ফিচার

আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের লাইব্রেরি কেমন?

রেজিনা আখতার

Advertisement

আমেরিকানদের সাদা বাড়ির নতুন অভিভাবক নিয়ে বিশ্বব্যাপী তোলপাড়। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গৃহে প্রবেশ ঘটবে জো বাইডেনের। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পাততাড়ি গুটিয়ে সাদা বাড়ির মালিকানা হস্তান্তর করতে হবে। সেক্ষেত্রে তার শাসনামলের সব সরকারি কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, তথ্য-উপাত্ত, প্রচার-প্রচারণা কার্যক্রমসহ যাবতীয় কিছু সংরক্ষণ করার দায়িত্ব পাবে ১৫তম প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি; যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তার সম্পর্কে জানতে পারে।

প্রেসিডেন্টের পছন্দ অনুযায়ী জায়গায়ই সাধারণত প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি স্থাপন করা হয়। এর উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা হবে এবং সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত হলে, তা ‘ন্যাশনাল আর্কাইভস অ্যান্ড রেকর্ডস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নারা) কর্তৃক পরিচালিত হবে এবং ট্রাম্প লাইব্রেরিটি আমেরিকান প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরির নিয়মানুযায়ী অন্য ১৪টি প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরির সাথে যুক্ত হবে। উল্লেখ্য, ১৪টি প্রেসিডেন্সিয়াল লাইবেরির মধ্যে সবগুলোই নারা কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে। শুধুমাত্র রিচার্ড নি’নের লাইব্রেরি দুটি ব্যক্তিগতভাবে পরিচালিত হয়।

আমেরিকান প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি তৈরির উদ্যোক্তা ছিলেন ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট। ১৯৩৯ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে এর গোড়াপত্তন করেন। রুজভেল্ট তার ব্যক্তিগত ও প্রেসিডেন্সিয়াল দলিলপত্রসমূহ ফেডারেল গভর্নমেন্টকে দান করেন এবং হাইড পার্কে তার নিজস্ব সম্পত্তিতে লাইব্রেরি এবং মিউজিয়াম ভবনটি প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি মনে করতেন, একজন প্রেসিডেন্টের সরকারি দলিলপত্রসমূহ হলো জাতীয় ঐতিহ্য এবং ভবিষ্যৎ ব্যবহারকারীদের জন্য এসব দলিলপত্রসমূহ অক্ষত এবং মূল অবস্থায় একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষণ করা উচিত। সেই থেকেই প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরির যাত্রা শুরু। ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি অ্যান্ড মিউজিয়ামে আনুমানিক ১৬ মিলিয়ন পৃষ্ঠা ব্যক্তিগত ও প্রশাসনিক কাগজপত্র এবং ৪৫ টনেরও বেশি দলিলপত্রসমূহ সংরক্ষণ করা আছে।

Advertisement

১৯৫০ সালে প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনিও প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি গঠন করবেন। এরপরই ১৯৫৫ সালে কংগ্রেস কর্তৃক ‘প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি অ্যাক্ট ১৯৫৫’ পাস হয়। এ অ্যাক্টের মাধ্যমেই নারাকে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত সব দলিলপত্রসমূহ, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, বিভিন্ন সময়ের প্রচার-প্রচারণা, ভিডিও ডকুমেন্টসসহ যাবতীয় কাজের অনুমতি প্রদান করা হয় এবং প্রেসিডেন্টদেরও উৎসাহিত করা হয়, তাদের ঐতিহাসিক ডকুমেন্টসমূহকে সরকারের কাছে দান করার ব্যাপারে।

১৯৭৮ সালের আগ পর্যন্ত প্রেসিডেন্সিয়াল ডকুমেন্টসমূহ তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু পরবর্তীতে সেগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হতো না। ফলে সেগুলো হারিয়ে যেত নতুবা ধ্বংস হয়ে যেত অথবা সুভ্যেনির বা অটোগ্রাফ সংগ্রহকারীরা চুরি করত। ফলে ১৯৭৮ সালে কংগ্রেস ‘প্রেসিডেন্সিয়াল রেকর্ডস অ্যাক্ট ১৯৭৮’ পাস করে। এতে সব প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টদের রেকর্ডসমূহ ফেডারেল সরকারের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের রেকর্ডসমূহ প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত হয়।

প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরিসমূহ আসলে আরকাইভস ও জাদুঘর হিসেবেও বিবেচিত হয়। এখানে প্রেসিডেন্টদের বিভিন্ন প্রকার ডকুমেন্টসের পাশাপাশি তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্রও সংরক্ষণ করা হয়। ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের বিখ্যাত ফোর্ড গাড়িটি, যা পায়ের ব্যবহার ছাড়া হাতের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হতো; তা রুজভেল্ট লাইব্রেরি অ্যান্ড আরকাইভসে সংরক্ষিত আছে।

২০১০ সালে মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণে আইভিএলপি প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার সুবাদে আরকানসাসে অবস্থিত ‘উইলিয়াম জে ক্লিনটন প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি অ্যান্ড মিউজিয়াম’ দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। সংগ্রহের দিক থেকে এটি হচ্ছে সর্ববৃহৎ প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি। এর সংগ্রহে আছে আনুমানিক ৭৬.৮ মিলিয়ন পৃষ্ঠা পেপার ডকুমেন্টস, ১.৮৫ মিলিয়ন দৈর্ঘ্য আলোকচিত্র, অডিও টেপ ও ভিডিও রেকর্ডিংসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চিঠি। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত উপহার সামগ্রীও স্থান পেয়েছে এ লাইব্রেরিতে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত উপহার রুপার তৈরি গরুর গাড়িও এখানে সংরক্ষণ করা আছে।

Advertisement

প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরিসমূহ আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করার ক্ষেত্রে যথার্থ তথ্যের উৎস হিসেবে কাজ করে। আমেরিকান প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরির মতো বাংলাদেশেও সরকার প্রধানদের মেয়াদকালীন কার্যক্রমকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্য এ ধরনের লাইব্রেরি বা সংরক্ষণাগার গড়ে তোলা যেতে পারে। প্রামাণ্য দলিলই হলো ইতিহাসের সত্যতা নির্ধারণের একমাত্র হাতিয়ার। ফলে কোনো প্রকার বিকৃতি ছাড়াই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে।

লেখক: হেড অব লাইব্রেরি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি।

এসইউ/এমএস