ভিনগ্রহ থেকে আগত কোন এলিয়ান ভুলক্রমে এই মনুষ্য জগতে এসে পড়ে যেমন তাজ্জব বনে যায় মোসাম্মৎ করিমুননেসা ওরফে তারামন বেগমের অবস্থাটাও হয়েছে অনেকটা সেরকমের। যদিও এলিয়ান বলতে কেমন এলিট এলিট মনে হয়। মনগড়া ভাবে আমরা যাকে আবিস্কার করেছি, তারা দেখতে বাচ্চা বাচ্চা, সে তার বয়স যতই হোক না কেন। চোখ দুটো হবে গোল গোল, কান দুটো খরগোশের মত খাড়াখাড়া, চোখের চাহনিতে থাকবে অবাক বিস্ময়।অবাক বিস্ময় যদিও তারামনের চোখ দুটোতে আছে তবে সে চোখ দুটো দেখতে মোটেও সুন্দর নয়। আবার তার চাহনি সোজাও নয়। একদিকে তাকালে মনে হয় অন্যদিকে চেয়ে আছে। সাত ছেলের পরে এক মেয়ে জন্ম নিয়েছে বলে বাবা-মা তার মেয়ের চোখ দুটোকে বলেন “লক্ষ্মীটেরা”। অবশ্য শ্বশুরবাড়িতে আসার পরে তার স্বামী এ চাহনী দেখে তুচ্ছভাবে তাকে বলে “লক্ষ্মীছাড়া।” সে চোখের দৃষ্টি যাই হোক, এতে তো তার কোন হাত নেই, তাকে এভাবে গড়েছেন সৃষ্টিকর্তা নিজেই। তবে সৃষ্টিকর্তার উপর তার কোন মান অভিমান নেই, অভিযোগও নেই। কিন্তু সকল অভিযোগ কেবল তার স্বামীর। তার চেহারাটায় বিশেষ কোন শ্রী নেই বলেও দিন রাত স্বামীর কটু কথা শুনতে হয় তাকে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তার রূপলাবণ্য এবং সৌন্দর্য কিছু কম দিলেও একটি জিনিস অনেক বেশি দিয়েছেন তা হল তার ধৈর্য। তাকে কেউ অবহেলা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলে কিংবা কটু কথা শুনালেও সে তাতে রাগ করে না কিংবা কোন কষ্ট তাতে আঁচড় ফেলতে পারে বলে মনে হয় না। শারীরিক গড়নে গোলগাল নাদুসনুদুস ধরনের মোটা, তাই সঠিক বয়সের চেয়েও একটু বেশিই বয়স্ক মনে হয়। ভাল কাপড়-চোপড় পড়লেও বড় বেমানান লাগে তাকে। বরং একপ্যাচে মোটা সাদাসিধে কাপড়ই যেন তার শরীরের সাথে মিশে যায়। তাই হঠাৎ করে ঘরে মেহমান এলে স্বামীর ধমকে তড়িঘড়ি করে পরার একপ্যাচে শাড়িটা খুলে একটা ছাপার কড়কড়ে মাড় দেওয়া শাড়ি যখন কুচি দিয়ে পরে আসে তখন তার নিজেরও যেমন অস্বস্তি লাগে আগত মেহমানদের ভ্রুকুটি তোলা দৃষ্টি যেন অস্বস্তিতে ভোগে। তারপর তার চাহনি ঠিক মেহমানদের দিকে না হয়ে বাঁকা ভাবে অন্যদিকে হয় বলে কেউ কেউ মুখ টিপে হাসাহাসি করে। ‘যত দোষ নন্দঘোষ’ তাই এসবের জন্যও তার স্বামী দিনরাত তাকে যা ইচ্ছে তাই কথা শোনায়। নতুন বউ এর নামটি নিয়েও তার স্বামীর যেন দুঃখের শেষ নেই। তাই দুঃখ করে মাঝে মাঝে তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে থাকে, মেয়ে মানুষের কত সুন্দার সুন্দার নাম থাকে একাবারে সিনামার নায়িকাদের নাহন, শাবানা, ববিতা, কবিতা কতকি! তোর বাপে তোর কেমন উদ্ভাট একখান নাম দিছে, এত্তবড় নাম ডাকতে গেলে দাত ভাইঙ্গা যাইতে চায়। যদিও তার নামটি তার বাবার দেওয়া নয়। একমাত্র ছেলের ঘরে একমাত্র মেয়ে বলে তার দাদি বড় শখ করে নিজের