জাতীয়

করোনাকালীন অনিয়ম-দুর্নীতি: স্বাস্থ্যখাতে আস্থা হারিয়েছে মানুষ

করোনাভাইরাস মহামারিতে অসংখ্য অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে স্বাস্থ্যখাতের ওপর আস্থা হারিয়েছেন সাধারণ মানুষ। করোনা মোকাবিলায় সরকারের কিছু কার্যক্রমে উন্নতি পরিলক্ষিত হলেও গৃহীত কার্যক্রমগুলোর ক্ষেত্রে সুশাসনে এখনও ব্যাপক ঘাটতি বিদ্যমান। সরকারের ত্রাণসহ প্রণোদনা কর্মসূচি থেকেও অনিয়ম-দুর্নীতি ও সুবিধা লাভের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। মাঠ পর্যায়ের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সরকারি ত্রাণ থেকে প্রকৃত উপকারভোগীরা বঞ্চিত হচ্ছে।

Advertisement

মঙ্গলবার (১০নভেম্বর) ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত ‘করোনা ভাইরাস সংকট মোকাবেলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ: দ্বিতীয় পর্ব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের রাজনৈতিক বিবেচনায় আড়াল করা হচ্ছে এবং এক্ষেত্রে কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে লোক দেখানো ব্যবস্থা গ্রহণের প্রবণতা দেখা গেছে। এছাড়া, তথ্য প্রকাশে বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমেও অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে আড়াল করার প্রবণতা দেখা গেছে।

গবেষণায় আরও বলা হয়, সরকারের সংকোচনমূলক নীতি প্রয়োগের (সেবা ও নমুনা পরীক্ষা হ্রাস) মাধ্যমে শনাক্তের সংখ্যা হ্রাস হওয়াকে ‘করোনা নিয়ন্ত্রণ’ হিসেবে দাবি এবং রাজনৈতিক অর্জন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলার প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞ মতামত উপেক্ষা করে এখনো আমলানির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা বিদ্যমান। শীত মৌসুমে করোনার সম্ভাব্য দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় কার্যকর প্রস্তুতির অভাব। শহরকেন্দ্রিক ও বেসরকারি পর্যায়ের বাণিজ্যিক সেবা সম্প্রসারণ, পরীক্ষায় ফি নির্ধারণ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে এই সেবা থেকে বঞ্চিত করছে এবং হয়রানি ও অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। নমুনা পরীক্ষা, চিকিৎসা এবং করোনার অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় গৃহীত প্রণোদনা কর্মসূচির ক্ষেত্রেও সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত অংশের অনুকূলে পক্ষপাত করা হচ্ছে এবং চিকিৎসা সেবা ও প্রণোদনার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে এখনও পৌঁছেনি।

Advertisement

গবেষণার সারসংক্ষেপে বলা হয়, ইতোপূর্বে টিআইবি করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় প্রাক-সংক্রমণ প্রস্তুতিমূলক পর্যায়ে ও সংক্রমণ শুরুর প্রথম তিন মাসে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম চালায়। চলতি বছরের ১৫ জুন প্রকাশিত গবেষণায় সংক্রমণের প্রথম তিন মাসের মধ্যে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত কার্যক্রমে সুশাসনের প্রতিটি নির্দেশকের ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি দেখা গেছে। এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারি কার্যক্রমে কী ধরনের অগ্রগতি হয়েছে এবং কী ধরনের নতুন কার্যক্রম নেয়া হয়েছে তা সুশাসনের আলোকে পর্যবেক্ষণ করার উদ্দেশ্যে টিআইবি এই দ্বিতীয় দফা গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।

গবেষণা ফলাফলের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে টিআইবি

আইনের শাসন, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি

- স্বাস্থ্য খাতের সব ধরনের কেনা-কাটায় সরকারি ক্রয় আইন ও বিধি অনুসরণ করতে হবে। জরুরিসহ সকল ক্রয় ই-জিপিতে করতে হবে।

Advertisement

- করোনা সংক্রমণের সম্ভাব্য দ্বিতীয় পর্যায়ের আঘাত মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।

সক্ষমতা বৃদ্ধি

- বিনামূল্যে নমুনা পরীক্ষার সুবিধা সকল জেলায় সম্প্রসারণ করতে হবে, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে হবে।

- ব্যবহৃত সুরক্ষা সামগ্রীসহ চিকিৎসা বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে; সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

অংশগ্রহণ ও সমন্বয়

- সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রয়োজনে বেসরকারি হাসপাতালের সেবাসমূহকে (আইসিইউ, ভেন্টিলেটর ইত্যাদি) করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

- বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি দফতরের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে।

- দেশজুড়ে প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতার জন্য সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা

- সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে নিয়মিত সভা করতে হবে এবং করোনায় সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

- করোনা সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশে যে বিধি-নিষেধ দেয়া হয়েছে তা বাতিল করতে হবে।

- গণমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে সরকারি কেনাকাটা, করোনা সংক্রমণের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ, ত্রাণ ও প্রণোদনা বরাদ্দ ও বিতরণ ইত্যাদি বিষয়ে অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।

- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল বা সংশোধন করতে হবে এবং হয়রানিমূলক সব মামলা তুলে নিতে হবে।

- বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগীদের তালিকা যাচাই-বাছাই ও হালনাগাদ করতে হবে এবং ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।

- স্বাস্থ্যখাতে কেনাকাটায় তদারকি বাড়াতে হবে এবং অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

- সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত সাময়িক বরখাস্ত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণসহ মামলা পরিচালনা করতে হবে। এসব জনপ্রতিনিধিদের পরবর্তী যেকোনো নির্বাচনে অংশ নেয়ার যোগ্যতা বাতিল ঘোষণা করতে হবে।

- সম্মুখসারির সব স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রাপ্য প্রণোদনা দ্রুত বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে।

এমইউ/এসএস/পিআর