মতামত

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের স্বস্তির দিন

বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্যালেন্ডারের পাতার বিভিন্ন দিন-তারিখ নানা কারণে উল্লেখযোগ্য, তাৎপর্যপূর্ণ। কোনো তারিখ আনন্দের, স্বস্তির। আবার কোনো তারিখ বেদনার, উদ্বেগের। ১৫ আগস্ট যেমন জাতির জীবনে একটি বেদনার দিন, কষ্টের দিন। এই তারিখটি বাঙালি জাতিকে শুধু বিষাদময় করেনি, বিশ্বসভায় কলঙ্কিতও করেছিল। কারণ ১৯৭৫ সালের ওইদিন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন কয়েকজন সেনাসদস্যের হাতে।

Advertisement

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নৃশংস ঘটনার নজির নেই বললেই চলে।। স্বাধীনতার দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী, রাষ্ট্রনায়ক কিংবা সরকার প্রধানকে হত্যার নজির আছে, কিন্তু রাতের অন্ধকারে পরিবারের সব সদস্যকে একযোগে হত্যার নজির নেই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল, তারা আরও গুরুতর অপরাধ করেছিল ঘাতকদের দায়মুক্তি দিয়ে, কুখ্যাত ইনডেমননিটি অধ্যাদেশ জারি করে।

১৫ আগস্টের কলঙ্ক মোচনের পথে একটি বড় অগ্রগতি ঘটেছিল ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর। কারণ এইদিন জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিতকরণ বিল পাসের মধ্য দিয়ে ১৫ আগস্টের খুনিদের দায়মুক্তির অবসান ঘটেছিল। ১২ নভেম্বর দিনটি তাই বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বস্তির দিন, বুকে চেপে থাকা পাথর সরে গিয়ে হালকা অনুভবের দিন।

ইনডেমনিটি বাতিলের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ শুধু সুগম হয়নি, বছরের পর বছর অপেক্ষার পর, নানা বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে বিচার কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং কয়েকজন খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। কয়েকজন এখনও পলাতক জীবন যাপন করছে। তবে তারা আর আস্ফালন করতে পারছে না। দেশের বুকে বিচারহীনতার যে ঘৃণ্য সংস্কৃতি চালু করা করা হয়েছিল, তারও অবসান ঘটেছে। তাই ১২ নভেম্বর দিনটি আমাদের জন্য যথেষ্ট গুরুত্ববাহী একটি দিন। ইতিহাস তো এমন নানা দিন-তারিখ সুসময়-দুঃসময় এবং ঘটনা-দুর্ঘটনারই সমষ্টি।

Advertisement

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ওইদিনই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সাথী। তিনি যে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন তাতেও যোগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার কয়েকজন বাদে প্রায় সবাই। সে কারণে এটা অনেকে বলার চেষ্টা করেন যে, বঙ্গবন্ধুর ঘাতক আসলে আওয়ামী লীগই।

বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ হত্যাকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতার যোগসাজশ ছিল, বঙ্গবন্ধু-হত্যা-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, কেউ কেউ গ্রহণ করেছেন সুবিধাবাদী অবস্থান– এ সবই সত্য। কিন্তু তাবলে এটা ঠিক নয় যে বঙ্গবন্ধু হত্যায় দলগতভাবে আওয়ামী লীগ জড়িত ছিল। আওয়ামী লীগের অসংখ্য নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মী বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত। এই আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভর করেই তো বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়েছেন, জেলজুলুম সহ্য করেছেন, বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যার দায় আওয়ামী লীগের ওপর চাপিয়ে একটি মহল নিজেদের আড়াল করতে চায়। এটা যে মহলবিশেষের একটি কূটকৌশল এটা মনে রাখতে হবে, বুঝতে হবে। আওয়ামী লীগ থেকে বঙ্গবন্ধুকে আলাদা করা, বিছিন্ন করার রাজনৈতিক চাতুরী বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে যে বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আর সে সময় যেহেতু বিএনপি নামক দলটিই ছিল না, তাই বিএনপির জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। যুক্তি হিসেবে এগুলো উপেক্ষা করার মতো নয়। তবে কিছু ঘটনা মিলিয়ে দেখলে এটা স্পষ্ট হয় যে জিয়াউর রহমান, তার দল এবং নেতৃত্ব কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না।

