বিশেষ প্রতিবেদন

মাজারের গানেও পুলিশের ভাগ

রাত গভীর হলেই পুলিশের আনাগোনা বেড়ে যায়। থানার ওসিরা (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) আস্তানার সামনের সারিতে এসে বসেন। গান চলে তাদের পছন্দে। আস্তানা থেকে বাইরে যেতেই দালালের মাধ্যমে ওসিকে টাকা দিতে হয়। ওসি সন্তুষ্ট হলেই গান চলে, নইলে বন্ধ। রাজধানীর মিরপুর মাজার এবং মাজার সংলগ্ন গানের আস্তানাগুলো এখন পুলিশের দখলে।হযরত শাহ আলী বোগদাদী (র.)-এর মাজার এবং এর আশেপাশে গানের আস্তানা থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। রাত জেগে গান গেয়ে শিল্পীদের ভক্তকূলের কাছ থেকে পাওয়া বকশিসে ভাগ বসাচ্ছেন শাহ আলী, দারুস সালাম থানার পুলিশ। অভিযোগ উঠেছে মিরপুর এলাকার পুলিশের উপ-কমিশনারের বিরুদ্ধেও। পুলিশকে চাঁদা দিলেই এখানে গান হয়, না দিলেই বন্ধ। এ নিয়ে শিল্পী, আয়োজক এবং গানের ভক্তদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তবে মিরপুর পুলিশের উপ-কমিশনার, শাহ আলী থানা এবং দারুস সালাম থানা কর্তৃপক্ষ চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।  মিরপুর শাহ আলী মাজার সংলগ্ন বাউল গানের ঐতিহ্য অনেক দিনের পুরনো। বাংলাদেশে মূলধারার বাউল শিল্পীদের অনেকেই এই মাজারে গান করেছেন। শাহ আলী মাজারকে বাউল গানের শিক্ষা কেন্দ্রও বলা হয়। মাজারের সঙ্গেই শাহ আলী মার্কেটে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দুটি বাউল সমিতির কার্যালয়ও রয়েছে। বাউল গান, পালা, মুর্শিদি, বিচ্ছেদ, ভক্তিমূলক অর্থাৎ বৈঠকী গানে জুড়ি নেই শাহ আলী মাজারের। কিন্তু সম্প্রতি পুলিশের পক্ষ থেকে চাঁদাবাজিসহ নানা হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শাহ আলী দরবারে মাজারি গানের আসর। গত বৃহস্পতিবার রাতেও চলমান গান হঠাৎ বন্ধ করে দেয় পুলিশ। দীর্ঘদিন থেকেই প্রতি বৃহস্পতিবার শাহ আলী মাজারে বাউল গানের আয়োজন বসে। সাপ্তাহিক গানের আয়োজন চলে সারা বছর ধরেই। শীত মৌসুমে প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি গানের আস্তানা বসে মাজারের পশ্চিম পাশের খোলা জায়গায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিশেষ করে নারী শিল্পীরা এসব আস্তানায় বাউল গান পরিবেশন করে আসছেন। গান গেয়ে শিল্পীরা যে বকশিস পান, তার অর্ধেক টাকা নিয়ে থাকেন আয়োজকরা। অভিযোগ রয়েছে, সম্প্রতি মাজার কর্তৃপক্ষের যোগসাজসে প্রতিটি আস্তানা থেকে দুই-আড়াই হাজার টাকা মাজার কর্তৃপক্ষকে চাঁদা দিতে হয় গানের আয়োজকদের। আর পুলিশকে চাঁদা দেয়ার কথা বলে আয়োজকরা পুরো টাকাই আদায় করে থাকেন শিল্পীদের কাছ থেকে। চাঁদার টাকা না দিলেই আস্তানা বন্ধ।  আরো অভিযোগ রয়েছে, সম্প্রতি চাঁদার পরিমাণ বাড়াতেই নানা অজুহাতে গান বন্ধ করে দেয় পুলিশ। গত দুই মাসে বেশ কয়েকবার গান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে রিতা নামের এক শিল্পী অভিযোগ করেন।  তিনি বলেন, ‘পুলিশ নানা কারণেই হয়রানি করছে। গান গাইলেই মাজার কর্তৃপক্ষ পুলিশের কথা বলে আমাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করছেন। টাকা না দিলে মাজারে আর ওই শিল্পীর গান গাওয়া হয় না।’ মাজারে গানের আস্তানা দেন হোসেন নামের এক বাউল শিল্পী। তিনি নিজেও গান করেন। হোসেন বলেন, ‘পুলিশ অন্য ফন্দি এঁটে আমাদের গান বন্ধ করে দিচ্ছে। মাজারে গান বন্ধ করে দিলেও পুলিশের তত্ত্বাবধানে অসাধু লোক মাজারের আশেপাশে স্টুডিও বা ঘর ভাড়া করে গানের আসর দিচ্ছেন। ওই সব গানের আসর থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পেয়ে থাকে পুলিশ প্রশাসন। ওই আসরগুলোতে বাউল গানের নামে বেহায়াপনাই বেশি হয়। সরেজমিনে গিয়ে অভিযোগের সত্যতাও মেলে। মাজারের সামনে বড় একটি টিনের ঘর লিটন নামের এক ব্যক্তির। পুলিশের সহায়তায় প্রতিদিন সেখানে গানের আয়োজন করা হয়। বাউল, মুর্শিদি