নামটিই তার নাতনির জন্য রেখেছিলেন। কিন্তু স্বামীর কথায় সে কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ থাকে। স্বামী তবু এটা ওটা শুনিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার বলে ওঠে, ছেলেমানুষ হইলে না হয় ঠিক আছিল, নাম ডারে এদিক ওদিক টানাটানি কইরা কিচু রাফদফা হইত। আমার অপিসের বড় সাহেবের নাম আগে নাকি ছেলে আব্দুর রকমান, এহন হেই রকমান নাম পাল্ডাইয়া কতু সুন্দার একখান নাম থুইছে “রেকমান” (রেহমান)।আমার বাপ আমার নাম থুইছেলে শরিফ। একদিন স্যারে আমারে জিগাইল তোমার নাম কি? আমি মুখ ফসকাই কইলাম “শোরিফ” স্যারে কিছু কইল না। তোর নাম যদি শরিফা হইত তাইলে মন্দ হইত না। আমি তোরে শেরিফা বলাইতাম। এখন এমুন একখান নেচ্ছা নাম...। তোরে কোরিমোননেছা থেইক্কা কেরিমন ডাকাও যাইবে না। নাম পাল্ডাইয়া সুন্দার কোন নাম থুইতে হইলে চেহারাডাও সুন্দার হইতে অয়। তোর চেহারা তো মাশাহআল্লাহ! আল্লাহর বান্দা, নবীর উম্মত!তয় থাউগ্গা। তরে আমি তারামন ডাকুম। হ-না-কিছু কওনা ক্যা? তোরে আল্লাহ কি দিয়া বানাইছে? এভাবেই নিজেই কারিমুননেসার নাম তারামন হয়ে যায়। নাম পরিবর্তন হলেও তার আচার আচরণে বিশেষ পরিবর্তন আনতে পারে না। শ্বশুর বাড়ির চাপে পড়ে যদিওবা ঢাকা শহরে এক কামরার একটি ঘর ভাড়া করে তারামনকে নিয়ে এসেছিল কিন্তু শহুরে জীবনে যেমন তারামন অভ্যস্ত হতে পারেনি তেমনি তার স্বামীও তাকে আপন ভাবতে পারল না কখনো। অবশেষে তারামনকে তার স্বামী গাঁয়েই রেখে এল।মূলত তারামনের স্বামী মন থেকে তার স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারে নি। সে তার ভিতরের সৌন্দর্য না দেখে সব সময় তার বাহ্যিক সৌন্দর্য খুঁজেছে তাছাড়া এই বিয়েটা তার নিজের পছন্দেও হয়নি বলে সে মেয়েটিকে অনাদরেই রাখত।একদিন তার বাবাই নিজের পছন্দকে ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন। বলা নেই কাওয়া নেই হুট করে টেলিগ্রাম করে ছেলেকে এনে একেবারে বিয়ের পিঁড়িতে বসালেন। বাবা ছিলেন ভীষণ লোভী স্বভাবের। মেয়েটির বিয়ের বয়স পার হলেও ভাল পাত্রের অভাবে বিয়ে হচ্ছিল না এবং মেয়েটি দেখতে সুন্দর নয় বলে তেমন পাত্রও আসছিল না। তিনি যখন শুনলেন মেয়ের নামে বিঘা কয়েক জমি আছে, ভাইদের হাঁকডাক আছে, সাত ভাই এর এক বোন, তখন আর লোভ সামলাতে পারলেন না। আরও ভাবলেন, বিয়েতে একেক ভাই এক একটা করে সোনার গয়না দিলে তা কম করেও সাত ভরি গয়না তো আসবে। জায়গাজমির সাথে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ একখানা মোটরসাইকেল নির্ঘাত মিলবে! যৌতুকের স্বপ্ন বুনে বুনে বাবার কালো কুতকুতে চোখ দু’টো আনন্দে জ্বল জ্বল করে উঠল। মনে মনে বললেন, ছেলেকে খাইয়ে পড়িয়ে লেখাপড়া শিখিয়ে এত বড় করেছেন, আন্ডার মেট্রিক পাশ ছেলে ঢাকা শহরে সরকারি চাকরি করে, এমন ছেলে ক’জনের ভাগ্যে জোটে!