আন্তর্জাতিক

আশা-নিরাশার দোলাচলে নতুন করোনা ভ্যাকসিন

১৯৫৪ সালে হামের ভাইরাস চিহ্নিত হওয়ার পর ভ্যাকসিনের অনুমোদন পেতে সময় লেগেছিল নয় বছর। পোলিও ভ্যাকসিনের প্রাথমিক ট্রায়াল শুরু থেকে ১৯৫৫ সালে অনুমোদনপ্রাপ্তির মধ্যে সময় গেছে ২০ বছর। আশ্চর্যজনকভাবে মাত্র একবছরের মধ্যেই সার্স-কভ-২ বা নভেল করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির দ্বারপ্রান্তে বিশ্ব।

Advertisement

অন্যগুলোর কথা বাদ। ফাইজার ও বায়োএনটেকের তথ্যমতে, তাদের তৈরি ভ্যাকসিন আপনার করোনায় ভোগার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ কমিয়ে দেবে; যা হামের ভ্যাকসিনের প্রায় সমান এবং ফ্লু ভ্যাকসিনের (৪০-৬০ শতাংশ) চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর। ফলে অনেকটা হঠাৎ করেই অন্ধকারে দেখা দিয়েছে নতুন আশার আলো।

গত ৯ নভেম্বর ফাইজারের ভ্যাকসিনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর শেয়ারবাজারের ক্ষ্যাপা ষাঁড় ছুটতে শুরু করেছে। বেশিরভাগ ধনী দেশের জোট ওইসিডির ধারণা, করোনার ভ্যাকসিন থাকলে ২০২১ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হবে সাত শতাংশ, আর ভ্যাকসিন না থাকলে প্রবৃদ্ধি থাকবে এর চেয়ে দুই শতাংশ কম।

খুশি হওয়ার আরও কারণ রয়েছে। ফাইজারের ফলাফলে আশা জাগাচ্ছে অন্য ভ্যাকসিনগুলোও। বর্তমানে ৩২০টিরও বেশি সম্ভাব্য করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চলছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর্যায়ে রয়েছে। সেক্ষেত্রে ফাইজারের ভ্যাকসিনে যদি কাজ হয়, সম্ভবত বাকিগুলোতেও হবে।

Advertisement

জীববিজ্ঞান কতদূর এগিয়েছে, কত কার্যকরভাবে তা জৈবরাসায়নিক সরঞ্জাম তৈরি করে মানুষের উপকার করতে পারে তা নিয়ে উল্লাস হতেই পারে। এই জ্ঞানের অপব্যবহারের বিষয়ে আপাতত দুশ্চিন্তা না-ই বা করলাম।

শুধু এসবই নয়, করোনা ভ্যাকসিন তৈরিতে বৈশ্বিক প্রচেষ্টাও উদযাপন করা উচিত। এখানে মানুষের উপকারে একসঙ্গে কাজে নেমেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজন। ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাকসিনের কথাই ধরুন! তুর্কি অভিবাসীর হাতে গড়া একটি জার্মান প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন তৈরিতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে একটি মার্কিন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, যার প্রধান আবার এক গ্রিক নাগরিক।

ফাইজারের ভ্যাকসিন নিয়ে এত এত ভালো খবরের মধ্যেও উঁকি দিচ্ছে দু’টি বড় প্রশ্ন- ভ্যাকসিনটির বৈশিষ্ট্য কী আর কত দ্রুত এটি বিতরণ করা যাবে? এর কার্যকারিতার বিষয়ে দেয়া তথ্য প্রাথমিক ফলাফল মাত্র। চূড়ান্ত সন্তুষ্টির জন্য সম্পূর্ণ ট্রায়াল শেষ হওয়ার পর বাকি প্রশ্নের উত্তর আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

ভ্যাকসিনটি গুরুতর উপসর্গ সারাতে পারবে নাকি শুধু হালকা অসুখ? এটি বয়স্কদের সুরক্ষা দিতে পারবে তো? তাছাড়া, কতদিন থাকবে এই ভ্যাকসিনের সুরক্ষা, তা বলারও সময় আসেনি এখনও।

Advertisement

নিশ্চয়তার জন্য সময় লাগে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হয়তো ট্রায়ালে এটিকে নিরাপদ ঘোষণা করা হবে। তবে এরপরও গভীর পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।

ফাইজার-বায়োএনটেকের বিশ্বাস, করোনাভাইরাস থেকে অন্তত এক বছর সুরক্ষা দেবে তাদের ভ্যাকসিন। আর ৯০ শতাংশ কার্যকারিতার হার এত বেশি যে, সেটি সব বয়সের মানুষকেই কিছুটা হলেও সুরক্ষা দেয়ার কথা!

