বিনোদন

হ‌ুমায়ূন আহমেদের নাটকে মুসলিম রীতি-নীতি

বাংলা সাহিত্যের বিস্ময় হ‌ুমায়ূন আহমেদ। উপন্যাস থেকে শুরু করে নাটক-সিনেমায় বিস্মিত করেছেন আমাদের। যে বিস্ময়ের অন্ত নেই। এমনকি তুলনাও করা চলে না। এই বিস্ময়মানব সফল হয়েছেন তার সব ধরনের নির্মাণে। একজন সফল নাট্যকার ও পরিচালক হিসেবেও তিনি অগ্রগণ্য। এ যাবতকালে টেলিভিশনের জন্য যত নাটক নির্মিত হয়েছে; তার মধ্যে প্রথম সারিতেই থাকবেন তিনি। তাকে অতিক্রম করার মতো নাট্যকার এবং নির্মাতা এখনো জন্মগ্রহণ করেননি।

Advertisement

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, টেলিভিশনের জন্য হ‌ুমায়ূন আহমেদের প্রথম কাজ হলো টেলিভিশন নাটক ‘প্রথম প্রহর’। এটি ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। নাটকটি পরিচালনা করেন নওয়াজিশ আলি খান। একমাত্র টেলিভিশন হিসেবে তখন হ‌ুমায়ূন আহমেদের নাটক দিয়ে দর্শক টানতে সক্ষম হয়েছিল বিটিভি। যার উদাহরণ ‘কোথাও কেউ নেই’। তিনি বহু টেলিভিশন নাটক লিখেছেন। এমনকি নিজেও নির্দেশনা দিয়েছেন অনেক নাটকের।

তার সাড়া জাগানো নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘অয়োময়’ ও ‘আজ রবিবার’ ইত্যাদি। এই ধারাবাহিক নাটকগুলোর বাইরেও বহু খণ্ড নাটক নির্মাণ করেছেন হ‌ুমায়ূন আহমেদ। তার নাটকগুলো আলাদা গল্পের, আলাদা ধাচের, আলাদা স্বাদের। সেই স্বাদকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে তার নাটকে উপস্থাপিত ‘মুসলিম রীতি-নীতি’র বিষয়গুলো। আমরা বরাবরই বাংলাদেশের সিনেমা-নাটকে ইসলাম ধর্মের বিষয়কে খুব বেশি উপস্থাপন করতে দেখি না। তবে হ‌ুমায়ূন আহমেদ এ যাত্রায় সফল হয়েছেন।

তার ‘তিন প্রহর’ নাটকে আমরা দেখেছি, ডান পা ফেলে যাত্রা শুরু করা, কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা, কোরআন ছুঁয়ে আশির্বাদ নেওয়া, দাফনের আগে কোরআন তেলাওয়াত, আল্লাহর কসম বলা, শোকরানা নামাজ, বিপদে কালেমা পড়া, মিলাদ পড়া, কবর বন্ধ করার নিয়ম এবং আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করার বিষয়গুলো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। মূলত মুসলিম পরিবারগুলোতে যেসব রীতি-নীতি সচরাচর পালিত হয়ে থাকে।

Advertisement

‘কোথাও কেউ নেই’ হ‌ুমায়ূন আহমেদের বহুল আলোচিত ও দর্শক নন্দিত নাটক। এই নাটকেও ঘটনা প্রসঙ্গে হাদিস বলতে শোনা যায়। নাটকে বলা হয়, ‘মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না।’ এমন অনেক নির্দেশনাও তার নাটকে ফুটে ওঠে। এছাড়া মুনার মামা দুর্নীতি মামালায় গ্রেফতার হওয়ার পর চরিত্রের মুখ দিয়ে হ‌ুমায়ূন আহমেদ বলিয়েছেন, ‘বিপদ দিয়ে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন।’ কিংবা ‘আল্লাহ পাক দেখবেন’। এমনকি একই নাটকে অন্যদের নামাজ পড়ানোর তাগিদও দেওয়া হয়েছে। যে কাজগুলো মুসলিম পরিবারে হরহামেশাই করা হয়ে থাকে।

‘এই বরষায়’ নাটকে পাত্রপক্ষ কনের কাছে জানতে চায়, ‘পাক কোরআনে সুরা কয়টি?’ ‘তুমি কি নামাজ পড়?’ এছাড়া বেতরের নামাজের নিয়ত জানে কি-না, তা-ও জানতে চায় পাত্রপক্ষ। ‘সমুদ্র বিলাস প্রাইভেট লিমিটেড’ নাটকে যাত্রা শুরুর দোয়া পড়তে শোনা যায়। ‘আজ জরির বিয়ে’ নাটকে ফিসফাস করে কথা বলা প্রসঙ্গে সুরা মুজদালাফার সাত নম্বর আয়াত উল্লেখ করা হয়। এমনকি ‘ইনশাআল্লাহ’ বলার তাগিদ দেওয়া হয়। এ সবই মুসলমানদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে আছে। ফলে হ‌ুমায়ূন আহমেদ তার চরিত্রগুলোও সেভাবে নির্মাণ করেছেন। যাতে ওই চরিত্রকে সমাজবিচ্ছিন্ন কোনো মানব মনে না হয়।