বঙ্গবন্ধু হ্ত্যার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে জিয়াউর রহমান অবশ্যই ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু হত্যার বড় বেনিফিশিয়ারি জিয়া। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে জিয়ার পক্ষে কি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হওয়া সম্ভব হতো? এই যে আজ তার অনুসারীরা ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া' বলে সম্বোধন করে তৃপ্তি বোধ করেন। এটা তো বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হতো না। বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয় জিয়া তখন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান ছিলেন।

Advertisement

এখন এ তথ্য জানা যে, তার সঙ্গে ঘাতকদের যোগাযোগ ছিল। তিনি জানতেন তারা কী করতে চান। কিন্তু তিনি তাদের বাধা দেননি। এমনকি বঙ্গবন্ধুকেও সতর্ক করেননি। ঘাতকরা শিখণ্ডি হিসেবে বেছে নিয়েছিল খন্দকার মোশতাককে। তবে ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে ছিল ঘাতকবাহিনী। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। কিন্তু সামরিক আইন জারি করা হয় ২০ আগস্ট, তা-ও আবার সংবিধান বহাল রেখে। আর জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান করা হয় ২৪ আগস্ট। ঘাতকদের আস্থাভাজন না হলে কি জিয়া এই পদ পেতেন?

১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীদের কোনো বিচার করা যাবে না, তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা করা যাবে না– এই মর্মে দায়মুক্তি বা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয় ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, জিয়া সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের এক মাস পর। সেনাপ্রধানের সম্মতি ছাড়া মোশতাক এই দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, জিয়াকে না জানিয়েই খুনিদের মদদে মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন, তাহলেও প্রশ্ন আসে, জিয়া যখন রাষ্ট্রক্ষমতা পুরো নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন, তখন কি তিনি এই দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিলের চেষ্টা করেছিলেন? অথবা ১৫ আগস্টের খুনিদের প্রতি তার সমর্থন প্রত্যাহার করেছিলেন? জিয়া ছিলেন চতুর মানুষ। তিনি মেশতাকের মতো বোকা ছিলেন না। জিয়া তাড়াহুড়া না করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর কৌশল আয়ত্ত করেছিলেন। সেজন্য মোশতাক বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিবেচিত হলেও জিয়া হয়ে আছেন অনেকের কাছে ‘মহান দেশপ্রেমিক’। জিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল হিসেবি, সুপরিকল্পিত।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়া কার্যত ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন। কিন্তু ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণকারী বিচারপতি সায়েমকে তিনি কিছুটা সময় দেন। তারপর প্রথমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদ কেড়ে নেন বিচারপতি সায়েমের হাত থেকে। অতঃপর রাষ্ট্রপতি পদ থেকেও তাকে বিদায় করে জিয়া হয়ে বসেন ক্ষমতার প্রধান ব্যক্তি। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া সামরিক আইনের অধীনেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেন। ওই নির্বাচনে দলছুট, সুবিধাবাদী এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের নিয়ে জিয়ার নবগঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি বিস্ময়করভাবে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে রেকর্ড তৈরি করে।

প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় রাজাকার শিরোমণি শাহ আজিজকে। অথচ জিয়া নিজে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক আইনের আওতায় জারি করা সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে বৈধতা দেওয়া হয় এই সংসদে। এ সংক্রান্ত বিল উত্থাপন করেন শাহ আজিজ । ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ এভাবেই হয়ে যায় সংবিধানের অংশ। অথচ এটা ছিল একটি সভ্যতাবিরোধী, বর্বর ব্যবস্থা।

