সাহিত্য

অপ্সরী

সরোজ মেহেদী

Advertisement

১৩ বসন্ত পর আমি-সে মুখোমুখি। খিচুড়ি-ইলিশ পাতে বেড়ে দিতে দিতে গৃহকর্ত্রী আবারও হাঁকান, ‘ভাইয়া এসেছে, আসো না।’ তারও কিছুক্ষণ পর সে সামনে এসে দাঁড়ায়, ‘আমি অপলক তাকিয়ে থাকি’। বলি, ‘মনে আছে আমার কথা?’ অনেকটা গম্ভীর হয়ে জবাব দেয়, ‘ছোটবেলার কতো কিছুই তো ভুলে গেছি।’

ওহহো, আমিও ভুলে যাই, বড় হয়ে গেছি। ওর বিয়ে হয়ে গেছে। আর ক’দিন পর চলে যাবে প্রবাসে, স্বামী-জীবন যাপনে। তবু কৈশোরের স্মৃতি হানা দেয়। আমাদের গেছে যে দিন, তা কি একেবারেই গেছে!

ও নিমিষেই চোখের আড়াল হয়ে যায়। আমার আর দেখা হয় না ওকে। বলা হয় না নিজের না বলা কথাগুলো। সে কি জানে, তার একটু দেখা পাবো বলে, সেই কবির মতো এক কোটি বছর দাঁড়িয়ে আছি এই চৌরাস্তায়। কতো অশ্রুজল শুকালো দু’চোখে, কতো শীত-গ্রীষ্ম পার হয়ে গেল, অপেক্ষা ঘুচলো না। তাকে একটু দেখতে পাবো বলে, বুদ্ধের মতন আমি ঘরছাড়া, পথের বাউল।

Advertisement

আমি থাকবো বলে বিছানা পাতা হয়েছে। কিন্তু যাবো বলে উঠে দাঁড়াই। চোখ রাঙাতে রাঙাতে দরজার সামনে এসে দাঁড়ান ফুপু, বাসার সবাই। শুধু একটি প্রাণি ছাড়া। মোজা পরি, তারপর কেডস। বাসার সবচেয়ে পুঁচকেটা এসে গো ধরে, ‘না, যেতে পারবে না, না-না-না’। এবার চিৎকার শুরু করে সে।

ও সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আগের মতোই নির্লিপ্ত। ঠিক তাকাচ্ছেও না। আমি হাত নাড়ি। সাড়া দেয় না। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ফুপুর কণ্ঠ শুনি, ‘তোদের রাত-বিরাতে চলে অভ্যাস। কথা শুনবি না, কী করবো? গিয়ে একটা ফোন দিবি।’ ‘ইনশাল্লাহ!’ বলে গেট পেরিয়ে বেরিয়ে আসি। ‘ফোন দিবি বলে দিলাম’, ফুপু হাঁকেন।

রাতটা থাকা যেতো। থাকলে সাড়ে তিন বছরের নদু সবচেয়ে বেশি খুশি হতো। নাদিয়াকে ভিডিও কলে বহুবার দেখেছি। এই পুঁচকে যে এতো মায়াবী আর বুদ্ধিদীপ্ত- দেখা না হলে বোঝা যেতো না। ও ছাড়বেই না, তাই বিদায়ও দেবে না। চিৎকার করতে করতে ভেতরে চলে গেছে। ‘যাবে না বলছি। না-না-না…।’

তবু কেন এই রাতে সবাইকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কেউ জানে না, আমি জানি। আমার বাইরে সবুজ আর ভেতরে লাল। ১৩ বছরের যন্ত্রণা নিয়ে এক রাত পাশাপাশি ঘুমানো যায় না। নিশ্বাসও আসলে নেওয়া যায় না। আমি তাই পালাই। পালিয়ে বাঁচার মধ্যে না কি একধরনের আনন্দ আছে। আমি কি আজ সে আনন্দের ঘ্রাণ নাকে পাচ্ছি!

Advertisement

হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়াই। সুতায় বাঁধা একটা খাম আমার সামনে ঝুলছে। আশেপাশে তাকাই। আমাকেই দেওয়া হয়েছে বোধ হয়। খামটা হাতে নেই। আবার হনহন করে হাঁটি। আসতে আসতে বারকয়েক চেক করি। খামটা আবার হারিয়ে যায়নি তো।

বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত সোয়া একটা। ঘরে না ঢুকে পাশের পার্কে চলে যাই। কোনো মানুষ নেই। দু’চার জন আশ্রয়হীন শুয়ে আছে। খামটা খুলি। একটা সাদা পাতা। মাঝখানে লাল কালিতে লেখা, ‘যে ভালোবাসা বোঝে না; তাকে ভুলে গিয়ে বেঁচে যাক পৃথিবীর তাবৎ প্রেমিকারা। বি.দ্র. ইলিশ খাওয়াটা দেখি এখনো শেখেননি জনাব।’

এসইউ/পিআর