড়া না করে যতটা সম্ভব আরামদায়ক অবস্থায় রাখা যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। মচকানো জায়গায় বরফ দেওয়া যেতে পারে। সম্ভব হলে ক্রেপ ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে দেওয়া যায়। এতে মচকে যাওয়া স্থানে নাড়াচাড়া কম হবে এবং ওই স্থানে পরবর্তী কোনো আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনাও কমে যাবে।

এসইউ/জেআইএম