নিজের বয়সের সমান সমান বয়সের কিংবা তার চেয়ে দু এক বছরের বড় হলে হতেও পারে, সহজ-সরল বোকা বোকা চেহারার করিমুননেসাকে আলতা, সাবান, স্নো, পাউডার দিয়ে ঘরে মেজে বিয়ের শাড়িতে যতই ঝকঝকে তকতকে সাজিয়ে বাসর ঘরে রাখা হোক না কেন ঘোমটার ফাঁক থেকে তার সিধেসাদা চাহনি দেখে বউ হিসেবে কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি সে। যদিও বাবার ভয়ে কবুল বলে দু’টো দিন পার করে শহরে ফিরে এসেছিল। অবশ্য শুধু বাবাকে দোষ দেওয়া কেন, জায়গা সম্পত্তির লোভ যে তার নিজেরও ছিল না তা তো নয়! অপেক্ষাকৃত বড় ঘরে শ্বশুর বাড়ি হলে লোকজনকে বুক ফুলিয়ে শ্বশুর বাড়ির পরিচয় তুলে ধরতে পারবে তাও বা কম কিসে!বউকে বাড়িতে তুলে এনে রাখলেও মাসকে মাস চলে যায় বরের দেখা নেই। মেয়েটির এ নিয়ে যেন কোন মাথা ব্যথা নেই। সে ঘর গৃহস্থালির কাজ, রান্না-বান্না, শ্বশুরের দেখাশুনা সব একমনে করে যেতে লাগল। এতে অবশ্য নানা জনে নানা কথা বলতেও লাগল। তখন বাবা তার ছেলেকে অনুনয় বিনয় করে দু’একবার বাড়িতে আনতে পারলেও তাতে ছেলের চরিত্রে বিশেষ কোন পরিবর্তন হল না। আবার পরিবর্তন যে একেবারেই হয়নি তা নয়। ছেলে বউ পছন্দ নয় এই অজুহাতে শহরে গিয়ে কাজের বদলে অকাজ করে ফেলল। মেসে রান্নার কাজে নিয়োজিত এক বিধবা মহিলার সাথে কিছু অঘটন ঘটিয়ে শেষে তাকে বিয়ে করে ফেলল। একান ওকান হয়ে দেশের বাড়িতে, এমনকি শ্বশুর বাড়িতে সে খবর পৌঁছাতে সময় লাগেনি। ভাইয়েরা তখন বোনের স্বামীকে শায়েস্তা করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল কিন্তু বোনের পা জড়িয়ে কান্নাকাটিতে তারা তাকে মারধর থেকে অব্যাহতি দিল তবে তারা ওমন খাটাসের মত বন্যপশুর কাছে বোনকে ফেলে রাখতে চাইল না। তারা বোনকে নিজেদের কাছে আনার বহু চেষ্টা করল কিন্তু তার বোন স্বামীর ঘরকেই আগলে ধরে রাখবে, সে কিছুতেই বাবার বাড়িতে ফিরে যাবে না। ভাইয়েরা কি করবে ভেবে না পেয়ে, বোনের ভাল থাকার জন্য বোনকে কিছু জায়গা জমি, দুটো গাই গরু, দুটো ছাগল, আর কিছু হাঁস-মুরগি দিয়ে তার সংসারটা সাজিয়ে দিল। ভাবল বোনের কপাল মন্দ, দেখতে শুনতে ভাল এবং চাকুরিজীবী জেনেই তো বোনকে এমন ছেলের হাতে সোপে দিয়েছিল। কিন্তু ছেলেটি যে এমন তা তারা বুঝতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বোনের নিয়তির উপর সব ছেড়ে দিযে তারাও যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরল। একে একে তারামনের বাবা মা গত হলেন। শ্বশুরও চলে গেলেন। এর মধ্যে অবশ্য তারামনের কোল জুড়ে দুটি ছেলে মেয়ে জন্ম নিল। তারামন নিজের সংসার বাচ্চাদের দেখাশুনা ঘর গৃহস্থালির কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। স্বামী তার কখনো ছুটিতে আসে কখনো নয়। তবে বাচ্চারা একটু বড় হতেই হঠাৎ করে তার বাড়িতে আসা যাওয়া