‘অচিন রাগিনী’ নাটকে সম্পত্তি সম্পর্কে কোরআনের আয়াত উল্লেখ করা হয়। ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’ নাটকে গানের দল বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে দলনেতা বলেন, ‘ইয়া মুকাদ্দিমু বলে ডান পা আগে বাড়াও।’ ‘হাবিবের সংসার’ নাটকে নামাজ পড়া, স্বপ্নে আল্লাহকে দেখা, ঘর তোলার জন্য মিলাদ ও দোয়ার প্রসঙ্গ এসেছে। এসব ঘটনা আমরা কখনোই অস্বীকার করতে পারি না। এমন ঘটনা আমাদের চোখের সামনে অহরহই ঘটে থাকে। মানুষ ধর্মীয় অনুভূতি থেকেই এমন রীতি-নীতি পালন করে থাকে। ফলে সঙ্গতকারণেই বিষয়গুলোকে তিনি এড়িতে যাননি।

হ‌ুমায়ূন আহমেদ তার সৃষ্ট চরিত্রের মাধ্যমেই ইসলাম ধর্মের এসব রীতি-নীতি দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন। যে রীতি-নীতিগুলো আমাদের সমাজে, পরিবারে বা ব্যক্তিজীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়ে আছে। বেশিরভাগ নাট্যকারই এসব বিষয় সুকৌশলে এড়িয়ে যান। অথচ হ‌ুমায়ূন আহমেদ সেগুলো এড়িয়ে যাননি, উল্টো এসব বিষয় সুকৌশলে যথাযথ পরিবেশনার মধ্যদিয়ে তুলে এনেছেন আমাদের সামনে। তিনি দেখিয়েছেন, ইসলাম ধর্মের প্রসঙ্গ এলে সাহিত্য বা নাটক কখনো দুর্বল হয়ে যায় না। বরং তা আরও জীবনঘনিষ্ট হয়ে ওঠে।

Advertisement

তার প্রতিটি কাহিনির চরিত্র জীবনঘনিষ্ট। পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি। ফলে কোন চরিত্রের আচরণ, কথা-বার্তা, ধর্মীয় অনুভূতি কেমন হতে পারে, তা তিনি যথার্থভাবে নিরীক্ষা করেছেন। কোনো কোনো চরিত্রের মুখ দিয়ে ‘আলহামদুল্লিাহ’, ‘মাশাআল্লাহ’, ‘সোবাহান আল্লাহ’, ‘ইন্নালিল্লাহ’, ‘নাউজুবিল্লাহ’ শব্দগুলো উচ্চারণ করিয়েছেন। যা মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে সবাই করে থাকেন। তিনি এসব সুক্ষ্ন বিষয়গুলোও তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

হ‌ুমায়ূন আহমেদ কখনোই কোনো ধর্মকে ছোট করেননি। আবার কোনো ধর্মকেই মাথায় তুলে নাচেননি। তিনি তার সৃষ্ট চরিত্রের বাস্তবিক দিকটি দর্শককে উপলব্ধি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। যে প্রেক্ষাপটে, যে চরিত্র, যে কথাটি বলতে পারে-তিনি মূলত ওই উপযুক্ত শব্দটিই নির্বাচন করেছেন। এখানেই হ‌ুমায়ূন আহমেদের সার্থকতা।

তিনি সব ধর্মকেই সম্মান করেছেন। ধর্মের পাশাপাশি বিজ্ঞানকেও উপস্থাপন করেছেন। তবে কখনোই বিজ্ঞানকে বড় করতে গিয়ে ধর্মকে ছোট করেননি। ফলে তার নাটকের দর্শক সর্বস্তরে সব সময় বিরাজমান। তিনি যুক্তি উপস্থান করতে গিয়েও কখনো ধর্মকে আঘাত করেননি। ব্যক্তি হ‌ুমায়ূন আহমেদকে আমরা ধার্মিক না বললেও তার নাটকে ধর্মকে যথাযথ মর্যাদায় ব্যবহার করতে দেখেছি। ধার্মিককে তিনি ধার্মিক, বকধার্মিককে তিনি বকধার্মিকই বলেছেন। বকধার্মিকের মুখোশ উন্মোচন করতে গিয়ে কখনো খাটি ধার্মিকের বিরাগভাজন হননি।

হ‌ুমায়ূন আহমেদের নাটকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, ধর্মীয় শিক্ষক, মৌলবী, মাওলানা, কাজী, হাফেজসহ ধর্মীয় অনেক চরিত্র উপস্থাপন করেছেন। তথাকথিত বাংলা সিনেমা বা নাটকের কমেডির নামে এসব চরিত্রকে অবমাননা করতে দেখা যায়নি। বরং কখনো কখনো তাদের ইতিবাচকতাই বেশি ফুটিয়ে তুলেছেন। মূলত একটি সমাজে সব শ্রেণির মানুষই যে গুরুত্বপূর্ণ-এটা বোঝাতেই তিনি সব শ্রেণির চরিত্রকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন।

ফলে তাঁর সৃষ্টি তাঁকে উচ্চতর আসনে বসিয়ে রেখেছে। যে আসন অন্য কারো দখলে যেতেও যুগের পর যুগ অপেক্ষা করতে হবে। হ‌ুমায়ূন আহমেদ এখানেই বিশিষ্ট, এখানেই সেরা। এমনকি সেরাদের সেরা।

এলএ/পিআর