তবে বিশ্ব যখন তথ্যের জন্য অপেক্ষা করছে, তখন এরচেয়েও বড় চিন্তা জাগাচ্ছে বিতরণ ব্যবস্থা। আগামী বছরের বেশিরভাগ সময় ভ্যাকসিন সরবরাহে ঘাটতি থাকবে।

ফাইজার জানিয়েছে, তারা ২০২০ সালেই পাঁচ কোটি এবং আগামী বছর ১৩০ কোটি ডোজ তৈরি করতে পারবে। সংখ্যাটি হয়তো অনেক বেশিই মনে হচ্ছে। তবে করোনা থেকে সুরক্ষা পেতে তাদের ভ্যাকসিনের দু’টি ডোজ দরকার। তাছাড়া, এক যুক্তরাষ্ট্রই প্রাথমিকভাবে দুই কোটি ডোজের চুক্তি করে রেখেছে।

এর আগে কখনোই গোটা বিশ্ব একসঙ্গে ভ্যাকসিন গ্রহণের প্রয়োজন অনুভব করেনি। ফলে ভ্যাকসিন আসার পরপরই সিরিঞ্জ, মেডিক্যাল গ্লাস, দক্ষ কর্মীর সংকট দেখা দিতে পারে।

সবচেয়ে বেশি যেটা ভাবাচ্ছে তা হলো- ফাইজারের ভ্যাকসিন মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হবে, যা স্থানীয় কেমিস্টদের পক্ষে হয়তো সম্ভব নয়। তাছাড়া, ভ্যাকসিনের একেকটি ব্যাচে থাকবে অন্তত ৯৭৫টি ডোজ। অর্থাৎ, একসঙ্গে এতজন মানুষকে প্রথম ডোজ নিতে জড়ো করতে হবে। ২১ দিন পর তাদের আবারও ডাকতে হবে দ্বিতীয় ডোজের জন্য। ফলে, শেষপর্যন্ত কত ডোজ নষ্ট হবে তা এখনই বলা কঠিন।

এখনই যেহেতু ভ্যাকসিনের সংকট বোঝা যাচ্ছে, সেকারণে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে সরকারগুলোকেই। ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় ভ্যাকসিন পৌঁছানোর ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।

সাম্প্রতিক এক মডেলে দেখানো হয়েছে, যদি বিশ্বের ৫০টি ধনী দেশ ৮০ শতাংশ কার্যকর ভ্যাকসিনের ২০০ কোটি ডোজ গ্রহণ করে, তাহলে করোনায় বৈশ্বিক মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশ কম হতে পারে। তবে ভ্যাকসনটি যদি ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব দেশের জনসংখ্যার ভিত্তিতে বণ্টন করা হয়, তবে আগের চেয়ে দ্বিগুণ মৃত্যু আটকানো সম্ভব।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আগামী কয়েকমাস কঠিন হবে। কিছুদিন আগে এর মৃত্যুহার এপ্রিলের ভয়াবহ হিসাবকে ছাড়িয়ে গেছে। দেশগুলো ভ্যাকসিন প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ধনী দেশ, তাদের ওষুধপত্রও বিশ্বমানের; তারপরও দেশটি মহামারি মোকাবিলায় ব্যর্থ হচ্ছে। ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে সেখানে অপ্রয়োজনীয় ঝঞ্ঝাট এবং বিলম্ব সৃষ্টি হতে পারে। ভ্যাকসিন হাতে পেয়েও জীবন নিয়ে খেলা খুবই নিষ্ঠুর বিষয় হবে। ভাইরাসের হাত থেকে মুক্তি দিতে বিজ্ঞান তার কাজটুকু করছে, এখন বাকি দায়িত্ব সমাজের।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

কেএএ/জেআইএম