বেড়ে গেল। তারামনের ভাইয়েরা এতে বেশ খুশি, ভাবলো এতদিনে বুঝি বোনের কপাল খুলেছে। তারামনের স্বামী তখন তারামনকে বলল, ভাবলাম দ্যাশেই থাকপ। বিদেশে আর না, দ্যাশে ব্যবসা বাণিজ্য করে খাইলে চাকরির চাইয়া ম্যালা লাভ। স্ত্রীর প্রতি তার ভালবাসাও বেড়ে গেল। এভাবে কিছুদিন চলার পর তারামনের স্বামী একদিন শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হল। সে তখন সবাইকে বুঝাতে সক্ষম হল যে, সে আসলে লোক হিসেবে ওত খারাপ নয়। এবার সে ঘর সংসারের দায়িত্ব পালন করার জন্য দেশেই থাকতে চায়। ইনিয়ে বিনিয়ে ভাইদের কাছে কিছু টাকা পয়সাও চাইল। ভাইয়েদের কেউ কেউ রাজি না হলেও সবার মিলিত আলোচনায় তার একমত হয়ে ভাবল তার বোনের যেহেতু দুটা বাচ্চা হয়েছে, এবং মানুষ চিরদিন এক রকম থাকে না, তার ভগ্নিপতি হয়ত ভাল হয়ে গেছে, তাই তারা তখন তাকে দু’বিঘা ধানি-জমি এবং নগদ কিছু টাকা দিল। অবশ্য বুদ্ধি করে তারা জমি তার বোনের নামে দলিল করে দিল। কিন্তু মাসখানেক যেতে না যেতেই তার আসল চেহারা ফিরে আসতে লাগল। সে ভুলানো ভালানো কথা বলে তারামনের টিপসই নিয়ে জমির দলিল তার নিজের নামে করে নিল। এবং রাতারাতি পার্শ্ববর্তী গাঁয়ের এক অল্পবয়সী মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলে আনল। তারামনের ভাইয়েদের মাথায় যেন বাজ পড়ল। কিন্তু বোন তার নির্বাক, যেন কিছুই ঘটেনি! ভাইয়েরা পড়েছে মহা বিপদে। কিছুই করতে না পেরে তারা একসময় ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দিন যায় বছর যায় তারামনের দুঃখের কথা যেন ইতিহাস হয়ে যায়। স্বামীর অত্যাচার বাড়ে, বাড়ে সতীনের অত্যাচার। রূপকথার গল্পের মত সে হয়ে যায় দুখো রানী। কিছুদিন পর দ্বিতীয় স্ত্রীর কথামত তাকে তালাক দিয়ে ভাইদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাচ্চা দুটোকে মায়ের ভালবাসা থেকে দূরে সরিয়ে সৎমায়ের কাছে রাখা হল। সৎ মায়ের ঘরেও বাচ্চাকাচ্চা বাড়ে। সৎমায়ের অত্যাচারে আর বাবার অনাদরে জীবন কাটে অভাগি মা-তারামনের সন্তানদের। সে কষ্ট দুর্দশা দেখে প্রতিবেশীদের মন কাঁদলেও সৎমায়ের মন কাঁদে না, গলে না বাবার হৃদয়। তরামনের ভাগ্যও এমন যে, স্বামী সতীনের সংসার ছাড়লেও দুঃখ তাকে ছাড়ে না। ভাইয়েরা ভালবাসলেও ভাই-বউদের অত্যাচার আর অবহেলায় কষ্টের বোঝা বাড়ে। তার শান্তি বুঝি এ জগতে কোথাও নেই। তাই সৃষ্টিকর্তার কাছে কান্নাকাটি করে দুঃখের বোঝা হালকা করে আবার জগৎসংসারের কাজে মনোনিবেশ করে। তারামনের ছেলেকে তার বাবা স্কুলে ভর্তি করলেও ছেলেটা লেখাপড়ায় মন বসাতে পারে না মাঝে মাঝে লুকিয়ে নানা বাড়ি গিয়ে মাকে এক নজর দেখে আসে। সে খবর বাতাসে ভর করে ভাইয়ের বউদের মুখ থেকে তারামনের স্বামীর কানে পৌঁছে যায়। ছেলেটিকে তখন বাবা প্রচণ্ড মারধর করে দূরের কোন মাদ্রাসায় ভর্তি