জিয়া যদি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরোধী হতেন, তিনি যদি ঘাতকদের বিচার চাইতেন তাহলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানের অংশ না করে তা বাতিল করতেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনিদের বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে কূটনৈতিক পদে নিরাপদ চাকরি না দিয়ে তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতেন। জিয়া জাতীয় ঐক্যের মুখোশ পরে কার্যত দেশকে এক ভয়াবহ বিভেদের পথে ঠেলে দিয়েছেন। দুঃখের বিষয় হলো, জিয়ার অবর্তমানেও তার দল বিএনপি সেই খুনি পোষণের নীতি থেকে বের হতে পারেনি। অথচ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে একটি নতুন বিএনপির প্রত্যাশাই দেশবাসীর ছিল।

জিয়ার পর এরশাদও ক্ষমতা দখল করে ১৫ আগস্টের খুনিদের বিচারের কোনো নতুন পদক্ষেপ নেননি। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির রাজনীতি ছিল মূলত আওয়ামী লীগবিরোধিতার রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের ব্যবস্থা হলে আওয়ামী লীগের লাভ হবে -এই বিবেচনা থেকেই খুনিদের বিচারে অনীহা দেখানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, এরশাদ এবং খালেদা জিয়া দুইজনই আওয়ামী লীগকে চাপে রাখার জন্য খুনি ফারুক-রশীদের দল ফ্রিডম পার্টিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে তাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করার অপচেষ্টাও করেছেন।

১৯৯১ সালে বিএনপির খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে। দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তনের সুযোগ পেয়েও তা হাতছাড়া করে বিএনপি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের জন্য একটি বিল জমা দেওয়া হলেও তা বিবেচনা করেনি বিএনপি। বরং তৎকালীন আইনমন্ত্রী মির্জা গোলাম হাফিজ বলেছিলেন, ইনডেমনিটি আইনটি এতই জটিল যে তা প্রত্যাহার অযোগ্য।

১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনারা নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ইনডেমনিটির মতো একটি কালো অধ্যাদেশ বাতিলে কোনো সমস্যা হলো না। ১২ নভেম্বর এই জঘন্য অধ্যাদেশ বাতিল হওয়ায় পর বঙ্গবন্ধ হত্যার বিচারের পথে যে আইনি বাধা তৈরি করা হয়েছিল, তার অবসান ঘটে। রাষ্ট্রপিতাকে সপরিবারে হত্যার মতো গুরুতর অপরাধা সংঘটনের পরও যারা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতো যে, তাদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। তাদের দম্ভ চূর্ণ হয়েছে। অপরাধ করলে তার শাস্তি পেতেই হবে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত করেছেন তাঁরই কন্যা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতিহাসের এই দায় মেটানোর জন্যই হয়তো তিনি বেঁচে আছেন, ১৫ আগস্ট ছিলেন বিদেশে।

ইতিহাস কাউকে মার্জনা করে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে এক ভাষণে বলেছেন, একসময় ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম সম্পূর্ণ মুছে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। ইতিহাসও প্রতিশোধ নেয়।

বাংলাদেশে ইতিহাস প্রতিশোধ নিয়েছে। যারা ষড়যন্ত্র করে, যারা গোপনে অস্ত্র শান দেয়, হত্যা-ক্যুয়ের মাধ্যমে যারা ক্ষমতা বদলের স্বপ্ন দেখে, যারা সোজা পথ রেখে বাঁকা পথে হাঁটতে পছন্দ করে, তাদের জন্য দুঃসময় তৈরি করেছেন শেখ হাসিনা তার সাহসী সিদ্ধান্ত এবং জনকল্যাণকর কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। করোনাভাইরাসের আঘাতে মুজিব বর্ষ পালন ব্যাহত হলেও মুজিব আজ বাঙালির হৃদয়জুড়ে। তিনি আছেন এবং তিনি থাকবেন। তিনি চিরঞ্জীব।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এইচআর/পিআর