গানের আয়োজনের কথা বলা হলেও সেখানে বাউল গানের লেশমাত্র থাকছে না। চলে শিল্পীদের নৃত্যের সঙ্গে ভক্তদের প্রকাশ্যে মদ্যপান। মদ্যপানে শরিক হন পুলিশ সদস্যরাও। গানের আসরে শাহ আলম, মামুন নামের দুই পুলিশ সদস্যের মদ্যপানের কথা সবারই জানা। শাহ আলী থানা এবং দারুস সালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদেরও (ওসি) প্রায়ই এসব আস্তানায় দেখা যায়। মূলত বিশেষ সুবিধা পেতেই ওসিরা এসব আস্তানায় উপস্থিত হন বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এসব চাঁদাবাজির মধ্যস্থতায় থাকেন সালাম নামের এক পুলিশ সদস্য।  মাজারের পাশে লিটনের স্টুডিও, সেন্টুর স্টুডিও, আনিসের স্টুডিও, কল্যাণপুরের বেঙ্গল স্টুডিওগুলো এখন রঙ্গমহল নামে পরিচিতি পেয়েছে। অনেকেই আবার এগুলোকে বাইজিখানাও বলে থাকেন। শিল্পী, আয়োজক এবং পুলিশের ত্রিমুখী ফাঁদে পড়ে শত শত ভক্ত নিঃস্ব হচ্ছেন। তাল, লয় ছাড়া নামে মাত্র গান গেয়ে শিল্পীদের অনেকেই ভক্তদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলে প্রতি রাতে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। আর এসবই হচ্ছে পুলিশ প্রশাসন এবং আয়োজকবৃন্দের যোগসাজশে। খোদ পুলিশ সদস্যদেরও কারো কারো বিরুদ্ধে এমন অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে।  গত ৩১ অক্টোবর সোহাগী সরকার নামের এক শিল্পী তার জন্মদিন উপলক্ষে ঘরোয়া পরিবেশে একটি কমিনিউটি সেন্টারে গানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠান চলাকালে হঠাৎ পুলিশ গিয়ে হানা দেয় সেখানে। পুলিশকে না জানিয়ে জন্মদিনের আয়োজন করা হয়েছে এমন অপরাধে শিল্পী সোহাগীর স্বামী মানিককে আটক করে নিয়ে যায় শাহ আলী থানা পুলিশ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিল্পী বলেন, ‘পুলিশের ঝামেলার কারণে ওইসব স্টুডিওতে আর গান করতে যাই না। লজ্জাও লাগে। নর্তকীর নাচ আর বাউল গান এক বিষয় নয়। ওইসব স্টুডিওতে যা হয়, তার চেয়ে নতর্কীর নাচও অনেক ভালো। গান গাইলেই কুপ্রস্তাব শুনতে হয়। কুপ্রস্তাব দেয় পুলিশও। গান গাওয়াই বাদ দিয়েছি।’ পুলিশের পক্ষ থেকে চাঁদাবাজির কথা অস্বীকার করে দারুস সালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সেলিমুজ্জামান বলেন, ‘ওসব দেখার সময় নেই। মাজার আমার এলাকার মধ্যে পড়ে না। সুতরাং গানের আস্তানার দায় আমার নয়। তবে আমার এলাকায় বেঙ্গল স্টুডিও’র গান চলতো। তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।’ তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কল্যাণপুরের স্টুডিওতে গানের আস্তানা এখনও বসছে। আকবার নামের এক আয়োজক ওসি সেলিমুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করেই নিয়মিত আস্তানা দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।  এ ব্যাপারে শাহ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম শাহীন মণ্ডল জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভাই আমি নিজেও গানের ভক্ত। গান শুনতে হলে তো মঞ্চ বা স্টুডিও’তে যেতেই হয়। তবে আমি টাকা নিই না। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা মিথ্যে’। টাকার বিনিময়ে স্টুডিও বসানোর ক্ষেত্রে সরাসরি অভিযোগ মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. কাইয়ুমুজ্জামান খানের বিরুদ্ধেও। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘নাউযুবিল্লাহ, নাউযুবিল্লাহ। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ নাউযুবিল্লাহ। যেসব স্টুডিও মাজারের বাইরে বসতো এর অধিকাংশই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাকিগুলোও বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’আর ওসি কিংবা পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে বলে জানান তিনি।এএসএস/জেইউ/এসএইচএস/আরআইপি

Advertisement