করে রেখে আসে, যাতে মাদ্রাসার কঠিন শাসনে থেকে ভুলে যায় মাকে। মেয়েটির ভাগ্যে লেখাপড়া জোটে না। মেয়েটি দেখতে বাবার মত সুন্দর তবে গুন মায়ের মতো। সারাদিন ঘরের কাজ, সৎভাইবোনদের দেখাশুনা আর সৎ মায়ের কঠিন শাসন ও শোষণে কোনভাবে দিন পার হয় তার। মায়ের মতই নিরবে সব দুঃখ সয়ে যায। সাত চড়ে রাকবেনা। একদিন হঠাৎ শোনা গেল, সে মেয়েটির বিয়ে। তার বাবার ভিটিতে পাকা দালান ঘর উঠেছে। জায়গা জমি ফসল ভাল ফলছে।তাই মেয়েটি প্রাপ্ত বয়স্ক হবার আগেই বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ের সম্মন্ধ আসতে থাকে। অবশেষে তার বাবা এবং হবু বর এর সন্ধিতে তার পনের বছর বয়সকে আঠারো বছর বানিয়ে বিয়ের পিড়িতে বসানো হলো। দু’একজন এতে প্রতিবাদ করলেও একসময় সবাই ভাবল, এটুকু মিথ্যের জন্য মেয়েটি সৎমায়ের অত্যাচার থেকে বেঁচে নিজের সংসার পাবে। কিন্তু কেউ তো জানে না, ভাগ্য তার সাথে তার মায়ের মত খেলবে কিনা! শেষ পর্যন্ত দূরগ্রামের এক স্কুল শিক্ষকের সাথেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেল। মেয়েটি শ্বশুর বাড়ি চলে গেল। এবং জগৎ সংসার নিয়ে প্রতিটি মানুষ ও যে যার মত ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তারামনের কথাও সবাই যেন ভুলে গেল। তারামনের সৎ ছেলেমেয়েরাও বড় হতে লাগল। এ ঘরের তিন মেয়ে এবং একটি ছেলে। ছেলেটি জোয়ান, তাগড়া হয়েছে, দেখতে শুনতে এমন ছেলের মতো ধারে কাছে আর দ্বিতীয়টি নেই কিন্তু ছেলেটি শুধুই অসুখে ভোগে। ডাক্তার, কবিরাজ বাদ যায় না কেউ। কিন্তু কেউ এ রোগের নাম জানে না। যুবক বয়সী ছেলেটি ক্রমে শয্যাশায়ী হয়ে মৃত্যুর দিন গোনে।তখন হঠাৎ খবর এল তারামনের ছেলে মাদ্রাসা থেকে পালিয়েছে, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বার কয়েক এভাবে পালালেও ধরে আনা হয়েছে। কিন্তু এবার কোথায় গেছে তা কেউ জানে না। খুঁজে পাচ্ছে না কোথাও।এক রাতের অন্ধকারে তারামনকে একটি ছেলে ধরে বেঁধে ঢাকায় নিয়ে গেল। ছেলেটি গার্মেন্টস-এ কাজ করে। বস্তিতে এক রুমের একটি ঘর ভাড়া নিয়েছে। তারামনের জন্য তেল সাবান সব কিনে এনেছে তবে কড়কড়ে ছাপার শাড়ি না এনে কিনে দিয়েছে চিকন পাড়ের তাঁতের শাড়ি। যা কুচি দিতে হবে না, আটপৌরে বাঙালি সাদাসিধে নারীর মত এক প্যাচে পরতে পারবে, এতদিন যেভাবে পরে এসেছে সে। শহরের আর গ্রামীণ জীবনের ভিন্নতা নেই। যেমন ভিন্নতা নেই ভালোবাসার ছেলেটি বস্তিতে সবাইকে জড় করে বলল, তোমরা সকল মানুষ শুইন্না রাখ, আজ থেইকা আমার দুঃখিনী মায়ের একটা সংসার হইল, একটা ঘর হইল। আর এই সংসারের একটা নাম দিছি আমি। এইটা হইল আমার মা তারামনের সংসার। বস্তিবাসির চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল, আনন্দ অশ্রু ঝড়ে পড়ল তারামনের বাঁকা দুটি চোখ থেকেও।এইচআর/পিআর
Advertisement