মতামত

মার্কিন সমাজের ভেতরের যুদ্ধটা

 

এ লেখা যখন লিখছি তখনও মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়নি। ভোটগ্রহণের পর চারদিন কেটে গেছে। মার্কিন মুল্লুক এখনও জানে না, আগামী চার বছর কার দখলে থাকবে হোয়াইট হাউজ। তবে সব বিবেচনায় নির্বাচনে বিজয়ের পথে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটের ফলাফল দেখে যেন দিশাহীন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। কখনো ভোটে কারচুপির অভিযোগ তুলছেন, কখনও কারও বিরুদ্ধে মামলা করছেন, কখনো ভোট গণনা বন্ধের দাবি করছেন- সব মিলিয়ে গরম মার্কিন রাজনীতি। এদিকে নিঃশব্দে একের পর এক রাজ্যে ট্রাম্পকে পেছনে ফেলে হোয়াইট হাউসের দিকে এক পা দু’পা করে এগিয়ে চলেছেন বাইডেন, আর আন্যদিকে একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করে চলেছেন ট্রাম্প। বরাবরের মতো উন্মত্ত আচরণ করে চলেছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

Advertisement

ঠিক এমনই এক পরিস্থিতিতে ভোটগণনা নিয়ে একের পর এক মিথ্যাভাষণের অভিযোগে ট্রাম্পের ভাষণের লাইভ সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়ে সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে একাধিক মার্কিন টিভি চ্যানেল। ভোটের পর বৃহস্পতিবার রাতে হোয়াইট হাউসে প্রথমবার জনসমক্ষে আসেন ট্রাম্প। সেখান থেকেই রিপাবলিকান সমর্থকদের উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি। তবে সেই ভাষণ শুরু হতে না হতেই তার সম্প্রচার বন্ধ করে দেয় এবিসি, সিবিএস এবং এনবিসির মতো আমেরিকার প্রথম সারির টিভি নেটওয়ার্ক। ভাষণের মাঝেই ওই চ্যানেলগুলোর সঞ্চালক সরাসরি ট্রাম্পের ভাষণকে ‘মিথ্যা’ বলে আখ্যা দেন। টিভি নেটওয়ার্কগুলির কাছে ‘ধাক্কা’ খাওয়ার আগে ফেসবুকের কাছ থেকেই হুঁশিয়ারি পেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ভোটগণনা চলাকালীন জেতার দাবি করায় তার টুইটে সতর্কীকরণের নোটিফিকেশন দেয় ফেসবুক।

অনেকেই বলছেন, আমেরিকার গণতন্ত্রের সৌন্দর্য এখানেই। গণমাধ্যম একজন প্রেসিডেন্টের ভাষণ প্রচার বন্ধ করে দিতে পারে তার তথ্যকে মিথ্যা আখ্যা দিয়ে। ট্রাম্প তার গত চার বছরের শাসনামলে গণমাধ্যমের সাথে যে শত্রুতা সৃষ্টি করেছেন তা আগে কখনও দেখা যায়নি। শুধু মিডিয়া নয় তার সাথে বৈরিতা এখন প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের।

এত এত সমালোচনা, এত এত বিরক্তি তার কথায়, তবু ভদ্র, মার্জিত জো বাইডেনের সাথে লড়াই হয়েছে হাড্ডাহাড্ডি। গণনা শেষ হয়নি, কিন্তু ভোটের দিনই ট্রাম্প বলে ফেললেন তিনি জিতেছেন। নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে যত দিন এগিয়েছে ততই উদ্ভট সব কথা বলেছেন ট্রাম্প। বলেছেন, কোনো মতেই নিজের হার মেনে নেবেন না, হারলে ধরে নেবেন সেটা ভুয়া রেজাল্ট। বলছেন, তাকে কেউ হোয়াইট হাউস থেকে সরাতে পারবে না। বলেছেন সংবিধান তিনি মানেন না, শাসনভার তা হাতেই থাকবে। বারবার বলছেন, সব ভোট মোটেই গুনতে দেবেন না। তার এসব কথা প্রতিবাদে এখন মানুষ রাস্তায় প্রতিবাদ করছে। কিন্তু এমন নেতাকে তো উজার করে ভোটও দিয়েছে তার দেশের মানুষ!

