সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে তাওবাহ সম্পর্কিত একটি বিষয় নিয়ে বেশ আলোচিত হচ্ছে যে, তোমরা নাসুহার মতো তাওবাহ কর। অনেককেই এ ব্যাপারে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিতে দেখা যায়। আসলেই কি নাসুহা নামে কোনো ব্যক্তি ছিল? নাকি তা ভুল বিশ্লেষণ?
Advertisement
তাওবাহ হলো পাপ বা অন্যায় কাজ আর না করার অঙ্গীকার নিয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা। যে ব্যক্তি পাপ বা অন্যায় করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছেন; ওই ব্যক্তির তাওবাই হলো- ‘তাওবায়ে নাসুহা’। আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে তাওবাহর নির্দেশ ও তাঁর কাছে প্রার্থনার কথা তুলে ধরেন এভাবে-
‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ তাআলার কাছে আন্তরিকভাবে তওবাহ কর। আশা করা যায়, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কাজসমূহ মোচন করে দেবেন আর তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন; যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। সেদিন আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী এবং তাঁর বিশ্বাসী সহচরদের অপদস্থ করবেন না। তাদের নূর তাদের সামনে ও ডানদিকে ছুটোছুটি করবে; তারা বলবে-
رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا وَاغْفِرْ لَنَا إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
Advertisement
উচ্চারণ : ‘রাব্বানা আতমিম লানা নুরানা ওয়াগফিরলানা ইন্নাকা আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদির।’
অর্থ : হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের নূরকে পূর্ণ করে দিন এবং আমাদের ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি সবকিছুর উপর সর্ব শক্তিমান।’ (সুরা তাহরিম : আয়াত ৮)
তাওবায়ে নাসুহার মর্মার্থ
তাওবায়ে নাসুহা মানে হলো খাঁটি, নির্ভেজাল, একনিষ্ঠ ও আন্তরিকভাবে গোনাহ থেকে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা। এ তাওবাহ করার পর আর গোনাহের দিকে ফিরে না যাওয়া। এ সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িনগণসহ ইসলামিক স্কলারদের বক্তব্য হলো-
Advertisement
- হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তওবায়ে নাসুহা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন-
‘মানুষ খারাপ কাজ থেকে তওবা করবে অতপর আর কখনও (গোনাহের দিকে) ফিরে আসবে না।’
- হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘তওবাহকারী যে গোনাহ থেকে তওবাহ করবে, সে গোনাহের দিকে আর ফিরে আসবে না।’
- হজরত মুজাহিদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার পর পুনরায় সে অন্যায় করবে না।’
- হজরত ইবনে কাসির রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘তওবায়ে নাসুহা হলো- ‘সত্য ও আত্মবিশ্বাসপূর্ণ তওবাহ।’
- তাফসিরে মুয়াসসারে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- ‘তোমরা তোমাদের গোনাহ থেকে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে এমনভাবে ফিরে আসো; যেন পরে আবার গোনাহের দিকে ফিরে না যাও।’
তাওবায়ে নাসুহার ব্যাখ্যা এমন নয়-
সমাজে প্রচলিত আছে যে, আগের যুগে নাসুহা নামে এক বুজুর্গ ব্যক্তি ছিল। আল্লাহ তাআলা আয়াতে ওই ব্যক্তির মতো তাওবাহ করতে বলেছেন। আসলে বিষয়টি এমন নয়। কোনো নির্ভরযোগ্য তাফসির গ্রন্থে এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য আসেনি।
বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এ সম্পর্কে বলেন-
‘আর যে মূর্খ ব্যক্তি বলে যে, নাসূহা হলো- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের এক ব্যক্তির নাম। (কুরআনুল কারিমের) লোকদের ওই ব্যক্তির মতো তওবাহ করতে আদেশ করা হয়েছে।
যে এমন কথা বলে, সে ব্যক্তি একজন অপবাদ দাতা, মিথ্যুক এবং হাদিস ও তাফসির সম্পর্কে অজ্ঞ। সেই সঙ্গে আরবি ভাষা ও কুরআনের অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞ।
কেননা সে এমন (এক কাল্পনিক) ব্যক্তি; যাকে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেননি। আর আগের যুগে এমন কাউকে পাওয়াও যায় না যে, ওই ব্যক্তির নাম ছিল নাসুহা। আর এমন কোনো ঘটনাও কোনো আলেম বর্ণনা করেননি।
নাসুহা যদি কোনো ব্যক্তি হতো তবে কুরআনুল কারিমের আয়াতের শব্দ এমন হতো تُوبُوا إلَى اللَّهِ تَوْبَةَ نَصُوحٍ অথচ কুরআনের শব্দ এসেছে تَوْبَةً نَصُوحًا । নাসূহা হলো- তওবাকারী।
আর যে বলে যে, এ আয়াত দ্বারা একজন পুরুষ বা নারীকে বুঝানো হয়েছে- যার নাম হল নাসূহ। যে ঈসা আলাহিস সালাম বা অন্য কোনো নবির যুগের ছিলেন। সে ব্যক্তি একজন মিথ্যুক। ওইসব লোকদের এ বক্তব্য থেকে তাওবাহ করা ওয়াজিব। যদি তারা তাওবাহ না করে; তাহলে মুসলিমদের সর্বসম্মতি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে শাস্তি দেয়া আবশ্যক।’ [মাজমু ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া)
মুমিন মুসলমানের উচিত, কুরআনুল কারিমের আয়াতের ব্যাখ্যা কোনো কথা বলার ক্ষেত্রে মনগড়া আলোচনা ও প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত থাকা। সঠিক কথা বলা। গোনাহ থেকে বিরত থাকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণপূর্বক আল্লাহর দিকে ফিরে আসা। আল্লাহর শেখানো ভাষায় আল্লাহর কাছে দোয়া করা।
দুনিয়অর সব পাপাচার থেকে তাওবায়ে নাসুহা তথা নিখাদ ও একনিষ্ঠ চিত্তে পূর্ণ আন্তরিকতা সহকারে আল্লাহর কাছে তাওবাহ করে ফিরে আসা। কখনও কু-প্রবৃত্তি কিংবা শয়তানের প্ররোচনায় পরাজিত হয়ে আবারও সেই অন্যায়ের পথে পা না বাড়ানো থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর কাছে তাওফিক কামনা করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাওবাহ সম্পর্কিত সঠিক ধারণার পাশাপাশি পরিপূর্ণ তাওবাহ করার তাওফিক দান করুন। গোনাহমুক্ত জীবন গড়ার তাওফিক দান করুন। তাওবাহ পরবর্তী জীবনে কুরআনের এ আয়াতে উল্লেখিত দোয়া বেশি বেশি পড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম