সৈকত রুশদী, টরেন্টো কানাডা থেকে
Advertisement
তখন আমি ঢাকার আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। বনানী থেকে পায়ে হেঁটে সকাল দশটার দিকে কলেজে যাওয়ার পথে এয়ারপোর্ট রোডে ট্যাংক, ট্রাক ভর্তি উত্তেজিত সৈনিক এবং গোলাগুলির শব্দ সত্ত্বেও উত্ফুল্ল ও উত্কণ্ঠিত মানুষের স্রোত দেখলাম।
কলেজে গিয়ে শুনলাম পাল্টা অভ্যুথানে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম নিহত হয়েছেন। তার মরদেহ কলেজের কাছেই ঢাকা কম্বাইন্ড মিলিটারি হসপিটাল (সিএমএইচ)-এর মর্গে রাখা আছে।
মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হিসেবে খালেদ মোশাররফকে কলেজের ক্যান্টিন ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করতে দেখেছি।
Advertisement
এছাড়াও বনানীর সাত নম্বর রোডে আমাদের পাশের বাড়িতে ভাড়াটে, তার ভায়রা ভাই বিমান চালনা প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেনকে কিউ হুদার বাসায় আসতে দেখেছি বহুবার।
বনানীর বন্ধু ও সহপাঠী ফারুক (এনামুল হক খন্দকার, বর্তমানে কানাডার মন্ট্রিয়লে বসবাসরত) ও আরও কয়েকজন ছাত্র ঠিক করলাম কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফের মরদেহ শেষবারের মতো দেখে আসি।
কলেজ থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মূল সড়ক ধরে পায়ে হেঁটে সিএমএইচ-এ রওয়ানা হতেই দেখি সেনাবাহিনীর কমব্যাট পোশাক পরিহিতি সশস্ত্র সৈন্যদের প্রহরায় গাড়ি চলাচল করছে দ্রুত বেগে।
দ্রুত ধাবমান জিপ গাড়ি (এসইউভি) থেকে মাইকে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে, কয়েকজন অফিসারকে হত্যার উদ্দেশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে যাচ্ছে সৈনিকরা। সশস্ত্র সৈন্যরা চলন্ত গাড়ির পেছনে ঝুলে রয়েছে। আর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে ছোঁড়া হচ্ছে ফাঁকা গুলি।
Advertisement
আমাদের নিরাপত্তার জন্য মাথা নিচু করে আমরা রাস্তা থেকে লাফিয়ে মাঠে নেমে পড়লাম, পৌঁছালাম মর্গে। মর্গটি হাসপাতালের মূল চত্বরের বাইরে। চারদিকে প্রায় তিনফুট উঁচু দেওয়াল, তার উপরে কাঁচঘেরা এক ঘরের মেঝেতে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে কয়েকটি মরদেহ। তার পাশে বড় বড় বরফের ব্লক। মরদেহের উপরেও কিছু বরফের টুকরো। সশস্ত্র সৈনিকের প্রহরা। মানুষ সারিবেঁধে দেখে যাচ্ছে নীরবে।
চিনতে পারলাম শায়িত খালেদ মোশাররফের মরদেহটি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কপালে গুলি লেগে আহত খালেদ মোশাররফের ক্ষতচিহ্নটি সুস্পষ্ট ছিল। তার পাশেই শায়িত কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম ও কর্নেল এ টি এম হায়দারের বীর উত্তম-এর মরদেহ।
কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দারকে প্রথম দেখি বিজয়ের পর বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম সম্প্রচারে। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর (অথবা ১৭ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় লাইভ অনুষ্ঠানে।
পাকিস্তান সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ যে এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ পরবর্তী পরিস্থিতিতে ঢাকা মহানগরীর নিরাপত্তা সম্পর্কে নেওয়া কিছু ব্যবস্থা সম্পর্কে বলেছিলেন তারা ঘোষক ও উপস্থাপক সরকার ফিরোজ উদ্দিনের সাথে আলাপচারিতায়।
সেই সন্ধ্যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা এবং আরও কয়েকজন অসামরিক মুক্তিযোদ্ধাও বাংলাদেশ টেলিভিশনে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। ঢাকা মহানগরীতে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার নানা নির্দেশ প্রচার করেছিলেন।
অকুতোভয় তিন বীর মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ এইভাবে মর্গের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। রেডিওর ঘোষণায় ও সৈনিকদের স্লোগানে শুনেছি সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের নামে বিজয় ধ্বনি।
আমার বরাবরের কৌতুহলী মনের অভ্যাসবশত: আমি এক সহপাঠীর কাছে নিচু কণ্ঠে জানতে চাইলাম, ‘খালেদ মোশাররফ তো জিয়ার বিপক্ষে ছিলেন, হুদা এবং হায়দার কী খালেদের সঙ্গে ছিলেন, নাকি জিয়ার সাথে?’
পেছনে কেউ একজন হুঙ্কার দিয়ে উঠলো, ‘চুপ, কোনো শব্দ করবে না। একদম শেষ করে দেব।’
পিঠে তীক্ষ্ম কিছুর খোঁচা খেলাম। তাকিয়ে দেখি সেনাবাহিনীর এক নায়েক তার বন্দুকের মাথায় লাগানো ধারালো বেয়নেটের সুতীক্ষ্ণ অগ্রভাগ আমার পিঠে চেপে ধরে আছে। উত্তেজিত, রাতজাগা চোখে জিঘাংসা। ট্রিগারে আঙ্গুল। মনে হলো গুলি করে দেবে। আমি কিছু ব্যাখ্যা করতে গেলে সে আরও উত্তেজিত। তখনও ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত অভ্যুত্থান চলমান।
ঠিক সেই মুহূর্তে বনানীর বন্ধু ও সহপাঠী এনু (কাজী এনায়েত উল্লাহ, বর্তমানে ফ্ৰান্সের প্যারিসে বসবাসরত বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সমাজসেবী ও সংগঠক) এগিয়ে এসে ওই নায়েককে বললো, ‘আদমজী কলেজের ছাত্র, ছেড়ে দিন।’
ছয় ফুটের উপর উচ্চতার এনু ছিল কলেজের অন্যতম প্রিফেক্ট। কলেজের ইউনিফর্ম শাদা শার্ট, নীল প্যান্ট পরনে। বাহুতে মেরুন রঙের কাপড়ের বন্ধনীতে পিতলের ধাতব অক্ষরে বড় করে ইংরেজিতে লেখা পি (P)। বরাবরই সপ্রতিভ এনু ও তার হাতের ব্যাজ দেখে আমার পিঠে উদ্ধত সঙ্গীন চেপে ধরা নায়েক তাকে মিলিটারি পুলিশের (MP) মতো কিছু একটা অথবা কী বুঝলো জানি না। আমাকে ছেড়ে দিল।
আমি দ্রুত সহপাঠী বন্ধুদের সাথে করে প্রাণটা নিয়ে ওই তল্লাট ছেড়ে কলেজে ছুটলাম। প্রাণে বাঁচলাম! ফিরে আসলাম অবিস্মরণীয় এক অভিজ্ঞতা নিয়ে।
এমআরএম/এমএস