Advertisement

এই প্রথম আমেরিকাবাসী নির্বাচন করেছে একত চরম বিভাজিত বৈরী পরিবেশে। জয়-পরাজয়ের এমন দড়ি টানাটানি, আইনি লড়াইয়ের এমন আবহ আগে দেখেনি মার্কিনিরা। একশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে এবার। গণতন্ত্রের, উদারতার যে সৌন্দর্যের কথা বলি সেই আমেরিকার প্রায় অর্ধেক মানুষ ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে যার আচজরণে সামান্য সৌন্দর্য নেই।

ইমিগ্র্যান্টবিরোধী তার চরম মনোভাব, বর্ণবাদী আচরণ কোনো কিছুই তার সমর্থন কমায়নি বোঝা যায়। অর্থনীতির রুগ্নদশা, বিপুল বেকারত্ব, কিছুই প্রভাব রাখেনি। শুধু মহামারি করোনা রোগে বিপুল প্রাণহানি না ঘটলে হয়তো ট্রাম্প আবারও বাজিমাত করতেন সহজে। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির মামলা, নারী-নিগ্রহের অভিযোগ, কর ফাঁকির অভিযোগ, সবই উড়িয়ে দিয়ে তার পক্ষে এত ভোট দিয়েছে মার্কিন জনতা। সারাবিশ্বে এই নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ। সবাই তাকিয়ে আছে কী হয় সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশে। কিন্তু আমেরিকানরা বুঝিয়ে দিল দেশটির জনসংখ্যার বিরাট অংশ ট্রাম্পের মতো দানবীয় শাসন চায়।

কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী, অভিবাসীবিরোধী মনোভাব চাঙ্গা করে চার বছর আগে ক্ষমতায় এসে সেই মনোভাবকে পাকাপোক্ত করেছেন ট্রাম্প। এর প্রভাব অনেকদিন থাকবে মার্কিন সমাজে। শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা কতটা তাকে পছন্দ করে এই নির্বাচন আবার সেটি প্রমাণ করেছে। শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে তিনজন ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে। এই ভোট যতটা রিপাবলিকান দলের তারচেয়ে বেশি ব্যক্তি ট্রাম্পের।

বাইডেনের জোর উদারতায়। সাদা, কালো, অভিবাসী নির্বিশেষে তাকে পছন্দ করেছে। কিন্তু তাকে, উদার আমেরিকান নাগরিক সমাজকে ভাবতে হবে কোথায় লুকানো আছে বিদ্বেষের বীজ। যে আমেরিকা এত প্রবলভাবে ট্রাম্পকে চায় সেই আমেরিকার জনতার অর্ধেকের মনে বর্ণবিদ্বেষ আর অভিবাসী বিদ্বেষ আছে। সেই আমেরিকার গন্তব্য কতদূর সেটা নিয়েও ভাবার আছে অনেক।

Advertisement

বাইডেন যদি হোয়াইট হাউসে যান তবে তার জন্য চ্যালেঞ্জ অনেক। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হবে, পররাষ্টনীতিতে ভারসাম্য আনতে হবে। বিচার ব্যবস্থায় ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। করোনার সাথে যুদ্ধটাও তার জন্য বড় লড়াই। তবে এর চেয়ে বড় যুদ্ধ তার জন্য অপেক্ষা করছে। আমেরিকা সারা পৃথিবীতে যুদ্ধ করে। কিন্তু সম্ভবত এবারের যুদ্ধটা নিজের ঘরেই। অর্ধেক আমেরিকান যে সমাজ চায় সেটা তার জন্য আসলে ভেতরের যুদ্ধ, বাইরের নয়।

এইচআর/বিএ/এমএস